নভেম্বর ০৫, ২০১৮ ১৬:০২ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের মানুষের অধিকার ভোগ করার মতো পরিবেশ থাকা উচিত। একইসাথে মানুষেরও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তেহরান সফরের সময় রেডিও তেহরানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। তিনি বলেন, মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা আছে।তিনি বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে দেশ অনেক এগিয়েছে তারপরও তাদের প্রতি সহিংসতা আছে।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছন গাজী আবদুর রশীদ।

রেডিও তেহরান: জনাব রিয়াজুল হক- আপনি তো দুটো বিষয়ের সমন্বয়ের কথা বললেন। তো সমন্বয় করার ক্ষেত্রে কি কোনো সমস্যা আছে?

কাজী রিয়াজুল হক: দেখুন, সমস্যা তো কিছু আছে। যেমন ধরুন সাম্প্রতিক সময়ে ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট যে আইনটি হয়েছে তা নিয়ে কিছু কথাবার্তা হচ্ছে। তো এ ব্যাপারে আমরা মনে করি যে, সরকারের কাছে সাংবাদিকরা যে দাবি তুলেছেন এবং সরকারের যে অবস্থান- উভয়পক্ষকেই একটা জায়গায় আসা উচিত। এ ব্যাপারে সরকার কতটুকু আসবে এবং সাংবাদিক বা মিডিয়া কর্মীরা কতটুকু পেলে সন্তুষ্ট হবেন সেটা সম্পূর্ণভাবে তাঁদের ব্যাপার। স্টেক হোল্ডার তো তারা। আমাদের বক্তব্য হচ্ছে মানুষের অধিকারগুলো যাতে তাঁরা ভোগ করতে পারেন সেরকম পরিবেশ থাকা উচিত। একইসাথে অধিকার ভোগ করার ক্ষেত্রে মানুষেরও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেয়া উচিত।

রেডিও তেহরান: মানবাধিকার ইস্যুতে কাজ করতে গিয়ে আপনি কী দেশে মানবাধিকারের ক্ষেত্রে কোথাও উন্নতি করার প্রয়োজন বলে অনুভব করেন?

কাজী রিয়াজুল হক: জ্বি, আমাদের সবক্ষেত্রেই উন্নতি করার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি। কারণ আমরা একটা স্বল্পোন্নত দেশ ছিলাম। সেখান থেকে আমরা এখন মধ্যম আয়ের দেশের দিকে যাচ্ছি। তারপরও বলব এই যে আমাদের এগিয়ে যাওয়া সেটাও পশ্চিমা বিশ্ব বা আরব দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে। কারণ তাদের অনেক প্রাকৃতিক সম্পদ আছে। জনসংখ্যা অনেক কম। সে তুলনায় আমাদের সম্পদ কম এবং লোকসংখ্যা অনেক বেশি। তার মধ্যেও আমরা ধাপে ধাপে এগোচ্ছি। তবে আমাদের আরো অনেক বেশি এগোতে হবে।

আমরা মাত্র মধ্যম আয়ের দেশের মহাসড়কে পা দিয়েছি। এই সড়ক বেয়ে আমাদের আরও উপরের দিকে উঠতে হবে। আমরা এভাবে মধ্যম আয়ের দেশে যাবো তারপর উন্নত দেশ হব।

আজ থেকে চার পাঁচশ বছর আগের কথা চিন্তা করলে দেখা যাবে –Bengal was cream for the foreigners. আমরা তখন দেখেছি আমাদের দেশে ফ্রান্সের লোকজন এসেছে। আমাদের এখানে ইংরেজরা এসেছিল ব্যবসা-বাণিজ্য করতে। আর এখন আমরা যাচ্ছি মধ্যপ্রাচ্যে চাকরি করতে। এই যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা আবারও পরিবর্তন হতে পারে। আমরা যদি আবার উন্নতি করতে পারি তাহলে আবার বিদেশিরা আমাদের এখানে আসবে। তবে হ্যাঁ একথা সত্য আমরা উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি কিন্তু ঠিক লক্ষ্যে আমরা এখনও পৌঁছতে পারিনি। এরজন্য সময়ের এবং সকলের সহযোগিতার প্রয়োজন। সমন্বিত উদ্যোগের প্রয়োজন।

রেডিও তেহরান: মানবাধিকার ইস্যুতে কাজ করতে গিয়ে সরকারের সহযোগিতা কেমন পান? 

কাজী রিয়াজুল হক: দেখুন, সরকারের সহযোগিতা তো আমরা পাই। আসলে বিষয়টাকে আমি এভাবে বলতে চাই যে, পৃথিবীর সবদেশেই জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের যে কনসেপ্ট সেটি এসেছে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সিদ্ধান্তের আলোকে। অর্থাৎ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পৃথিবীর সব দেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশন গঠিত হয়ে থাকে সেই দেশের সরকারের মাধ্যমে। আর  প্রতিটি দেশের সরকারেই উচিত জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সমস্ত দায়িত্ব নেয়া। তাদের বেতন-ভাতা, অফিসসহ যা কিছু প্রয়োজন তা সেই দেশের সরকারকে নিতে হবে এবং বাংলাদেশ সরকার সেটি করছে। আর আমরা আমাদের জায়গা থেকে কথা বলছি। বাংলাদেশ সরকার আমাদের সমস্ত দায়িত্ব নিয়েছে তার অর্থ এই নয় যে আমরা তাদের অধীন হয়ে থাকব। আমরা পর্যবেক্ষণকারীর দায়িত্ব পালন করে থাকি। আইনে আমাদেরকে 'ওয়াচ ডগ' হিসেবে রাখা হয়েছে। আমাদেরকে মনিটর করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আমরা সেভাবেই সবকিছু মনিটর করছি। যেখানেই ভায়োলেশন দেখছি, আইনের অপপ্রয়োগ দেখছি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে তুলে ধরছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখছি যে সরকার দ্রুতগতিতে উদ্যোগ নিচ্ছে আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধীর গতি দেখছি। আবার এমনও দেখেছি যে সরকার তদন্ত করে বলছে যে আমরা কোনো অপরাধ পাইনি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমাদের তদন্তে যারা দোষী হয়েছে তাদের শাস্তিও দেয়া হয়েছে।

রেডিও তেহরান: জনাব কাজী রিয়াজুল হক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা কখনো কখনো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির তাগিদ দিয়ে থাকে। এমন ক্ষেত্রে সরকারের সঙ্গে আপনারা কীভাবে সমন্বয় করেন?

কাজী রিয়াজুল হক: দেখুন, বিদেশি কিছু প্রতিষ্ঠান, এনজিও বা ব্যক্তি কখনও কখনও আমাদের দেশের কোনো কোনো ঘটনা নিয়ে যখন মন্তব্য করে সেটি একান্তই তাদের। তাদের সেসব মন্তব্যের সাথে আমাদের কোনো সহমর্মিতাও নেই আবার বিরোধও নেই। আমরা আমাদের দৃষ্টিকোণ থেকে যেখানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের  ঘটনা ঘটে সেটা তদন্ত করে থাকি। আর সে বিষয়টি আমরা সরকারকে অবগত করি এবং ব্যবস্থা নিতে বলি। যেকথা আগেই বলেছি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করে আবার কখনও কখনও করে না।

আরেকটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, বিদেশিরা বাংলাদেশ কে নিয়ে যেসব মন্তব্য করে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের সেসব মন্তব্যের সত্যতা খুঁজে পাই আবার কোনো কোনো মন্তব্যে সত্যতা পাই না। কোন্‌ নিউজ বা সোর্সের ভিত্তিতে তারা ওইসব তথ্য দেয় তা আমরা জানি না। সেক্ষেত্রে একটা ধোয়াশা থেকে যায়। আমারও মনে হয় হয় তাদেরও একটা দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করা উচিত। যেকোনো সময় কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে যারা অভিযুক্ত হলেন তাদেরও মতামত নেয়া উচিত। এটা একটা আইনি বিধান। অভিযুক্তের বক্তব্য না শুনে তাকে শাস্তি দেয়া যাবে না। অবশ্যই তার বক্তব্য শুনতে হবে। তো সেটা অনেক সময় করা হয় না। আমরা একটা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। কখনও কখনও এমন দেখেছি কেউ আমাদের সম্পর্কে একটা মন্তব্য করলেন যে বিষয়টি নিয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেয়নি। আমাদের সাথে কোনো চেক করেনি। আবার আমাদের দেশের অনেক পত্র-পত্রিকা বা মিডিয়াকে দেখেছি যারা খুব সেনসেবেল দায়িত্ব পালন করে। আবার তার ব্যতিক্রমও আছে। যেমন ধরুন আমরা একটা কথা বললাম তারপর কোনো কোনো মিডিয়া আমাদের সাথে কথা বলতে জানতে চায় আপনারা বক্তব্যটি কি এভাবে দিয়েছিলেন ইত্যাদি। আমাদের কাছ থেকে শুনে তারপর তারা সেটা প্রকাশ করে। ফলে শুধু দেশের নয় বিদেশের অনেক মিডিয়ার তথ্যের সাথে আমরা একমত হতে পারিনা।

রেডিও তেহরান: কাজী রিয়াজুল হক এবার নারীদের বিষয় নিয়ে জানতে চাইব। নানাক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে গেছেন। কিন্তু নারীদের কর্মপরিবেশ কেমন?

কাজী রিয়াজুল হক: খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে আপনি প্রশ্ন করেছেন। দেখুন, বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক এগিয়ে গেছে। ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের তথ্যানুসারে দক্ষিণ এশিয়াতে নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ পরপর দুবার চাম্পিয়ন হয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানের বিষয়টি  বিশ্বস্বীকৃত। তারপরও বলব নারীদের প্রতি সহিংসতা এখনও আছে। সমাজের এক শ্রেণির মানুষ এখনও নারীদের প্রতি সহিংস আচরণ করছে। সামাজিক অবক্ষয়ের কারণে, আইন সঠিকভাবে প্রয়োগ না হওয়ার কারণে অথবা সামাজিকভাবে প্রভাবশালীদের আইনের প্রতি ভয় না থাকার কারণে নারীদের প্রতি সহিংসতা এখনও আছে। তো আমাদের দেশে যেসব চ্যালেঞ্জ আছে সেগুলোকে খুঁজে বের করতে না পারলে এই যে নানারকম আইন করা হচ্ছে সেগুলোর পূর্ণতা আসবে না। আমার বিশ্বাস সরকার এসব বিষয়ে আরও অনেক বেশি দৃষ্টি দেবে। যারা কোনো আইনভঙ্গ করবে,  যারা কোনো নারীকে নির্যাতন করবে সঙ্গে সঙ্গে তাকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। কর্মক্ষেত্রে, রাস্তাঘাটে, স্কুলে যেসব নারী নির্যাতন বা সহিংসতার ঘটনা ঘটছে যদি আইনের কঠোর প্রয়োগ করা হয় তাহলে এসব বন্ধ হবে।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/৩