ইরান-ইরাক যুদ্ধের ইতিহাস (৬ পর্ব): খোররামশাহরের পতন ঠেকাতে ইরানিদের অকুতোভয় সংগ্রাম
ইরাকের বাথ সরকারের আগ্রাসনের আগে ‘খোররামশাহর’ ছিল ইরানের একটি গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দর।
খুজিস্তান প্রদেশের আবাদান হচ্ছে ইরানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য নদীবন্দর এবং এই দু’টি বন্দরই ‘আরভান্দ’ নদীর তীরে অবস্থিত। ইরাক-ইরান সীমান্ত দিয়ে প্রবাহিত এই নদীটি পারস্য উপসাগরে গিয়ে পড়েছে। ইরানের খুজিস্তান প্রদেশে হামলা চালানোর পেছনে সাদ্দাম সরকারের অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল খোররামশাহর ও আবাদান নদীবন্দর দখল করা। সে সময় ইরানের বৃহত্তম তেল শোধনাগার ছিল আবাদান শহরে এবং স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত এই দু’টি নদীবন্দর ইরানের অর্থনীতি ও ভূরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছিল।
আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী খোররামশাহর দখল করতে এসে ইরানের সেনাবাহিনী, আইআরজিসি ও গণবাহিনীর তীব্র প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। ইরানি যোদ্ধারা সামান্য কিছু হাল্কা অস্ত্র নিয়ে অত্যাধুনিক অস্ত্র ও ট্যাংকে সজ্জিত ইরাকি বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে যান। ইরাকিরা ভেবেছিল, খোররামশাহরের প্রবেশদ্বারে তাদের ট্যাংক দেখা গেলে ইরানি যোদ্ধারা পালিয়ে যাবে এবং শহরের পতন হবে। এ সময়কার ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে পরবর্তীতে একজন ইরাকি সেনা কমান্ডার বলেন, “আমরা ভেবেছিলাম শহরের প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে গেছে এবং শহর আমাদের দখলে চলে এসেছে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছিল তার উল্টো। খোররামশাহরের প্রতিরোধ যোদ্ধারা আমাদেরকে শহরে ঢোকার পথ করে দিয়েছিল যাতে আমরা সেখানে নির্বিঘ্নে প্রবেশ করি। সমরাস্ত্রসহ আমরা শহরে অনুপ্রবেশ করার পর ইরানি যোদ্ধারা চারদিক থেকে আমাদেরকে ঘেরাও করে ফেলে। আমাদের আল-হাসান ব্যাটেলিয়নের দুই-তৃতীয়াংশ ট্যাংক এবং ম্যাকানিক্যাল ইউনিটের অর্ধেকেরও বেশি সাঁজোয়া যান ধ্বংস হয়ে যায়। আমাদের বহু সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজনকে আটক করে ইরান।”
খোররামশাহরের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের জন্য সেই সাফল্যময় দিনটি ছিল ১৯৮০ সালের ২ অক্টোবর। সেদিন তারা ফাঁদ পেতে ইরাকি বাহিনীকে শহরের ‘রেললাইন’ স্কয়ারে সমবেত করেন। এরপর তারা গ্রেনেড ও মোলোটভ ককটেলসহ এ ধরনের অন্যান্য বিস্ফোরক নিয়ে শত্রু বাহিনীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং একের পর এক ইরাকি ট্যাংক ধ্বংস হতে থাকেন। আগ্রাসী বাহিনী ভেবেছিল তারা খোররামশাহর দখল করে ফেলেছে। কিন্তু বাস্তবে তাদেরকে শহরের প্রবেশপথ থেকে রেললাইন স্কয়ার পর্যন্ত আসার সুযোগ করে দেয়া হয়েছিল। ফলে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে তারা পিছু হটে এবং শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়।

সেদিন প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশ নেয়া ইরানি যোদ্ধা হুমায়ুন সুলতানি বলেন, ২ অক্টোবর ছিল খোররামশাহরের ইতিহাসে একটি রক্তাক্ত দিন। আগ্রাসী ইরাকি সেনারা নগরীতে অনুপ্রবেশ করে যখন রেললাইন স্কয়ারে সমবেত হয় তখন প্রতিরোধ যোদ্ধারা তাদের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণের আকস্মিকতা ছিল এতটা প্রচণ্ড যে, এসব সেনা তাদের কন্ট্রোলরুমের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য এক মুহূর্তও সময় পায়নি; ফলে তাদেরকে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হয়। ইরাক-ইরান যুদ্ধের আট বছরে সীমান্তবর্তী খোররামশাহর নগরীর তরুণ ও যুবকেরা অনেকগুলো বীরত্বগাঁথা সৃষ্টি করলেও ২ অক্টোবরের ওই ঘটনার বিশালতা ছিল সবার উপরে। ওইদিনের পরাজয়ের ফলে ইরাকের বাথ সরকার ইরান আগ্রাসনের পরিকল্পনায় পরিবর্তন আনতে বাধ্য হয়। তারা খোররামশাহর দখল করার জন্য নগরীর কাছে অতিরিক্ত সেনা সমাবেশ করে এবং যেকোনো উপায়ে এই শহর দখল করার সিদ্ধান্ত নেয়।
ওই ঘটনার তিনদিন পর ১৯৮০ সালের ৫ অক্টোবর ভোররাতে ইরাকি সেনারা খোররামশাহরের ওপর আবার ভয়াবহ হামলা চালায়। কিন্তু এবারও তারা ইরানের পক্ষ থেকে প্রচণ্ড প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়। এ অবস্থায় ইরাকি সেনাদের ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধানের জন্য ইরাকি বাহিনীর তিন নম্বর ডিভিশনের কমান্ডার ইসমাইল আন-নায়িমি ৩৩ ব্রিগেডের ঘাঁটি পরিদর্শন করেন। এ ছাড়া, বাগদাদ থেকে আব্দুর রহমান আব্দুল ওয়াহিদ নামের আরেকজন জেনারেলকে ফ্রন্টের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়।
এই দুই জেনারেল মিলে খোররামশাহর অবরোধ করে রাখা ইরাকি বাহিনীকে যে নয়া কৌশল অবলম্বন করতে বলেন তা হলো- শহর অভিমুখে বিরতিহীনভাবে কামানের গোলাবর্ষণ করতে হবে। আগ্রাসী বাহিনী সে নির্দেশ পালন করে এবং মুহুর্মুহু গোলার আঘাতে নগরীর অবস্থা বিপর্যয়কর হয়ে পড়ে। খোররামশাহরের এমন কোনো স্থান নেই যেখানে আগ্রাসী বাহিনীর গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এই হামলায় ইরাকি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের পাশাপাশি বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হন। যুদ্ধ শুরুর আগে খোররামশাহরের খেজুরের বাগান এবং রাস্তার দু’পাশের সারিবদ্ধ খেজুর গাছ ছিল নগরীর অন্যতম প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু ইরাকি বাহিনীর গোলাবর্ষণে বহু খেজুরগাছ আগুনে পুড়ে যায় এবং খোররামশাহর বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হয়।
এভাবে পাশবিক হামলা চালিয়ে প্রতিরোধ ব্যুহ ভেঙে দিয়ে ৬ থেকে ৮ অক্টোবরের মধ্যে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী খোররামশাহরে অনুপ্রবেশ করার সুযোগ পায়। কিন্তু শহরের কেন্দ্রীয় মসজিদকে কেন্দ্র করে ইরানি যোদ্ধাদের প্রতিরোধ চলতে থাকে এবং ওই মসজিদ ইরাকি বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। নগরীর পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যে সংযোগ রক্ষাকারী ‘খোররামশাহর সেতু’টিও প্রতিরোধ যোদ্ধোদের নিয়ন্ত্রণে থাকে। ইরানি যোদ্ধাদের পাল্টা হামলার মধ্যেই আগ্রাসী ইরাকি সেনারা অগ্রসর হতে থাকে।
ওদিকে ইরানে আগ্রাসন চালাতে এসে কোনো ফ্রন্টেই সুবিধা করে উঠতে না পারার কারণে ইরাকি শাসক সাদ্দামের জন্য যেকোনো একটি ফ্রন্টে উল্লেখযোগ্য বিজয় অর্জন করা জরুরি হয়ে পড়ে। সাদ্দাম এর আগে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সর্বোচ্চ তিন দিনের মধ্যে গোটা খুজিস্তান প্রদেশ দখল করে ফেলবেন। কিন্তু প্রদেশের একটি শহর দখল করতে গিয়েই ইরাকি বাহিনীকে চরম ক্ষয়ক্ষতির শিকার হতে হয়। এ অবস্থায় খোররামশাহর দখল করা না করা সাদ্দামের জন্য মান-ইজ্জতের প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়। এ কারণে নগরীতে প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে থাকা ইরাকি সেনাদের কাছে বাগদাদ থেকে নির্দেশ আসে যেকোনো মূল্যে এই শহর দখল করতে হবে। নির্দেশ পাওয়ার পর আশপাশের বিভিন্ন স্থানে মোতায়েন সব ইরাকি সেনাকে খোররামশাহরে নিয়ে আসা হয় ইরানি প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য।#
পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ৩১
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।