ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০২০ ১৫:৪৩ Asia/Dhaka

সুরা নাস্‌র পবিত্র কুরআনের ১১০তম সুরা। পবিত্র মদিনায় নাজিল-হওয়া এ সুরায় রয়েছে ৩টি বাক্য বা আয়াত ও ১টি রুকু।

সুরা নাস্‌র্‌-এ মক্কা বিজয়, ইসলামের উন্নতি, মহান আল্লাহর পবিত্রতা ও গুণ বর্ণনা এবং তাঁর কাছে ক্ষমা চাওয়ার আদেশ ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। এবারে এই সুরার অনুবাদ শোনা যাক্‌ : অসীম দয়ালু ও অনন্ত করুণাময় আল্লাহর নামে: (১) যখন আল্লাহর সাহায্য ও বিজয়ের পরিস্থিতি আসবে (২) এবং তুমি প্রত্যক্ষ করবে, মানুষ দলে দলে আল্লাহর দীন গ্রহণ করছে। (৩) সুতরাং তুমি এর কৃতজ্ঞতায় তোমার প্রতিপালকের সপ্রশংস পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর এবং তাঁরই ক্ষমা প্রার্থনা কর। নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমাপরবশ।-

মক্কার কাফের-মুশরিকদের ব্যাপক অত্যাচার ও হয়রানির কারণে ইসলামের মহানবী (সা) জন্মভূমি মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হয়েছিলেন মক্কাস্থ তাঁর অনুসারী বেশিরভাগ মুসলমানদের নিয়ে। এর আগেই অনেকে হিজরত করেছিলেন আবিসিনিয়ায়। কিন্তু মহানবী (সা) মক্কায় ফিরে আসার ইচ্ছা সব সময়ই পোষণ করতেন। আর এ প্রেক্ষাপটে নাজিল হয় সুরা নাস‌্‌র্।

সুরা নাস্‌র্‌-এ এক গুরুত্বপূর্ণ বিজয়ের সুসংবাদ দেয়া হয়েছে। মহানবী (সা) খোদায়ি এই সুসংবাদে খুবই খুশি হয়েছিলেন এবং এ বিষয়টি মুসলমানদেরও জানান। তারাও খুব খুশি হন ও অধীর হয়ে প্রতীক্ষার প্রহর গুণতে থাকেন। অবশেষে  অষ্টম হিজরিতে মহান আল্লাহর নির্দেশে মুসলমানরা বিশাল সেনাদল নিয়ে মক্কায় এসে বিনা যুদ্ধে তা জয় করেন। আর এভাবে মহান আল্লাহর সেই মহাবিজয়ের ওয়াদা পূরণ হয় এবং কুরআনের মু’জিজা বা অলৌকিকতা তথা খোদয়ি গ্রন্থ হওয়ার বিষয়টি আবারও প্রমাণ হয়। মক্কা বিজয়ের আগেও মুসলমানরা অনেক বিজয় অর্জন করেছিলেন। কিন্তু সুরা নাস্‌র্‌-এর আভাস অনুযায়ী এ বিজয় সেসবের চেয়েও বড় বিজয়। এ বিজয়ের ফলে ইসলামের এক নতুন যুগের সূচনা হয় এবং মক্কার কাফের-মুশরিকদের বিশ বছরের প্রতিরোধ পুরোপুরি বরবাদ হয়ে যায়। উল্লেখ্য মহানবী (সা) বিজয়ী মুসলিম বাহিনীকে খুব কড়া নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তারা মক্কার কাউকে কষ্ট না দেন ও বিরক্ত না করেন এবং কোনো ধরনের রক্তপাত যেন না ঘটে।

মক্কায় প্রবেশের পর মহানবী (সা) মাসজিদুল হারামে যান এবং কাবা ঘরের কাছে এসে মূর্তিগুলোকে ভেঙ্গে চূরমার করেন। এরপর কাবা ঘরের পাশে দাঁড়িয়ে মক্কাবাসীকে প্রশ্ন করেন: আজ তোমরা আমার কাছে কি আশা করছ? তারা বলল: ক্ষমা। মহানবীর (সা) চোখ অশ্রু-সজল হল। কাঁদল মক্কার জনগণও। গত বিশ বছর ধরে মক্কাবাসীর হাতে এতসব নির্যাতন, হয়রানি ও যন্ত্রণার শিকার হয়েও দয়া, ক্ষমা ও মানবতার নবী বললেন: 'আমি তোমাদের সম্পর্কে তাই বলব যা বলেছিলেন আমার ভাই ইউসুফ। তোমাদের জন্য আজ কোনো তিরস্কার নেই। মহান আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করুন এবং তিনি দয়াদ্রদের মধ্যে সবচেয়ে দয়াদ্র। আজ তোমরা সবাই মুক্ত, যেখানে খুশি সেখানে যেতে পার।'

এভাবে কোনো রক্তপাত ও যুদ্ধ ছাড়াই মক্কা জয়ে করেন মুসলমানরা মহানবীর (সা) নেতৃত্বে। এই ইসলামী দয়া ও ক্ষমাশীলতা মক্কাবাসীর কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। তাই এই অনন্য মহানুভতা জনগণের হৃদয়কে এতটা আপ্লুত করল যে তারা দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে।

মহানুভবতায় ভরা এই মহাবিজয় গোটা আরব উপদ্বীপ অঞ্চলকে কাঁপিয়ে দেয়। ফলে গোটা আরব উপদ্বীপ অঞ্চল থেকে মূর্তিপূজা ও শির্ক বিলুপ্ত হয়। এভাবে ইসলামের আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে আরব বিশ্বের সবখানে এবং তা স্থায়ীত্ব অর্জন করে। এমনকি এরপরে ইসলামের বাণী আরব বিশ্বের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে।

শত্রুকে হারিয়ে দিতে শক্তি ও সাজ-সরঞ্জাম খুবই জরুরি, কিন্তু মনে রাখা দরকার প্রকৃত সাহায্য একমাত্র মহান আল্লাহর কাছ থেকেই আসে। বিজয়গুলোকে এভাবে দেখলে কোনো মানুষ কখনও অহংকার ও খোদাবিমুখতার শিকার হবে না। সুরা নাস্‌র্‌-এ প্রথমে মহান আল্লাহর সাহায্য, এরপর বিজয় এবং এরপরে ইসলামের ব্যাপক বিস্তার ও দলে দলে খোদার ধর্মে মানুষের প্রবেশের কথা এসেছে। এ তিন বিষয়ই পরস্পর সম্পর্কিত। খোদায়ি সাহায্য ছাড়া বিজয় অসম্ভব। আর বিজয় অর্জন ও বাধাগুলো দূর না হওয়া পর্যন্ত মানুষও দলে দলে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে না। মহান আল্লাহ এই সাহায্যের প্রেক্ষাপটেই তাঁর প্রিয়তম নবীকে আল্লাহর প্রশংসা করার ফরমান দিয়েছেন এবং সব ধরনের দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত থাকতে ও আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে বলেছেন।

সুরা নাস্‌র্‌ স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে যে আল্লাহ তাঁর পথের পথিক বা সংগ্রামীদের একা ছেড়ে রাখেন-এমনটা  কেউ যেন মনে না করে। এ সুরা শেখায় যে মহান আল্লাহ তাঁর ওয়াদাগুলো পূরণের শক্তি রাখেন। আল্লাহর দাসদের উচিত মহান আল্লাহর মহত্ত্ব ও অতূল ক্ষমতার মোকাবেলায় নিজেদের ক্ষুদ্রত্ব ও অপূর্ণতাকে স্বীকার করা এবং আল্লাহর প্রশংসা করা ও তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করা। এক হাদিসে বলা হয়েছে, যখন সুরা নাস্‌র্‌ নাজিল হয় এবং মহানবী (সা) তা তিলাওয়াত করে সাহাবিদের শোনান। তারা সবাই খুশি হন, কিন্তু মহানবীর চাচা হযরত আব্বাস যিনি বয়সে মহানবীর চেয়ে ছোট ছিলেন-তিনি এই সুরা শুনে কাঁদতে থাকেন। মহানবী (সা) বললেন: হে চাচা! তুমি কেন কাঁদছ? তিনি বললেন: আমার মনে হচ্ছে এই সুরায় আপনার দুনিয়া-ত্যাগের সংবাদ দেয়া হয়েছে। মহানবী তখন বললেন: তুমি ঠিকই বলেছে, ব্যাপারটা তা-ই।

যে কোনো বড় বিজয় বা সুখের পর মানুষের মধ্যে অহংকার জাগার ও বিচ্যুতি ঘটার আশঙ্কা থাকে। তাই তা এড়াতে আল্লাহর প্রশংসা ও ক্ষমার আশ্রয় নেয়া উচিত। ইসলাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার পর মুসলমানরা সম্পদশালী হলে তাদের অনেকেই ইসলামের শিক্ষা ভুলে খোদায়ি নেতৃত্বের অনুকরণ ছেড়ে রাজতান্ত্রিক ও গ্রোত্রবাদী নেতাদের অনুসারী হয়। ফলে দেখা দেয় গৃহযুদ্ধ এবং এক সময় সংঘটিত হয় কারবালার মর্মান্তিক ঘটনা। এভাবে ইসলাম বাইরের শত্রুদের চেয়ে ভেতরের মোনাফেক ও বিচ্যুত শক্তির হাতেই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সুরা নাস্‌র্‌-এসব বিষয়েও সতর্ক হতে বলে।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ