সেপ্টেম্বর ০১, ২০১৯ ১৮:৩৪ Asia/Dhaka

কারবালার মর্মবিদারী ঘটনা মানব ইতিহাসের এমন এক বিস্ময়কর ঘটনা, যার সামনে বিশ্বের মহান চিন্তাবিদরা থমকে গিয়ে পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে স্তুতি-বন্দনায় মুখরিত হয়েছেন এই নজিরবিহীন আত্মত্যাগের।

কারণ, কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের মহানায়করা 'অপমান আমাদের সয় না” -এই শ্লোগান দিয়ে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংখ্যায় হাতে গোনা জনাকয়েক হওয়া সত্ত্বেও খোদায়ী প্রেম ও শৌর্যে পূর্ণ টগবগে অন্তর নিয়ে জিহাদ ও শাহাদাতের ময়দানে এসে প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার অন্ধকার জগতকে পেছনে ফেলে উর্দ্ধজগতে মহান আল্লাহর সনে পাড়ি জমান। তাঁরা নিজ কথা ও কাজ দিয়ে জগতবাসীকে জানিয়ে দিয়ে যান যে,‘‘ যে মৃত্যু সত্যের পথে হয়,তা মধূর চেয়েও সুধাময়।’’

কারবালার মহাবিপ্লব বিশ্বের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে অবিস্মরণীয়। এই মহাট্র্যাজেডির পরিবেশ ও পটভূমি লুকিয়ে ছিল আরব গোত্রগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দ্বন্দ্বের মধ্যে। মহানবী (সা) নিজে ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র তথা হাশেমি গোত্রের। হযরত ইব্রাহিম (আ)'র বংশধারা হতে আসা এ গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কাবা ঘরের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী ছিলেন।  মহানবীর (সা) দাদা আবদুল মোত্তালেব ও পরবর্তীতে আবুতালিব একই কারণে বিশেষ সম্মানের অধিকারী ছিলেন।  পরবর্তীকালে মহানবী (সা) মহান আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল (সা) হিসেবে আরব বিশ্বে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। আর মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত আলী (আ) এবং হযরত ফাতিমা জাহরার (সালামুল্লাহি আলাইহা) সন্তান হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইনও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হওয়ায় গোত্রবাদী ইর্ষায় আক্রান্ত হয়েছিল অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই হাশেমি বংশের মোকাবেলায় কুরাইশ বংশের অন্য গোত্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক জোরালো হয়ে উঠেছিল। আর এ অবস্থা থেকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সক্ষম হয়েছিল উমাইয়া বংশ। 

উমাইয়াদের উত্থানের সুবাদে এ বংশের প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব ও এক সময় ইসলামের চরম শত্রু হিসেবে কুখ্যাত আবু সুফিয়ানের ছেলে আমির মুয়াবিয়া ছলে বলে কৌশলে মুসলমানদের ওপর ক্ষমতাসীন হতে সক্ষম হয়। এরপর আমির মুয়াবিয়ার সৃষ্ট রাজতান্ত্রিকতাকেই ইসলামের লেবাস পরিয়ে ইসলামকে চিরতরে নির্মূলের যে ষড়যন্ত্র করেছিল ইয়াজিদের নেতৃত্বাধীন মুনাফিক উমাইয়ারা তার বিরুদ্ধে পাহাড়ের মত বাধা হয়ে দাঁড়ান মহানবীর (সা) দৌহিত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ)। আমির মুয়াবিয়া জীবিত থাকতেই তারই নির্দেশে ইয়াজিদের পক্ষে আগাম বাইয়াত নেয়ার কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ)'র মত শতভাগ নীতি-পরায়ন নিষ্পাপ ইমামের পক্ষে ইয়াজিদের মত চরিত্রহীন ও কুলাঙ্গার ব্যক্তিকে খলিফা হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না। অন্যদিকে ইরাকের অধিবাসীরা ইমাম হুসাইন (আ)-কে মুসলমানদের নেতা বা খলিফা মনে করত। তারা ইমামকে কুফায় আসার আমন্ত্রণ জানায় যাতে সেখান থেকে  ন্যায়বিচার-ভিত্তিক ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় এবং উমাইয়া জুলুমশাহীর শোষণ ও নির্যাতন থেকে জনগণ মুক্তি পায়।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ) ইরাকিদের ও বিশেষ করে কুফাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। তবে কুফাবাসী আমন্ত্রণ না জানালেও তিনি কুলাঙ্গার ইয়াজিদের নেতৃত্ব কখনও মেনে নিতেন না। কুফাবাসীদের চিত্তের দুর্বলতা সম্পর্কেও অবহিত ছিলেন ইমাম হুসাইন (আ)। তাই সেখানকার জনগণের মনোভাব বোঝার জন্য তিনি প্রথমে সেখানে পাঠিয়েছিলেন নিজের চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে। আকিল প্রথম যখন সেখানে যান তখন স্থানীয় জনগণ তাকে বিপুল সম্বর্ধনা দিয়ে বরণ করে নেয়। কিন্তু ইয়াজিদের গভর্নর ইবনে জিয়াদ ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন শুরু করায় পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায় এবং মুসলিম ইবনে আকিল অসহায় অবস্থায় একাই প্রতিরোধ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত শহীদ হন। মুসলিম ইবনে আকিলের শহাদাতের খবর শুনে ইমাম অত্যন্ত শোকাহত হলেও তাঁর বিপ্লবী মিশন তথা কুফাগামী যাত্রা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু কুফায় পৌঁছার পথে কারবালা নামক অঞ্চলে ইবনে জিয়াদের বাহিনীর মাধ্যমে অবরুদ্ধ হয় ইমামের কাফেলা। সেখানে ইমামকে ইয়াজিদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়া হয় যে হয় তিনি ইয়াজিদের নেতৃত্ব মেনে নেবেন অথবা তাকে মৃত্যু বেছে নিতে হবে।

ইমাম হুসাইন (আ) প্রথম থেকেই জানতেন যে তাঁর শাহাদাত ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জাগিয়ে তোলা সম্ভব হবে না। তাই তিনি আপোষ বা সন্ধির দিকে না গিয়ে মুষ্টিমেয় সঙ্গী-সাথীসহ অসম এক যুদ্ধে জড়িয়ে ত্যাগ ও বীরত্বের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ইমামের সঙ্গীরা বীরত্ব ও সততার সঙ্গে  সংগ্রাম করে ইসলামের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন। ইয়াজিদের অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত করেননি বলে ইমামের কাফেলা ও সঙ্গীদেরকে ফোরাতের পানি থেকেও বঞ্চিত করেছিল নির্দয় ও নৃশংস পাশবিক চিত্তের ইয়াজিদ বাহিনী। ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য পিপাসার্ত অবস্থায় এমন নৃশংসভাবে শহীদ হন যে বিশ্বের ইতিহাসে এমনসব নিষ্ঠুরতার কোনো তুলনা নেই। বিখ্যাত ঐতিহাসিক গীবন কারবালার এই ঘটনার করুণ ও মর্মান্তিক অবস্থা প্রসঙ্গে লিখেছেন, সেই সুদূর অতীতের সেই করুণ পরিবেশে ইমাম হুসাইনের শাহাদতের ঘটনা ছিল এতই ট্র্যাজিক যে তা সবচেয়ে কঠিন হৃদয়ের অধিকারী পাঠকের মনেও ইমামের জন্য সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে। #

পার্সটুডে/এমএএইচ/মো.আবুসাঈদ/০১

ট্যাগ