সুরা কিয়ামাতের কয়েকটি আয়াতের ব্যাখ্যা
সুরা কিয়ামাতের ষষ্ঠ আয়াত থেকে ১৩ নম্বর আয়াতে কিয়ামত বা বিচার দিবস সম্পর্কে বক্তব্য রয়েছে।
এই বাক্যগুলোতে মহান আল্লাহ বলছেন:
(৬) সে প্রশ্ন করে, কখন কিয়ামত দিবস সমাগত হবে? (৭) যখন চোখ আতঙ্কে চমকে যাবে বা স্থির হয়ে যাবে। (৮) এবং চাঁদ জ্যোতিহীন হয়ে পড়বে। (৯) এবং সূর্য ও চাঁদকে একত্র করা হবে। (১০) সেদিন মানুষ বলবে, ‘আজ পালানোর স্থান কোথায়?’ (১) না, কখনও এমন নয়, কোনো আশ্রয়স্থলই নেই! (১২) সেদিন কেবল তোমার প্রতিপালকের কাছে ঠাঁই হবে। (১৩) সেদিন মানুষকে জানানো হবে সে অগ্রে ও পশ্চাতে কী করেছিল।
সুরা কিয়ামাতের সাত থেকে নবম আয়াতে কিয়ামত সংঘটনের দিন বা তারিখ সম্পর্কে প্রশ্নের জবাব রয়েছে। প্রথমে কিয়ামত বা পুনরুত্থানের আগে যেসব ঘটনা ঘটবে সে বিষয়ে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। এরপর বলা হয়েছে যে সেদিন মানুষ এত বেশি ভীত-সন্ত্রস্ত হবে যে চোখ বা দৃষ্টিগুলো হয়ে পড়বে অস্বাভাবিক এবং চাঁদ হয়ে পড়বে আলোহীন এবং সূর্য ও চাঁদ পরস্পর মিশে এক হয়ে যাবে। সম্ভবত চাঁদ সূর্যের আকর্ষণে ক্রমেই সূর্যের কাছে চলে আসবে এবং অবশেষে এ দুইই এক হয়ে অনুজ্জ্বল ও আলোহীন হয়ে পড়বে। ফলে গোটা পৃথিবী ভয়াবহ অন্ধকারে ছেয়ে যাবে! এভাবে শিঙ্গায় প্রথম ফুঁকের পরিণতিতে এত ব্যাপক ও আমূল পরিবর্তন ঘটে যাবে দুনিয়ায় এবং অবসান ঘটবে বিশ্বের। এরপর দ্বিতীয় ফুঁকে ঘটবে মানুষের পুনরুত্থান। সেদিন কিয়ামতের প্রতি অবিশ্বাসী কাফির ও পাপীরা ভীষণ আতঙ্কে আশ্রয়-স্থলের সন্ধান করবে এবং পাপী হওয়ার কারণে শাস্তি এড়াতে পালানোর পথ খুঁজতে থাকবে। তারা বলবে: পালানোর পথ কোথায়? কিন্তু তাদের বলা হবে: তোমরা কখনও পালানোর পথ ও আশ্রয় খুঁজে পাবে না! সেদিন চূড়ান্ত আশ্রয় কেবলই মহান আল্লাহ তথা তোমাদের প্রভু ও প্রতিপালক। তাই তার দিকেই সবাইকে ফিরতে হবে। সেদিন মানুষ যা যা করেছে তার সবই দেখানো হবে।

সুরা কিয়ামাতের এর পরের কয়েকটি আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: (১৪) বরং মানুষ স্বয়ং নিজের অবস্থা সম্পর্কে সম্যক চক্ষুস্মান বা অবগত। (১৫) যদিও সে ওজর-আপত্তি উপস্থাপন করে। (১৬) হে রাসূল! কুরআনের প্রতি তোমার জিহ্বা সঞ্চালন কোরোনা তা দ্রুত আয়ত্ত করার জন্য। (১৭) এ কারণে যে, এটা সঙ্কলন ও পাঠ করানোর দায়িত্ব আমাদেরই, (১৮) সুতরাং আমরা যখন তা পাঠ করব তখন তুমি সেই পাঠের অনুসরণ কর। (১৯) অতঃপর এর বিশদ ব্যাখ্যার দায়িত্ব আমারই। -
কারো কারো মতে এখানে বলা হচ্ছে যে, আসল কাজ হল অন্তরেই কুরআনকে সঙ্কলন করা, এরপর তা পাঠ করা, অন্যথায় হৃদয় কুরআন থেকে শূন্য থাকলে এবং শুধু মুখে আবৃত্তি করলে তার কোন উপকারিতা নেই। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে এ ব্যাপারে সচেতন করার জন্য রাসূলকে সম্বোধন করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, শুধু তিলাওয়াত বা আবৃত্তি ও মুখস্ত করার কোন মূল্য নেই যতক্ষণ না অন্তঃকরণের গভীরতায় এর উদ্দেশ্য ও মর্মের স্থান হবে এবং মানুষ এর থেকে পুরোপুরি ফায়দা লাভ করবে।
সুরা কিয়ামাতের পরের কয়েকটি আয়াতে মহান আল্লাহ বলছেন: (২০) কখনও তেমন নয় ! যেমনটি হে অবিশ্বাসীরা তোমরা মনে কর, বরং তোমরা ত্বড়িৎলভ্যকে তথা পার্থিব জগতকে ভালবাস। (২১) এবং পরকালকে উপেক্ষা কর। (২২) সেদিন কোনো কোনো মুখমণ্ডল উজ্জ্বল হবে। (২৩) তারা তথা মুখমন্ডলগুলো তাদের প্রতিপালকের নিয়ামতগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবে বা প্রতিপালকের আদেশের প্রতীক্ষায় থাকবে।-
কারো কারো মতে এখানে বলা হচ্ছে: যেহেতু মানুষের দৃষ্টি মহান আল্লাহর নাগাল পেতে পারে না (সূরা আনআম:১০৩) তাই ‘তাদের প্রতিপালকের দিকে তাকিয়ে থাকবে’ না বলে ‘তাদের প্রতিপালকের নিয়ামতগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকবে’ বলে কুরআনে উল্লেখ করা হয়েছে। আয়াতটিতে ‘নাযিরাহ’ শব্দটির অর্থ যেমন দৃষ্টি নিবদ্ধকারী হতে পারে তেমনি প্রতীক্ষাকারীও হতে পারে যেরূপ সূরা আহযাবের ৫৩ নং আয়াতে এ অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে। সেক্ষেত্রে আয়াতের অর্থ হবে ‘তারা তাদের প্রতিপালকের আদেশের প্রতীক্ষায় থাকবে।’ তবে লক্ষণীয় যে, আয়াতে দর্শনের বিষয়টি মুখমণ্ডলের ওপর আরোপ করা হয়েছে চক্ষুর ওপর নয়, যা থেকে বোঝা যায় প্রতিক্ষাকারী অর্থই বেশি যৌক্তিক, তবে প্রচলিত অর্থ গ্রহণ করলেও চলে।
সুরা কিয়ামাতের একাংশে বলা হচ্ছে যে কিয়ামতের দিন মুমিন ও সৎকর্মশীলরা হবেন প্রফুল্ল ও আনন্দে উচ্ছ্বল। তারা মহান আল্লাহর নেয়ামতের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ ও অভিভূত হবেন। অন্যদিকে কাফিররা হবে ভীষণ মলিন, বিমর্ষ ও উদাস। অবর্ণনীয় মাত্রার কঠোর শাস্তির লক্ষণগুলোর দিকে তাকিয়ে তারা হবে পেরেশান ও দুঃখিত।
সুরা কিয়ামাতের ২৬ নম্বর আয়াতে মৃত্যুর যন্ত্রণাদায়ক সময়ের ছবি তুলে ধরা হয়েছে। অবশ্য পার্থিব জগত থেকে পরকালে যাওয়ার সময়টি মুমিনদের জন্য হবে সহজ। ইমাম জাফর সাদিকের (আ) মতে মৃত্যু মুমিনের জন্য সুগন্ধ উপভোগের মত ও ঘুমিয়ে পড়ার অবস্থার মত। ফলে ব্যথা ও যন্ত্রণার কোনো অনুভূতি থাকে না। অন্যদিকে মৃত্যু কাফিরদের জন্য বিষাক্ত সরিসৃপ ও বৃশ্চিকের কামড়ের যন্ত্রণা বা তার চেয়েও বেশি যন্ত্রণাদায়ক।
মরণের দ্বারপ্রান্তে পাপী ও কাফিররা শাস্তির লক্ষণগুলো দেখতে থাকে ও এ সময় তারা ঈমান আনবে। কিন্তু তাতে কখনও কোনো লাভ নেই। এ সময় তাদের আশপাশের ব্যক্তিরা এই কাফিরদের মুক্তির জন্য পেরেশান হয়ে বলে: এই রোগীকে রক্ষার জন্য কে আছে ঝাড়-ফুঁককারী?
মহান আল্লাহ এ প্রসঙ্গে আরও বলছেন: তখন তার প্রত্যয় হবে যে, এটাই সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময়। (২৯) এবং পায়ের সঙ্গে পা জড়িয়ে যাবে তথা বিপদের পর বিপদ এসে পড়বে। (৩০) আজ সকলকে তোমার প্রতিপালকের কাছে প্রত্যানীত করা হবে।-
মোট কথা প্রত্যেক মানুষকে ফিরে যেতে হবে আল্লাহর কাছে।
সুরা কিয়ামাতের এরপরের দুই আয়াতে বলা হয়েছে:
(৩১) সে না আল্লাহর বাণীতে বিশ্বাস করেছিল, আর না নামায আদায় করেছিল। (৩২) বরং সে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেছিল ও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল।
মুফাসসিরদের বর্ণনানুযায়ী আয়াতটি ইসলামের চিরশত্রু আবু জাহল সম্পর্কে অবতীর্ণ হয়েছিল। সে না মহানবীর (সা.) বক্তব্য সমর্থন করত, আর না নামায পড়ত; বরং সর্বদা তাঁকে বিদ্রুপ করত। এমনকি তিনি তার হাত ধরে বলে দিয়েছিলেন, ‘তোমার জন্য আযাবের পর আযাব এবং চিরস্থায়ী জাহান্নাম।’ তা সত্ত্বেও তার মনের ওপর এর কোন প্রভাবই পড়েনি।
সুরা কিয়ামাতের ৩৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে: মানুষ কি মনে করে যে, তাকে এমনি ছেড়ে দেয়া হবে কোনো লক্ষ্য ছাড়াই ?-
এ বিশ্বজগতকে মানুষের জন্য সৃষ্টি করেছেন যে মহান আল্লাহ তিনি কি করে মানুষকে বিনা উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করতে পারেন? মানুষ ছিল মায়ের গর্ভে স্থাপিত স্খলিত বীর্য। এর পরে রক্তপিণ্ড করে তা থেকে মানুষকে সৃষ্টি করে সুবিন্যস্ত করা হয় এবং এ থেকে যুগল নর-নারী সৃষ্টি করা হয়েছে। মহান আল্লাহ এ-সবই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন সুরা কিয়ামাতের শেষ ভাগে। মহাশিল্পী ও সর্বশক্তিমান আল্লাহ সামান্য নাপাক পানি থেকে সুন্দর ও সুঠাম মানুষ বানান। তাই তিনি কি মৃত মানুষকে জীবিত করতে সক্ষম নন? এ সুরার শেষ আয়াতে আল্লাহ বলছেন: তবুও কি সেই আল্লাহ মৃতদেরকে জীবিত করতে সক্ষম নন?#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৮
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।