জানুয়ারি ২৬, ২০১৯ ২০:১৯ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছিলাম, যেসব পরিবারে ধর্মীয় বিধি-বিধান চর্চা হয় সেসব পরিবারে নৈতিক অবক্ষয় ও চারিত্রিক বিপর্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে থাকে। আর যদি ধর্মীয় চর্চা সুষ্ঠুভাবে না থাকে তাহলে দেখা দেয় বিচিত্র অবক্ষয়। বিশেষ করে নেশা জাতীয় দ্রব্য তথা মাদকের প্রতি আসক্তি দেখা দেয় মারাত্মকভাবে। বলাবাহুল্য আজকাল পরিবারগুলোতে মাদকাসক্তির প্রবণতা এতো ভয়াবহ যে তা খুবই উদ্বেগজনক।

একটি পরিবারে কী ধরনের মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনে এই মাদকাসক্তি তা বলাই বাহুল্য। বিশেষজ্ঞদের মতে মাদকে আসক্তি আসলে একটা রোগ। এই রোগটি ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করে এবং একটু একটু করে গ্রহণ করতে করতে একটা সময় পরিপূর্ণভাবে আসক্ত হয়ে পড়ে। এ কারণেই বেশিরভাগ ব্যক্তিই যারা মাদক গ্রহণ করতে শুরু করে তারা বুঝেতে পারে না যে অতি দ্রুতই তারা মাদকাসক্ত হয়ে পড়তে যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক যে আসক্ত ব্যক্তি বুঝতে পারে না মানে মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার ব্যাপারে আত্মসচেতন নয়। যখন বুঝতে পারে যে আসক্ত হয়ে পড়েছে তখন অনেক দেরি হয়ে যায় এবং ফিরে আসার আর সুযোগ থাকে না। হয়ে পড়ে মাদকাসক্ত। এর স্বরূপ ও পরিণতি নিয়ে আমরা আরও কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।

কীভাবে ধীরে ধীরে একটি মানুষ মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে তার অজান্তেই সে কথা বলছিলাম আমরা। একেবারে বুঝতেই পারা যায় না যে পরিবারের কোনো একজন সদস্য মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। পরিবারের অপরাপর সদস্যরাও অনেক পরে টের পায় বিভিন্ন কারণে। বিশেষ করে যখন তার আচার আচরণ সন্তোষজনক পর্যায়ে থাকে না কিংবা তার মানসিক একটা বিপর্যয়কর অবস্থা পরিলক্ষিত হয়। মাদকে আসক্ত হবার শুরুর দিকে পরিবারের সদস্যরা সাধারণত চেষ্টা করে বিষয়টাকে বড় কিছু মনে না করে এড়িয়ে যেতে। ভাবে যে ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে যাবে অর্থাৎ মাদকে আসক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকবে। সে ব্যাপারে অবশ্য তাকে অনুপ্রাণিত করা হতো।

কিন্তু যখন পরিবারের সেই সদস্যটি ভয়াবহ রকমভাবে মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে তখন সে জীবনের একমাত্র লক্ষ্য উদ্দেশ্য বলতে মাদক সংগ্রহ করাকেই বুঝতে থাকে। মাদককেই সে জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে ভাবে। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভাববার অবকাশ তার আর থাকে না। সুতরাং পরিবারের সঙ্গে দূরত্ব বেড়ে যেতে থাকে। এরকম একটা অবস্থায় মাদকাসক্ত ব্যক্তি এবং মাদকের মাঝে সম্পর্ক প্রকৃত অর্থেই  পারিবারিক সংকটে পরিণত হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা হয়তো তখন একটা পরিবর্তন টের পায় কিন্তু পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না প্রকৃতপক্ষে কী ঘটতে যাচ্ছে। তারা বড় জোর বুঝতে পারে যে ঘর তাদের জন্য আর নিরাপদ রইলো না। ঘর হয়ে পড়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, অশান্তি আর নিরাপত্তাহীনতায় পরিপূর্ণ। আর পরিবারের মাদকাসক্ত সদস্যটি এখন হয়ে পড়েছে অচেনা,উগ্র, অসম্ভব ক্লান্ত ও অক্ষম। পরিবারের কারো সাথেই আর তার কোনোরকম আড্ডা, পরামর্শ, কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না।     

মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবারে নি:সঙ্গ হয়ে পড়া প্রসঙ্গে বলছিলাম। আসক্ত ব্যক্তির পরিবারের প্রতিটি সদস্যও মাদকে আসক্ত হয়ে পড়া সদস্যের আচার আচরণ এবং তার ব্যক্তিত্বের ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে একটু সচেতন প্রতিক্রিয়া দেখায়। এটা খুবই সচেতনভাবে দেখাতে হয় যেন আসক্ত ব্যক্তির সম্ভাব্য পরিণতি থেকে তার অজান্তেই তাকে রক্ষা করা যেতে পারে। পরিবারের সবাই যখন তার সঙ্গে একইরকমের আচরণ করতে থাকে তখন দেখা যায় ওই পরিবারের স্বভাব চরিত্রের অংশ হয়ে দাঁড়ায় ওরকম আচরণ। বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে যারা মাদকাসক্ত নয়, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা বাধ্য হয় নিজের কিংবা পরিবারের অপরাপর সদস্যের প্রয়োজনীয়তা বা চাওয়া পাওয়াগুলোকে আসক্ত সদস্যের কারণে উপেক্ষা করতে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পরিবারের সদস্যদের মাঝে যেন কোনোরকম ঝগড়া বিবাদ না লাগে সেজন্য পরিবারের মাদকাসক্ত সদস্যের বিরক্তিকর আচরণগুলোকে কষ্ট করে হলেও সহ্য করে যেতে হয়। কিছুই করার থাকে না।

অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় আসক্ত ব্যক্তির পরিবার বেশিরভাগ সময়ই রোগীর বৈশিষ্ট্যানুগ আচরণ করে মানে অনেকটা রোগীর সন্তোষজনক আচরণ করে। ঘরের অন্যান্য সদস্যরা পরিবারের টিকে থাকার প্রয়োজনে এই যে তাদের ওপর একরকম আরোপিত ভূমিকাগুলোকে মেনে নিতে বাধ্য হয় সেটা যে আসলে হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায় সে কথা কেউ খেয়াল করে না। পরিবারের সদস্যরা রোগীর অনুকূল আচরণ নিয়মিত চালিয়ে যাবার ফলে আসক্ত ব্যক্তিকে তার বিকারগ্রস্ত আচরণ অব্যাহত রাখতে সাহায্য করে। একটি পরিবারের মঙ্গল ও কল্যাণের জন্য পরিবারের অভ্যন্তরে সাধারণত কিছু নিয়ম নীতি মেনে চলতে হয়। পরিবারের কোনো সদস্য মাদকাসক্ত হয়ে পড়ার আগে এইসব নীতিমালাই নিরাপত্তা ও সংকট মোকাবেলায় সহযোগিতা করতো। কিন্তু বিকারগ্রস্তের অনুকূল আচরণের ফলে ওইসব নীতিমালা পাল্টে যায় এবং নতুন একটি নীতিমালা তার স্থলাভিষিক্ত হয়ে পড়ে।                            

নতুন নীতিমালার কথা বলছিলাম। এইসব নীতিমালা প্রকৃতপক্ষে বাধ্য হয়ে কিংবা বলা যেতে পারে পারিবারিক ঐতিহ্য রক্ষার স্বার্থেই প্রণয়ন করা হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারটির কল্যাণেই বাধ্য হয়ে মেনে নিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে যে, নতুন নিয়মনীতির ফলে মাদকাসক্তের স্ত্রীর

ওপর স্বাভাবিকভাবেই দায়িত্ব বর্তায় তার স্বামীর ওপর পরিবারের যেসব দায়-দায়িত্ব ছিল সেগুলো পালন করা। বলা যায় স্ত্রী এই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনে বাধ্য হয়ে পড়েন। যে পরিবারে বাবা এবং মা দুজনই মাদকাসক্ত সেই পরিবারের দায়-দায়িত্ব বড় সন্তানের ওপর বর্তায়। এ বিষয়টি অন্যান্য সদস্যের জন্য হয়ত কখনো কখনো বিরক্তির কারণ হয়ে উঠতে পারে, তারপরও প্রকৃত সত্য হলো এটাই পরিবারের অলিখিত নিয়ম।

মনে রাখতে হবে এইসব নিয়মনীতির বেশিরভাগই মাদকে আসক্তির কারণে পারিবারিক শৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে করা হয়। এসবের যথাযথ প্রয়োগ না হলে ওই পরিবারে আর শান্তি শৃঙ্খলা থাকবে না, বিচিত্র অশুভ পরিণীত বয়ে আসতে পারে। এরকম দুর্বিষহ কোনো পরিণতি না হোক কোনো পরিবারে সেই প্রত্যাশা করছি আমরা। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২৬

খবরসহ আমাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত সব লেখা ফেসবুকে পেতে এখানে ক্লিক করুন এবং নোটিফিকেশনের জন্য লাইক দিন 

ট্যাগ