ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০ ১৭:৩৭ Asia/Dhaka

প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা) শীর্ষক নতুন ধারাবাহিক আলোচনার তৃতীয় পর্বে আপনাদের সাদর আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

পশ্চিমা পণ্ডিত ও প্রাচ্যবিদরা ইসলামের প্রচার ও প্রসার শুরু হওয়ার পর থেকেই ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে যত বেশি সম্ভব মিথ্যা এবং অলীক-কল্পনা-প্রসূত বক্তব্য প্রচার করেছেন। অথচ মহানবী মক্কার কাফির মুশরিকদের কাছেও ইসলাম-পূর্ব যুগ থেকেই আল-আমিন বা বিশ্বাসী ও সত্যবাদী, পবিত্র এবং আমানতদারসহ উন্নত সব নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে খ্যাত ছিলেন।  প্রাচ্যবিদরা ইউরোপের কথিত মধ্যযুগ থেকে প্রায় আধুনিক যুগের কাছাকাছি সময় পর্যন্ত মোটামুটি এ ধারাই অব্যাহত রেখেছেন, যদিও শেষের দিকে তারা কিছুটা নিরপেক্ষ সূর বা রং দেয়ার চেষ্টা করেছেন। খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকের কাছাকাছি সময় থেকে পাশ্চাত্যের কথিত এনলাইটেনমেন্ট বা আলোকায়নের যুগে যুক্তি ও প্রজ্ঞার প্রতি গুরুত্বের প্রভাবে কোনো কোনো প্রাচ্যবিদ ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে নিরপেক্ষ এবং উদার বিচার-বিশ্লেষণ শুরু করেন। এ প্রসঙ্গে এ যুগের খ্যাতনামা দুই ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ সাইমন অ্যাকলে ও জর্জ সিল (Simon Ackley, and George Seal )  এবং জার্মান কবি গ্যাটের নাম উল্লেখ করা যায়।

ইউরোপীয় প্রাচ্যবিদ বা পণ্ডিতদের কেউ কেউ ইসলাম ও মহানবীর ব্যাপারে প্রকাশ্যেই নিরপেক্ষ এবং বাস্তবধর্মী মন্তব্য করতে ভয় পেতেন। ফলে তারা আত্মপরিচয় গোপন করে বা বেনামে ইসলাম ও মহানবী সম্পর্কে প্রশংসা করেছেন হস্তলিখিত বইয়ে। তাদের এ ধরনের পাণ্ডলিপির কিছু নমুনা ব্রিটেনের যাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। যেমন, এ ধরনের একজন লেখকের একটি বইয়ের লেখককে পোপের দপ্তরের কর্মকর্তা চার্লস হার্বনি সনাক্ত করেছেন। তিনি বইটি ১৬৩১ খ্রিস্টাব্দে জন্মগ্রহণকারী লেখক হেনরি স্টাব-এর বলে উল্লেখ করেছেন। ১৬৩১ সনে জন্মগ্রহণকারী স্টাব ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বডলিয়ান লাইব্রেরির দ্বিতীয় গ্রন্থগারিক। ইসলাম সম্পর্কে প্রশংসাসূচক বই লেখার দায়ে তাকে পদচ্যুত করা হয়েছিল। ওই বইয়ে স্টাব লিখেছিলেন, মহানবী (সা) ছিলেন একজন বড় আইন-প্রণেতা ও প্রাচীন যুগ থেকে এ যাবৎকালের আইনপ্রণেতাদের মধ্যে সবচেয়ে বিজ্ঞ। 

হেনরি স্টাব মহানবী (সা) সম্পর্কে অসুন্দর ছবি তুলে ধরার ও তাঁর ব্যক্তিত্বকে বিকৃতভাবে প্রচারের জন্য 'হামফ্রে পেরিডো'র তীব্র নিন্দা জানান। তিনি লিখেছেন: ‌ইসলামের বিধি-বিধান কখনও প্রবৃত্তির ভোগ-প্রবণতাকে অসংযত হতে উৎসাহ দেয় না এবং ইসলামের বিয়ের প্রথাও খুব কঠোর নজরদারির আওতায় সংযত অবস্থায় রয়েছে। - এসব বক্তব্য 'মোহামেডানিজম এবং মুহাম্মাদের আচরণ ও জীবনপন্থা নিয়ে কিছু ভাবনা' শীর্ষক একটি প্রবন্ধে উল্লেখ করেছিলেন হেনরি। নিজের নাম উল্লেখ না করেই তিনি লিখেছেন, মুহাম্মাদ ও তাঁর ধর্ম সম্পর্কে কিছু কিছু মিথ্যাচার বা অপবাদ দূর করতে চাই এবং এসব বিষয়কে অপেক্ষাকৃত বেশি পছন্দনীয় বা গ্রহণযোগ্য যুক্তির আলোক স্পষ্ট করতে চাই। মুহাম্মাদ (সা) সম্পর্কে বিদ্বেষী বক্তব্য ও মন্তব্যগুলোর উৎসকে তিনি অজ্ঞতা কিংবা এর চেয়েও বাজে কোনো স্বভাব বলে উল্লেখ করেন। তিনি লিখেছেন: অনেক ব্রিটিশ পাদ্রি মুহাম্মাদ সম্পর্কে অন্ধ বিদ্বেষ ও ভিত্তিহীন কল্পনায় আচ্ছন্ন হয়ে আছেন।

আরও অনেক প্রাচ্যবিদ ইসলাম ও মুহাম্মাদ সম্পর্কে বিদ্বেষ পরিহার করে নিরপেক্ষ এবং ভারসাম্যপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। হেনরি বোলিং বোর্ক হচ্ছেন মধ্য যুগের এমনই একজন প্রাচ্যবিদ ও লেখক। অষ্টাদশ শতকের প্রথমার্ধে তিনি ছিলেন ব্রিটেনের রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তা।  মুসলমানদের সম্পর্কে নানা অপবাদ দেয়ার, বিশেষ করে তাদেরকে মূর্তিপূজারী ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বলে যে প্রচারণা চালানো হয়েছে তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। এমন কোনো অপবাদ নেই যা মুসলমানদের বিরুদ্ধে দেয়া হয়নি বলে বোর্ক উল্লেখ করেন। তার মতে এসব মিথ্যাচার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তাদের থেকেই এসেছে যারা ক্রুসেড বা কথিত পবিত্র ধর্মযুদ্ধ থেকে ফিরে আসত। 

হেনরি বুলিং লিখেছেন: ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় খ্রিস্টান ও মুসলমানরা সব সময় সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা দেখিয়েছে পরস্পরের প্রতি। তবে এক্ষেত্রে আগ্রাসী হিসেবে নিজেদের দোষ স্বীকার করা ছাড়া আমাদের কোনো উপায় নেই। কারণ, মুসলমানরা সব যুগেই একটি ঐশী ধর্ম হিসেবে খ্রিস্টানদের সঙ্গে ব্যাপক সন্ধি বা শান্তি প্রতিষ্ঠায় সম্মত হয়েছে। অথচ আমরা সব সময়ই মুসলমান ও তাদের নবীর ব্যাপারে অবমাননাকর ও কুৎসিত আচরণ করেছি এবং এমনকি তাদের অনুকূলে একটি ছাড়ও দিতে চাইনি। প্রাচ্যের গির্জাগুলো মুসলমানদের সহায়তা পায় এবং সেসবের মধ্যে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালনের অনুমতি দেয়া হয়। কিন্তু ইউরোপে মুসলমানদেরকে সহায়তা দেয়া এবং তাদেরকে স্বাধীনভাবে ধর্মকর্ম করতে দেয়ার চেয়ে মৃত্যুকে প্রাধান্য দেয়া হয়! আমরা মুহাম্মাদের প্রতি জুলুম করেছি।

ফরাসি প্রাচ্যবিদ কাউন্ট ডাবলিন ভিল্লাস ‘মুহাম্মাদের জীবনী’ শীর্ষক বইয়ে মহানবীর ব্যক্তিত্বের পক্ষে এমন জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছেন যে সে যুগের অনেক খ্রিস্টান তাতে বিব্রত বোধ করেন। তিনি লিখেছেন যে ইসলাম হচ্ছে মানুষের স্বাভাবিক প্রকৃতির ধর্ম। আর সহজ-সরল, যৌক্তিক ও মৌলিক এ ধর্ম দৃশ্যমান। তাঁর মতে মহানবী (সা) ছিলেন একজন বিজ্ঞ ও দূরদর্শী আইন-প্রণেতা। তাঁর মধ্যে যে সততা, আন্তরিকতা ও অকপটতা ছিল তা ইসলামের সরলতা ও স্পষ্টতার মধ্যে ফুটে উঠেছে বলে ভিল্লাস মন্তব্য করেছেন।

বুউলিন উইলিয়ে মনে করতেন খ্রিস্ট ধর্মে দু’টি ভুল ধারণা রয়েছে। প্রথম ভুল ধারণাটি হল এটা যে মুহাম্মাদের ধর্ম ইউরোপীয় সুস্থ বিচার-বুদ্ধির পরিপন্থী! অথচ ইসলামের চেয়ে যৌক্তিক, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং প্রজ্ঞা ও যুক্তি-নির্ভরতার দিক থেকে বেশি গ্রহণযোগ্য আদর্শের অস্তিত্ব নেই। দ্বিতীয় ভুল ধারণাটি হল, খ্রিস্টানরা মুহাম্মাদকে সুশীল ও সংস্কৃতিবান মনে করতেন না। কাউন্টের মতে মুহাম্মাদ বর্বর ও অসৌজন্যপরায়ন ছিলেন না বরং তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ বা যথাযথ আচরণে যত্নশীল এবং সব পরিস্থিতিতে দৃঢ়তা, বীরত্ব ও দূরদর্শিতাসহ জনগণকে আকৃষ্ট করার মত সব ভালো গুণ তাঁর ছিল।

মুহাম্মাদের জীবনী শীর্ষক একটি বই ব্রিটেনেও প্রকাশ হয় ১৭৩১ খ্রিস্টাব্দে। বইটির লেখকের নাম অজ্ঞাত। অত্যন্ত যত্ন নিয়ে খুব সতর্কভাবে বইটি লেখা হয়েছে। বইটির ইতিহাস বিষয়ক বক্তব্য নেয়া হয়েছে ইসলামী সূত্রগুলো থেকে। প্রকৃতিগত বা স্বাভাবিক ধারার স্রস্টা-অনুসন্ধানী কাউন্ট মনে করতেন আরবরা বিভিন্ন সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন ও নির্জন মরুতে থাকা জাতি ছিল বলেই অন্যান্য জাতির মধ্যে প্রচলিত কুসংস্কারগুলো তাদের মধ্যে ঢুকতে পারেনি। ফলে প্রকৃত খোদা সম্পর্কে তাদের প্রকৃতিগত বা স্বাভাবিক ধারণা টিকে থেকেছে। বুউলিন উইলিয়ে মুসলমানদের বিধি-বিধান, প্রথা ও সংস্কৃতির পক্ষে কথা বলতেন। তার মতে এসবই প্রজ্ঞাপূর্ণ, অনুধাবনযোগ্য ও উজ্জ্বল যা এনেছেন মুহাম্মাদ (সা)। পশ্চিমা সমাজে মুহাম্মাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণা সত্ত্বেও বুউলিন উইলিয়ে স্পষ্টভাবে লিখেছেন,

মুহাম্মাদ (সা) একজন মহান ও বিজ্ঞ আইন-প্রণেতা যিনি বিশ্ববাসীর জন্য একটি ত্রুটিমুক্ত ধর্ম উপহার হিসেবে এনেছেন। মহান আল্লাহ সব কিছু জানেন। তিনিই মুহাম্মাদকে (সা) পাঠিয়েছেন যাতে পথহারা খ্রিস্টানরা সচেতন হয় ও মূর্তিগুলোকে গুড়ো করে এবং সূর্যপূজারী ইরানিরা আল্লাহর অনুগত হয়। তিনি খোদা-পরিচিতির ধর্মকে সুদূর চীনের প্রাচীর থেকে স্পেনের উপকূল পর্যন্ত ছড়িয়ে দিয়েছেন।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ