ডিসেম্বর ১১, ২০১৯ ১৭:২১ Asia/Dhaka

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) ২৩২ হিজরি সালে বর্তমান ইরাকের সামেরা শহরে জন্মগ্রহণ করেন।

তাঁর পিতা হযরত হাদি (আ.)’র মতো মাতা ‘বিবি হাদিসা’ও ছিলেন একজন মুত্তাকি ও পরহেজগার রমণী। মুসলমানদের এগারতম ইমাম ‘আসকার’ নামক মহল্লায় বসবাস করতেন বলে তিনি ইমাম আসকারি নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন।  ‘যাকি’ ও ‘নাকি’ ছিল তাঁর আরো দু’টি উপাধি এবং এই দু’টি নামেরই অর্থ পবিত্র ও বিশুদ্ধ আত্মার অধিকারী। ইমাম হাদি (আ.)’র নির্মম শাহাদাতের পর ২২ বছর বয়সে ইমামতের মহান দায়িত্ব গ্রহণ করেন হযরত আসকারি (আ.)। দুঃখজনকভাবে তিনি বেশিদিন মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দিতে পারেননি বরং তাঁর ইমামতের সময়কাল ছিল মাত্র ছয় বছর।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) ২৬০ হিজরিতে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তৎকালীন নিষ্ঠুর আব্বাসীয় শাসক মু’তামেদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাতবরণ করেন। শাহাদাতের সময় তিনি নিজের একমাত্র সন্তান এবং ইমামতের পবিত্র ধারার সর্বশেষ নক্ষত্র হযরত হুজ্জাত ইবনুল হাসান আল মাহদি (আ.)কে রেখে যান। এই ইমাম যেদিন গোপনীয়তার বেড়াজাল ভেঙে মানব সমাজে আবির্ভূত হবেন সেদিন গোটা দুনিয়া ন্যায়বিচারে পরিপূর্ণ হয়ে উঠবে।

ইমাম হাসান আসকারি (আ.) সম্পর্কে মালিকি মাজহাবের প্রখ্যাত আলেম ইবনে সাব্বাগ মালিকি লিখেছেন: তাঁর মধ্যে সমস্ত উন্নত ও মহান গুণাবলীর সমন্বয় ঘটেছিল। ইমামত ও নেতৃত্বের দায়িত্ব পরিচালনার জন্য যতগুলো মানবীয় গুণ প্রয়োজন তার সবগুলোরই সমাহার ঘটেছিল তাঁর চরিত্রে।  

শুধু আলেমরাই নন, ইতিহাসে এসেছে, তৎকালীন আব্বাসীয় শাসক মুতাওয়াক্কিলের উজির আহমাদ বিন আব্দুল্লাহ খাকান ছিল একজন দাম্ভিক ও স্বেচ্ছাচারী ব্যক্তি যে কিনা ছিল নবী বংশের চরম শত্রু। এই ব্যক্তি ইমাম আসকারি সম্পর্কে বলেছেন: তিনি একাধারে ছিলেন আলেম, মুত্তাকি, পরহেজগার, লজ্জাশীল, পবিত্র ও সম্মানিত ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তাঁর ব্যক্তিত্বে খলিফা, উজির ও দরবারের পারিষদবর্গও মুগ্ধ ছিল। 

খাকান আরো বলেন, আমার ছেলেবেলায় আমার পিতা ছিলেন রাজদরবারের প্রভাবশালী একজন পারিষদ। একদিন তাকে কেউ এসে খবর দিল ইবনুর রেজা (অর্থাৎ ইমাম আসকারি) এসেছেন। আমার পিতা দৌড়ে উঠে গিয়ে তাঁকে স্বাগত জানান এবং তাঁর হাতে চুমু খান। এরপর তাঁকে উঁচু স্থানে বসিয়ে নিজে তাঁর পায়ের কাছে বসে পড়েন। তিনি চলে যাওয়ার পর পিতার কাছে আমি জিজ্ঞাসা করি, উনি কে ছিলেন? উত্তরে আমার পিতা বলেন, এই পৃথিবীতে খলিফা হওয়ার জন্য তাঁর মতো যোগ্য দ্বিতীয় আর কেউ নেই। তিনি উন্নততম মানবীয় গুণাবলীর অধিকারী একজন মানুষ। এক কথায় বলতে গেলে তিনি একজন পরিপূর্ণ মানুষ এবং তাঁর পিতাও ছিলেন একজন ইনসানে কামেল।

ইমামদের এই উন্নত গুণাবলী ছিল তাঁদের প্রতি মহান আল্লাহর বিশেষ অনুগ্রহ। এ সম্পর্কে ইমাম হাসান আসকারি (আ.) নিজে বলেন: আমরা তাদের জন্য আশ্রয়স্থল যারা আমাদের কাছে আশ্রয় চায় এবং তাদের জন্য আমরা আলোকবর্তিকা যারা আমাদের আলোয় জীবন আলোকিত করতে চায়।  যারা আমাদেরকে ভালোবাসে তারা অনেক বড় সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী হয় এবং যারা আমাদের প্রদর্শিত পথ থেকে বিচ্যুত হয় তারা প্রকারান্তরে জাহান্নামের দিকেই ধাবিত হয়।

বন্ধুরা! আমরা আগের আলোচনাগুলোতে বলেছি যে, নবী বংশের ইমামগণ মুসলিম উম্মাহকে নেতৃত্ব দেয়ার গুরুদায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে শাহাদাতের আগে নিজেদের স্থলাভিষিক্তের নাম ঘোষণা করে যেতেন। আমরা এও বলেছি, অনেক ইমাম তাদের স্থলাভিষিক্তের নাম প্রকাশ্যে ঘোষণা করে যেতেন আবার কেউ কেউ রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনুকূলে না থাকায় কাঙ্ক্ষিত ইমামের নাম গোপনে ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের কাছে বলে যেতেন অথবা পরবর্তী ইমামের গুণাবলী বর্ণনা করে যেতেন যাতে সবাই তাঁকে চিনতে পারে। ইমাম হাদি (আ.) নিজের সন্তান ও পরবর্তী নেতা ইমাম হাসান আসকারি সম্পর্কে এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন।

নবী বংশের ইমামগণের অন্যতম ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ও তাঁদের মুখ-নিসৃত হাদিস বর্ণনাকারী আলেম ‘আবুহাশিম জাফারি’  বলেন, আমি একবার ইমাম হাদি (আ.)’র সঙ্গে দেখা করতে যাই। তিনি আমাকে বলেন, আমার পরে আমার সন্তান ‘হাসান’ হবেন তোমাদের ইমাম। এরপর তিনি আরো বলেন, হাসানের পর তার স্থলাভিষিক্ত হবেন আমারও উত্তরাধিকারী। তোমরা তাঁর সঙ্গে কেমন আচরণ করবে? আমি জিজ্ঞাসা করি: হে ইমাম! আপনি এ প্রশ্ন করছেন কেন? ইমাম বলেন: এজন্য জিজ্ঞাসা করলাম যে, তিনি গায়েব বা অদৃশ্য অবস্থায় থাকবেন এবং তাঁকে তার নাম ধরে ডাকা উচিত হবে না কারণ তার নাম হবে বিশ্বনবী (সা.)’র নামে।  এ সময় আমি জিজ্ঞাসা করি: তাহলে আমরা তাকে কিভাবে ডাকব বা কি নামে তাকে স্মরণ করব? জবাবে তিনি বলেন: তোমরা  আল-হুজ্জা মিন আলে মোহাম্মাদ (সা.) নামে তাঁর কথা স্মরণ করবে।  

ইমাম হাদি (আ.)’র ঘনিষ্ঠ সাহাবী সাকার বিন আবি দেল্‌ফ ইমামের একটি বাণী উদ্ধৃত করেছেন যেখানে ইমাম বলেন: আমার পরে আমার স্থলাভিষিক্ত হবেন আমার সন্তান হাসান এবং তারপর তাঁর সন্তান ‘কায়েম’। পৃথিবী জুলুম ও অত্যাচারে পরিপূর্ণ হয়ে গেলেও তিনি সে অবস্থা ভেঙে দিয়ে এই ভূপৃষ্ঠে ন্যায়বিচার ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করবেন।

অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো- নবী বংশের এই সম্মানিত ইমামদের ওপর তৎকালীন মুসলিম সমাজের ওপর চেপে বসা অবৈধ শাসকরা চরম দমনপীড়ন চালিয়েছে।  ইমাম হাসান আসকারি (আ.)কে তিনজন আব্বাসীয় খলিফা অর্থাৎ মুয়াত্তাজ, মাহদি ও মু’তামিদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে।

মুয়াত্তাজের শাসনামলে ইমামের অন্তত ৭০ জন অনুসারীকে বিদ্রোহ করার অপরাধে হিজাজ থেকে বন্দি করে সামেরায় নির্বাসনে পাঠানো হয়। এ সময় ইমাম হাসান আসকারি (আ.)’র কাছে তাঁর অনুসারীরা খলিফার অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় জানতে চেয়ে চিঠি লেখেন। ইমাম হাসান আসকারি এর জবাবে তাদেরকে জানান, তিন দিন পর তোমরা মুয়াত্তাজের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবে। ইমামের এই ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয় এবং তিন দিন পর মুয়াত্তাজের একদল সেনা বিদ্রোহ করে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। বিদ্রোহী সৈন্যরা তাকে একটি কুয়ার মধ্যে নিক্ষেপ করে সেটির মুখ বন্ধ করে দেয়। মুয়াত্তাজ সেই কুয়ার মধ্যে ভবলীলা সাঙ্গ করে।

মুয়াত্তাজের পর মাহদি আব্বাসি ক্ষমতায় আসে। সে প্রথম দিকে নিজেকে ধার্মিক হিসেবে পরিচয় দিলেও কয়েক মাসের মধ্যে আসল মূর্তি ধারণ করে এবং ইমাম হাসান আসকারি (আ.)কে বন্দি করার আদেশ দেয়। খলিফার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার অপরাধে ইমামের অনেক অনুসারীকে গ্রেফতার ও হত্যা করা হয়। কিন্তু মাহদি আব্বাসির শাসনকালও স্থায়ী হয়নি এবং ইমাম হাসান আসকারি (আ.)’র ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী এই জালেম শাসকও একদল বিদ্রোহী সেনার হাতে নিহত হয়।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ