ইরানি পণ্য সামগ্রী: ভেষজ উদ্ভিদ এবং তার বিচিত্র ঔষধি গুণাবলি
গত আসরে আমরা ভেষজ উদ্ভিদ নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। ভেষজ উদ্ভিদ প্রকৃতির দান। মানব রোগ-ব্যাধির চিকিৎসায় সেই প্রাচীনকাল থেকেই এই ভেষজ উদ্ভিদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল এবং এখন আছে। বিচিত্র ঔষধি উদ্ভিদের জন্য ইরান অন্যতম একটি প্রধান কেন্দ্র।
আরও বলেছিলাম যে, আদিকালের মানুষেরা ঔষধি উদ্ভিদের গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন হয়ে শরীর ও আত্মার প্রশান্তির জন্য, মানুষের দু:খ, ব্যথা-বেদনা দূর করার জন্য সেগুলোকে ব্যবহার করতো। তাদের সেই অভিজ্ঞতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্থানান্তরিত হয় এবং ভেষজ গুণ ও তার ইতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জানাশোনার পরিধি ব্যাপক থেকে ব্যাপকতর হয়। যাই হোক, ভেষজ উদ্ভিদ এবং তার বিচিত্র ঔষধি গুণাবলি নিয়ে আমরা আজকের আসরেও আরও কিছু কথা বলার চেষ্টা করবো।
ইরানে ভেষজ উদ্ভিদ ব্যবহারের ইতিহাস বেশ প্রাচীন। বলা যেতে পারে যে ইরানের চিকিৎসা পদ্ধতির মূলে সবসময় ছিল ভেষজ চিকিৎসা ব্যবস্থা বা পিথোথেরাপি। এতো প্রাচীনকাল থেকে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা চালু ছিল যে জরথ্রুস্টদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আবেস্তাতেও ভেষজ চিকিৎসা ব্যবস্থা বা পিথোথেরাপির প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়েছে। আবেস্তা ছয় হাজার পাঁচ শ বছর আগের একটি গ্রন্থ। ওই গ্রন্থেই প্রথমবারের মতো ইরানের প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ইরানে প্রাচীনকালে বিশ্বাস করা হতো যে জরথ্রুস্ট ধর্মে এবং তার পরবর্তী ইরানি সংস্কৃতি ও পুরাণে 'হুম' নামের একটি উদ্ভিদকে খুবই পবিত্র মনে করা হত। ইংরেজিতে এই ভেষজটিকে 'হাওমা' বলা হয়। পাহলাভিদের গ্রন্থেও এই হাওমা প্রসঙ্গে লেখা হয়েছে। বলা হয়েছে যে উদ্ভিদের রাজা হলো হাওমা। এই উদ্ভিদটি অমরত্ব লাভ করা মানে দীর্ঘ জীবন লাভ করার জন্য ব্যবহার করা হত।

পরবর্তীকালে ইসলামের আবির্ভাব এবং ইসলামি সভ্যতার সূচনায় বড় বড় মনীষীরা চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে ব্যাপক চেষ্টা প্রচেষ্টা চালায়। বিশেষ করে বোখতিশু পরিবার, রাজি, ইবনে সিনা, আবু রেইহান বিরুনি, জোরজানি এবং হেরাভির মতো বিখ্যাত মনীষীরা চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে এতো বেশি তৎপরতা চালিয়েছেন যে বিশ্ববাসীর কাছে তাদের নাম আজও সুপরিচিত হয়ে আছে। আজও ইরান ভৌগোলিক অবস্থানগত দিক থেকে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকার কারণে উদ্ভিদ বৈচিত্র্যে ভেষজ ভূগোলে অনন্য সাধারণ একটি নাম। আবহাওয়াগত আনুকূল্যের কারণেও ভেষজ উদ্ভিদ বিশেষ করে ঔষধি উদ্ভিদের একটি সমৃদ্ধি ভাণ্ডারে পরিণত হয়েছে ইরান। সমগ্র বিশ্বেই ঔষধি উদ্ভিদের জন্য ইরান একটি বিশেষ দেশের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।
জলীয় বাষ্প, কুয়াশা, মেঘ, ঝড়, বৃষ্টি, শিলাবৃষ্টি, বজ্রপাত, তুষারপাত, উষ্ণতা ইত্যাদি বিবেচনায় বিশ্বে এখন পর্যন্ত তেরো রকমের আবহাওয়া মণ্ডল শনাক্ত করা হয়েছে। যার মধ্যে এগারোটি আবহাওয়ামণ্ডল রয়েছে ইরানে। এ কারণে ইরানে বিচিত্র উদ্ভিদের সমৃদ্ধি লক্ষ্য করা যায়। উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের গবেষণা অনুযায়ী আট হাজার রকমের উদ্ভিদ রয়েছে ইরানে। ইউরোপের তুলনায় ইরানের উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ। এসব উদ্ভিদের মধ্যে প্রায় দুই হাজার প্রজাতির উদ্ভিদ মশলা, ঔষধ, সুগন্ধি, প্রসাধনী ইত্যাদির কাজে ব্যবহৃত হয়।
ইরানের বিভিন্ন এলাকায় ঔষধি উদ্ভিদ বেশি পাওয়া যায়। এসব এলাকার মধ্যে রয়েছে কুর্দিস্তান প্রদেশ, লোরেস্তান প্রদেশ, হামেদান প্রদেশ, চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশ, কোহকিলুইয়ে ওয়া বুয়ের আহমাদ প্রদেশ, গিলানসহ আরও অনেক এলাকা। এসব এলাকায় ঔষধি উদ্ভিদ একটু বেশি উৎপন্ন হয়। খোরাসানে রাজাভি এবং দক্ষিণ খোরাসানে জাফরানের মতো মূল্যবান ঔষধি উদ্ভিদ প্রচুর পরিমাণে উৎপন্ন হয়। ইরানের প্রায় নব্বুই শতাংশ জাফরান উৎপন্ন হয় এই দুই প্রদেশে। ইরানের শতকরা পঁচাশি ভাগ গোলাপ উৎপন্ন হয় ফার্স, কেরমান, ইস্ফাহান এবং পূর্ব আজারবাইজান প্রদেশে। এভাবে জিরা, সবুজ জিরা, মেহেদি, ধনিয়াসহ মশলাজাতীয় প্রায় সত্তর ভাগ উদ্ভিদ উৎপন্ন হয় খোরাসানে রাজাভি, দক্ষিণ খোরাসান, কেরমান, হামেদান এবং গিলান প্রদেশে।
ভেষজ চিকিৎসা জগতে ইরানে এখন দেড় শ'রও বেশি কোম্পানি কাজ করে যাচ্ছে। ভেষজ ঔষধ এবং ভেষজ নির্যাস তৈরিতেও বিভিন্ন কোম্পানি নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এগুলো চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হয়। আলজেইমার চিকিৎসা, শিশুদের দাঁতের মাড়ির চিকিৎসা, পুড়ে যাওয়ার চিকিৎসা, কিডনির পাথরের চিকিৎসা, জখম, ডায়াবেটিসসহ আরও বিচিত্র রোগের চিকিৎসায় এসব ঔষধ ব্যবহার হচ্ছে। মেলিত্রোপিক নামে একটি ঔষধ তৈরি করেছে ইরানের বিজ্ঞানীরা। এই ঔষধটি আলজেইমার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ইরানি গবেষকদের প্রথম উদ্ভাবন এই ভেষজ ঔষধটি। উরতিকা জেড-বি নামের একটি ঔষধও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই ঔষধটি ব্যবহার করা হয় কিডনির পাথর চিকিৎসার কাজে।
ইরানে যেহেতু বিচিত্র উদ্ভিদের ভাণ্ডার সেজন্য উদ্ভিদ বিজ্ঞান নিয়ে যারা পড়ালেখা করে বা গবেষণা করে তাদের জন্য রয়েছে ব্যাপক সুযোগ। এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য গবেষক ইরান এসে তাদের গবেষণা কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই গবেষণা কাজের সুবিধার্থে ইরানে গড়ে উঠেছে অসংখ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠানও। গবেষকদের গবেষণালব্ধ বিচিত্র ভেষজ ঔষধ ইরানের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি এখন দেশের বাইরেও রপ্তানি করা হচ্ছে। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ০৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।