অক্টোবর ২১, ২০১৮ ২০:১৬ Asia/Dhaka

সুরা মুনাফিকুনের গত পর্বের আলোচনায় আমরা মুনাফিকদের কিছু বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানতে পেরেছি। এ সুরার পঞ্চম থেকে অষ্টম আয়াতে মুনাফিকদের আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে।

সুরা মুনাফিকুনের সপ্তম আয়াতে মহান আল্লাহ এটা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন যে ভূ ও নভোমন্ডলের ধন-ভান্ডার আল্লাহরই। মুনাফিকরা রাসুল(সা)'র সহযোগীদের জন্য খরচ করতে বা দান করতে মুসলমানদের নিষেধ করত। তাদের ওই আচরণের কথা তুলে ধরে এই আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন:

'তারাই তথা মুনাফিকরা বলেঃ আল্লাহর রাসূলের সাহচর্যে যারা আছে তাদের জন্যে ব্যয় করো না। পরিণামে তারা আপনা-আপনি সরে যাবে রাসুলের পাশ থেকে। ভূ ও নভোমন্ডলের ধন-ভান্ডার আল্লাহরই কিন্তু মুনাফিকরা তা বোঝে না। '

ইতিহাসে এসেছে বনি মুস্তালিক যুদ্ধের পর এ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুহাজিরদের মধ্য থেকে‘ জাহ্জাহ্ ইবনে সাঈদ’ এবং আনসারদের মধ্য থেকে‘ সানান জুহনী’ নামক দু’জন মুসলমানের মধ্যে পানি নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে তারা নিজ নিজ গোত্রকে সাহায্যের জন্য আহবান জানায়। এ গোত্রভিত্তিক সাহায্যের আহবানের পরিণতি এতটা ক্ষতিকর হতে পারত যে, তারা মদীনা থেকে দূরে এই স্থানে পরস্পরের রক্তপাত করতে উদ্যত হয়েছিল,যা তাদের উভয়কেই নিশ্চিহ্ন করে দিত। মহানবী (সা.) ঘটনাটি জানতে পেরে দ্রুত ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে বললেন : “এই দু’ব্যক্তিকে তাদের অবস্থার ওপর তথা মন্দ পরিণতির ছেড়ে দাও। এরূপ সাহায্য কামনা অত্যন্ত ঘৃণ্য ও দুর্গন্ধযুক্ত। এটি জাহিলী যুগের আহবান। তাদের অন্তর হতে জাহিলী যুগের মন্দ প্রভাব এখনো দূর হয়নি। এ দুই ব্যক্তি ইসলামের শিক্ষা ও কর্মসূচী সম্পর্কে অবহিত নয়। ইসলাম সব মুসলমানকে পরস্পরের ভাই বলেছে এবং যে আহ্ববানই পরস্পরকে বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন করে,তা হবে 'মূল্যহীন একত্ববাদ’।

এভাবে মদীনায় হিজরতের পর এই প্রথম বারের মতো মুহাজির ও আনসারদের মধ্যে বিরোধের অগ্নি জ্বলে উঠলেও মহানবীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় উভয় দল শান্ত ও নিরস্ত হয়। কিন্তু মদীনার মুনাফিকদের নেতা আবদুল্লাহ্ ইবনে উবাই এ বিরোধের সুযোগে নিজের বিদ্বেষ প্রকাশ করে নিজের কিছু সঙ্গী ও সমর্থকদের বলে:“ আমাদের কারণেই তারা আমাদের ওপর চেপে বসেছে। আমরা মদীনার অধিবাসীরা মক্কার মুহাজিরদের নিজ ভূমিতে আশ্রয় দিয়ে তাদেরকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করেছি। আমরা ঐ প্রবাদের মতো হয়েছি যাতে বলা হয়েছে : ‘তোমার কুকুরকে খাইয়ে হৃষ্টপুষ্ট কর,পরে সে তোমাকেই খাবে’। আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, মদীনায় ফিরে গিয়ে আমরা সম্মানিত ও শক্তিশালীরা  তথা মদীনার অধিবাসীরা দুর্বল ও অসম্মানিতদের  তথা মক্কার মুহাজিরদের বের করে দেব।” অর্থাৎ আবদুল্লাহ ইবনে উবাই মহানবী (সা)সহ সব মুহাজির মুসলমানদের মদিনা থেকে বের করার শপথ ব্যক্ত করে। তার এ বক্তব্য মহানবীর কানে চলে গেছে বলে বুঝতে পারার পর সে এমন কথা বলেনি বলে রাসুলের কাছে জানায়।

 

কিন্তু পবিত্র কুরআনে সুরা মুনাফিকুনের এই আয়াতে তথা অষ্টম আয়াতে উবাইর কপট আচরণের তীব্র নিন্দা জানান স্বয়ং আল্লাহ। ফলে সে মুসলমানদের কাছে লাঞ্ছিত হয় যদিও এতদিন সে নিজেকে সম্মানিত বলে মনে করত। আর এই লজ্জা ও লাঞ্ছনার মধ্যেই সে মারা যায়।

সুরা মুনাফিকুনের অষ্টম আয়াতে মহান আল্লাহ মুনাফিক নেতা উবাই ও তার দলবলকে লক্ষ্য করে বলেছেন: 'তারাই বলেঃ আমরা যদি মদীনায় ফিরে আসি তবে সেখান থেকে সবল অবশ্যই দুর্বলকে বহিস্কৃত করবে। শক্তি তথা সম্মান তো আল্লাহ, তাঁর রসূল ও মুমিনদেরই কিন্তু মুনাফিকরা তা জানে না।'-সব ক্ষমতা ও শক্তির মালিক যে মহান আল্লাহ- মুনাফিকরা যদি তা বুঝত তাহলে তারা মুসলমানদের সম্মানের বিষয়ে অবজ্ঞা করে কথা বলত না।

নিফাক বা কপটতার একটি বড় কারণ হল দুনিয়া এবং সম্পদ আর সন্তান-সন্ততির প্রতি অতিরিক্ত মোহ ও আকর্ষণ। তাই সুরা মুনাফিকুনের নয় নম্বর আয়াতে মুমিনদের সতর্ক করে বলা হয়েছে: 'হে ইমানদাররা! তোমাদের ধন-সম্পদ ও সন্তান-সন্ততি যেন তোমাদেরকে আল্লাহর স্মরণ থেকে উদাসীন না করে। যারা এ কারণে গাফেল হয়,তারাই তো ক্ষতিগ্রস্ত।'

এটা ঠিক যে সন্তান-সন্ততি ও ধন-সম্পদ মহান আল্লাহর নেয়ামত। কিন্তু এসব সম্পদকে কেবল আল্লাহকে পাওয়ার ও চির-সৌভাগ্য অর্জনের পথে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে হবে। অন্যদিকে এসব সম্পদের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত ঝোঁক আল্লাহর দাসত্বের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই এ মহাবিপদের বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে।

সুরা মুনাফিকুনের দশ নম্বর আয়াতে দান-খয়রাতের গুরুত্ব তুলে ধরে বলা হয়েছে: 'আমি তোমাদেরকে যা দিয়েছি,তা থেকে মৃত্যু আসার আগেই ব্যয় কর। অন্যথায় সে বলবেঃ হে আমার পালনকর্তা,আমাকে আরও কিছুকাল বেঁচে থাকার অবকাশ দিলে না কেন? তাহলে আমি সদকা করতাম এবং সৎকর্মীদের অন্তর্ভুক্ত হতাম।'

-অনেক মানুষ মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে এসে উদাসীনতার ঘুম থেকে জেগে ওঠেন এবং এ সময় দান-খয়রাত করার গুরুত্ব অনুভব করেন। এ সময় তারা অতীতের কাজকর্মের জন্য অনুশোচনা করেন এবং আরও কিছুকাল বাঁচার আর্জি পেশ করেন খোদার কাছে যাতে দান-খয়রাত করে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু তাদের সে আবেদন আর কখনও গ্রহণ করা হয় না। মহান আল্লাহ সুরা মুনাফিকুনের শেষ আয়াতে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ও জোরালো ভাষায় বলছেন:

'প্রত্যেক ব্যক্তির মৃত্যুর নির্ধারিত সময় যখন উপস্থিত হবে,তখন আল্লাহ কাউকে অবকাশ দেবেন না। তোমরা যা কর,আল্লাহ সে বিষয়ে খবর রাখেন। #

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ২১