অক্টোবর ১৭, ২০১৮ ২০:৪৫ Asia/Dhaka

মসজিদ হচ্ছে আল্লাহর সামনে বান্দার সিজদা করার জায়গা। আর বান্দা যতভাবে আল্লাহর ইবাদত করতে পারে তার সর্বোৎকৃষ্ট রূপ হচ্ছে সিজদা করা।

মুসল্লিরা জামায়াতে একত্রিত হয়ে আল্লাহর সামনে সিজদা করে বলে এই পবিত্র স্থানের নাম মসজিদ। মানুষ তার চারিত্রিক দুর্বলতাগুলো পেছনে ফেলে মসজিদে প্রবেশ করে এবং সেখানে আত্মম্ভরিতা, অহংকার ও কুপ্রবৃত্তিগুলোকে পুরোপুরি দমন করে এক আল্লাহর কাছে নিজেকে সমর্পন করে। আল্লাহ তায়ালার ভালোবাসার আগুনে পুড়ে খাঁটি সোনায় পরিণত হওয়ার স্থান এই মসজিদ। একনিষ্ঠ চিত্তে আল্লাহর ইবাদত করার গৌরব অর্জন করার জন্য মসজিদের মতো পবিত্র স্থান আর হতে পারে না।

আফগানিস্তানের বিখ্যাত হেরাত জামে মসজিদ

পারস্পরিক সাহায্য, সহযোগিতা ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে মুসলিম সমাজ গড়ে ওঠে। কাজেই এ সমাজে সবার মঙ্গল-অমঙ্গল পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মসজিদে জামায়াতের নামাজে পারস্পরিক ঐক্যের এই বন্ধন সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ধনী-গরীব, উঁচু-নীচু, সাদা-কালো সবাই এক কাতারে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। এই নামাজ মুসলমানদেরকে পরস্পরের অভাব অভিযোগ শোনা ও তার প্রতিকার করার শিক্ষা দেয়। মুসলিম সমাজ হচ্ছে এমন একটি দেহের মতো যার একটি অঙ্গ ব্যথা পেলে অন্য অঙ্গগুলিও কষ্ট পায়। এ কারণে সব অঙ্গকেই সুস্থ ও নিরাপদ রাখার জন্য মুসল্লিদেরকে পরস্পরের খবরাখবর রাখতে হয়। মুসলিম সমাজের প্রতিটি সদস্যকে অন্যান্য সদস্যের সুখ-দুঃখকে ভাগাভাগি করে নিতে হয়।

আফগানিস্তানের বিখ্যাত হেরাত জামে মসজিদ

 

শুরুতেই যেমনটি বলেছি, সমাজের বঞ্চিত মানুষদের অভাব পূরণে মসজিদ কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। কারণ, মসজিদে সব মানুষের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় হয় এবং এখানে মুমিন ব্যক্তিরা পরস্পরের খোঁজখবর নিতে পারেন। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকেই দুঃস্থ মানুষের সহায়তায় মসজিদ অনন্য ভূমিকা পালন করে এসেছে। সে যুগে কোনো দরিদ্র লোক স্বাবলম্বী হতে চাইলে তিনি মসজিদে চলে যেতেন। এ প্রসঙ্গে ইমাম আলী (আ.)’র জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করা যায়। একবার তিনি নামাজরত অবস্থায় একজন ভিক্ষুককে নিজের আংটি দান করেছিলেন। আল্লাহ রব্বুল আলামিন তাঁর এ কাজের প্রশংসা করে সূরা মায়েদার ৫৫ নম্বর আয়াত নাজিল করেন।

দান-খয়রাত, পরোপকার ও দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়াতে ইসলাম যে দিকনির্দেশনা দিয়েছে তার ফলে সমাজে মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন শক্তিশালী হয়।  ইসলাম সমাজ থেকে দারিদ্র নির্মূলকে সবার দায়িত্ব বলে উল্লেখ করেছে। আর আল্লাহর ঘর হিসেবে মসজিদে এই কাজটি সর্বোৎকৃষ্ট উপায়ে করা সম্ভব। এখনো বিশ্বের দেশে দেশে মসজিদগুলোতে দারিদ্র নির্মূলের জন্য বিশেষ কর্মসূচি রয়েছে এবং দরিদ্র ব্যক্তিরা সাহায্যের আশায় মসজিদের দরজায় সমবেত হন। অনেক দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগের পর মসজিদকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে সামর্থ্যবানদের সাহায্য গ্রহণ করে দুর্গত মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ইরানের কেরমানশাহ প্রদেশে ২০১৭ সালের শেষ দিকে যে ভূমিকম্প হয় তারপর সারাদেশের মানুষের দেয়া সাহায্য গ্রহণ করে তা ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত এলাকার মানুষের মধ্যে বণ্টন করতে ইরানের মসজিদগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

আফগানিস্তানের বিখ্যাত হেরাত জামে মসজিদ

এবারে আমরা আফগানিস্তানের হেরাত জামে মসজিদকে আপনাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেব। এই মসজিদকে আফগানিস্তানের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও শিল্প তুলে ধরার এক অনন্য নজির হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ইতিহাসে এসেছে, এই মসজিদের স্থানে অতীতে অ্যারিয়ানদের উপাসনালয় ছিল। পরবর্তীতে জরাথ্রুস্টরা এখানে অগ্নিমন্দির নির্মাণ করে অগ্নি উপাসনা করত। হেরাতের জনগণ ইসলাম গ্রহণ করার পর ২৯ হিজরিতে অগ্নিমন্দিরকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়।

আফগানিস্তানের বিখ্যাত হেরাত জামে মসজিদ

 

হেরাত জামে মসজিদে আফগান কারুকার্যময় শিল্পের চমৎকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।  একসঙ্গে এক লাখ মুসল্লি এখানে জামায়াতে নামাজ আদায় করতে পারেন। বিশাল এলাকাজুড়ে নির্মিত এই মসজিদে রয়েছে ৪৬০টি গম্বুজ, ১২টি মিনার, ৪৪৪টি স্তম্ভ, ১৩০টি ছোটবড় ছাদযুক্ত বারান্দা এবং কুরআনে কারিমের আয়াতখচিত চারটি বিশাল শিলালিপি।  মসজিদের মিম্বরটি একখণ্ড বড় পাথর খোদাই করে তৈরি করা হয়েছে। এ ছাড়াও হেরাত জামে মসজিদের রয়েছে একটি বিশাল অজুখানা, চার হাজার বইসমৃদ্ধ একটি পাঠাগার এবং একটি মাদ্রাসা। এই মসজিদ নির্মাণে ইট, চুনাপাথর ও টাইলস’সহ একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা নির্মাণের সমস্ত উপাদান ও কলাকৌশল প্রয়োগ করা হয়েছে। মসজিদটির সৌন্দর্য চোখে না দেখলে বর্ণনা করে বোঝানো কঠিন।

 

আফগানিস্তানের বিখ্যাত হেরাত জামে মসজিদ

মজার ব্যাপার হচ্ছে,একটি নির্দিষ্ট সময়ে পুরো মসজিদ তৈরি না হয়ে যুগে যুগে এর এক একটি অংশ নির্মিত হয়েছে বলে নানা যুগের স্থাপত্যশৈলী এখানে চোখে পড়ে। ঘোরী শাসনামল থেকে শুরু করে তৈমুরি শাসন হয়ে পরবর্তী নানা শাসকের শিল্পকর্ম ও স্থাপত্যশৈলী এই মসজিদে দেখতে পাওয়া যায়। প্রায় চৌদ্দশ’ বছর আগে নির্মিত মসজিদটি প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ নানা কারণে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও পুনর্নির্মিত হয়েছে। ৪১৪ হিজরিতে তখনকার কাঠনির্মিত মসজিদটির অর্ধেকটা আগুনে পুড়ে গিয়েছিল। জনগণের সহযোগিতা নিয়ে খাজা মোহাম্মাদ তাকি তখনকার মতো মসজিদটি মেরামত করেন। ওই ঘটনার প্রায় দুইশ’ বছর পর শেইখুল ইসলাম ফাখরুদ্দিন রাজির প্রস্তাবনায় সুলতান গিয়াসুদ্দিন ঘোরী মসজিদটির পুনর্নিমাণের নির্দেশ দেন। তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যবিদ ও নির্মাণশিল্পীদের দিয়ে হেরাত জামে মসজিদ তৈরি হয়।

আফগানিস্তানের বিখ্যাত হেরাত জামে মসজিদ

পরবর্তীতে হেরাতে চেঙ্গিস খানের হামলায় মসজিদটির অপূরণীয় ক্ষতি হয়। ৭০৭ হিজরিতে তৎকালীন সুলতান গিয়াসুদ্দিন কুর্তের নির্দেশে মসজিদটি পুনর্নির্মাণ করা হয় এবং এরসঙ্গে ‘গিয়াসিয়াহ’ নামে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করা হয়। পাশাপাশি মসজিদে স্থাপন করা হয় ব্রোঞ্জ-নির্মিত একটি বিশাল পাত্র। চমৎকার কারুকার্যখচিত এই পাত্রে অতীতে ধর্মীয় উৎসবের দিনগুলোতে শরবত তৈরি করে হাজার হাজার মানুষের মাঝে বিতরণ করা হতো।  চার দশমিক ছয় মিটার ব্যাসের পাত্রটির গভীরতা প্রায় দেড় মিটার।  হেরাত জামে মসজিদের আশপাশের মুসল্লিদের কানে আজান পৌঁছে দেয়ার জন্য মসজিদটিতে যেসব মিনার সংযোজন করা হয় সেগুলোর উচ্চতা ১৭ থেকে ৩৬ মিটার পর্যন্ত। এসব মিনারের ব্যাস ৭ থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত এবং এগুলোর প্রত্যেকটির ভেতর দিয়ে মিনারের শীর্ষে ওঠার সিঁড়ি রয়েছে।  দশম হিজরিতে সুলতান হোসেইন বাইকারা’র শাসনামলে হেরাত জামে মসজিদ আরেকবার সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ করা হয়।

আফগানিস্তানের বিখ্যাত হেরাত জামে মসজিদ

১৯৪৩ সালে আফগানিস্তানের শেষ বাদশাহ মোহাম্মাদ জহির খানের নির্দেশে তৎকালীন সেরা স্থাপত্যবিদ আব্দুল্লাহ খান মেলকিয়ারের তত্ত্বাবধানে সর্বশেষবারের মতো এই মসজিদের সার্বিক সংস্কার করা হয়। মেলকিয়ার এমন একদল স্থাপত্যশিল্পীকে এই কাজে নিয়োজিত করেন যাদের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীতে দখল রয়েছে। এসব শিল্পী নিপুণ হাতে মসজিদের অতীত স্থাপত্যরীতি অক্ষুণ্ন রেখে এটির আধুনিকায়ন করেন। আপনারা শুনলে বিস্মিত হবেন যে, এই ঐতিহাসিক মসজিদটির সংস্কার ও মেরামত কাজ এখনো অব্যাহত রয়েছে। হেরাতের মানুষের মধ্যে জনশ্রুতি রয়েছে, সেখানকার এই জামে মসজিদ নির্মাণের কাজ কোনোদিনও শেষ হবে না; যদি কোনোদিন শেষ হয়ে যায় সেদিন কিয়ামত সংঘটিত হবে। #

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ/ ১৭

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন

ট্যাগ