ফেব্রুয়ারি ১৭, ২০২০ ১৮:২৯ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ভালো কথা বলা এবং সুন্দরভাবে কথা বলার গুরুত্ব নিয়ে খানিকটা আলোচনা করেছি। আমরা বলেছি মৌখিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে সুন্দর শব্দ প্রয়োগ এবং ভদ্রতার সঙ্গে কথা বলা জরুরি।

তবে সুন্দর কথা বলার অর্থ অন্যের যা ভালো লাগে সে ধরণের কথা বলে তার মন জয় করা নয় বরং সুন্দরভাবে কথা বলা মানে হলো, সর্বোত্তম শব্দ প্রয়োগের মাধ্যমে কল্যাণকর কথা বলা।

মানুষ সামাজিক জীব। প্রতিদিন নানা পর্যায়ের অসংখ্য মানুষের সঙ্গে আমাদের কথা বলতে হয়। কথোপকথনের সময় কয়েকটি বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রাখা দরকার। কারো সঙ্গে কথা বলার সময় ওই ব্যক্তির অবস্থান ও মর্যাদার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে যার সম্পর্কে কথা বলছি তার মানবিক মর্যাদাও অক্ষুন্ন রাখতে হবে অনেকে নিজের অপছন্দনীয় ব্যক্তি সম্পর্কে কথা বলতে গিয়ে এমন সব শব্দ, বাক্য ও তথ্য ব্যবহার করেন যা থেকে একজন শ্রোতা, খোদ বক্তা সম্পর্কেই নেতিবাচক ধারণা পান এ কারণে শত্রু সম্পর্কে কথা বলতে গেলেও শালীনতা ও সীমা-পরিসীমা মেনে চলা জরুরি যারা অবলীলায় অন্যের গোপনীয়তা প্রকাশ করে দেন তাদেরকে কেউ বিশ্বাস করতে পারেন না কথা বলার একটি আদব হচ্ছে গোপনীয়তা রক্ষা করা কেউ কেউ আছেন যারা কোনো কথাই গোপন রাখতে পারেন না কারো সম্পর্কে কিছু শোনার পর তা দ্রুতই অন্যের সঙ্গে শেয়ার করেন একবারও ভেবে দেখেন না যে ওই তথ্য, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সুনাম ক্ষুন্ন করতে পারে, তার জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে পবিত্র ইসলাম ধর্মেও অন্যের গোপনীয়তা রক্ষা করতে কঠোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  

আরেকটি বিষয়ে সতর্ক থাকা জরুরি। এক জায়গায় কয়েক জন থাকলে কাউকে বাদ দিয়ে অন্যদের সঙ্গে কথা বলা শিষ্ঠাচারের লঙ্ঘন। যাকে বাদ রেখে কথা বলা হয় তিনি কষ্ট পেতে পারেন, অপমানবোধ করতে পারেন।  এছাড়া কাউকে তার স্থান থেকে তুলে দিয়ে সেখানে বসাটাও অন্যায়। এর ফলে যাকে উঠিয়ে দেওয়া হলো তিনি অসম্মানবোধ করেন। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সভা-সমাবেশে দেখা যায় কোনো কোনো ব্যক্তি বিশেষ ধরণের আসনে বসে আছেন, অন্যরা বসেছেন আরও নীচু অথবা নিম্নমানের আসনে। এ ধরণের বিষয়গুলো এড়িয়ে চলতে পারলে ভালো। তবে এমন যদি হয় যে, কোনো ব্যক্তি শারীরিক সমস্যা বা অসুস্থতার কারণে সব জায়গায় বা সব চেয়ারে বসতে পারেন না তাহলে তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা দোষের কিছু নয়।

কেউ কেউ কথা বলতে খুব পছন্দ করেন। এটা মন্দ নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে অপ্রয়োজনীয় কথা কেউ শুনতে পছন্দ করেন না। এছাড়া একই কথা বারবার বললে তা কারো কাছে ভালো লাগে না। বলার মতো কিছু না থাকলে নীরব থাকাই শ্রেয়। এ অবস্থায় চুপ করে অন্যের কথা শুনতে হবে। অন্যের বক্তব্য থেকে উপকৃত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আমিরুল মুমিমিন হজরত আলী (আ.) বলেছেন, যে বেশি কথা বলেন তার ভুলও হয় বেশি। আর বেশি ভুল করলে তার বিবেক মরে যায়। আর যার বিবেক মরে যায় তার স্থান হচ্ছে দোজখ।

কথা বলার আগেই ভেবে নিতে হবে আপনি কী বিষয়ে কথা বলবেন এবং যে বিষয়ে কথা বলতে যাচ্ছেন সে বিষয়টির প্রভাব ও পরিণতি সম্পর্কে আগেই ভাবতে হবে। কারণ একবার একটি কথা বলা বা মন্তব্য করার অর্থ হলো ওই কথা ও মন্তব্যের ওপর থেকে নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেয়া। মুখ দিয়ে বের হওয়ার পর সাধারণত সেটার ওপর আর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কাজেই ভেবে-চিন্তে কথা বলার কোনো বিকল্প নেই।

বিভিন্ন সময় দেখা যায়, ব্যক্তি একটি কথা বলার পর এর পরিণতি উপলব্ধি করে অনুশোচনা করছেন, কিন্তু ততক্ষণে ক্ষতি যা হবার হয়ে গেছে। এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে যে, একটি মন্তব্যের কারণে পারস্পরিক সম্পর্কে এমন ফাটল সৃষ্টি হয়েছে যা আর কোনো দিন ঠিক হওয়ার নয়। অনেক সময় আমরা অন্যের কথা বা মন্তব্যকে ভুল বুঝে মন খারাপ করি। এ কারণে এমন কথা বলা উচিত নয় যা নানাভাবে ব্যাখ্যা করা যায়।

অনুশোচনা করার চেয়ে ভেবে-চিন্তে কথা বলা উত্তম। গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টটলকে একবার প্রশ্ন করা হয়েছিল- আপনার দৃষ্টিতে কোন ধরণের কথা বা বক্তব্য সর্বোত্তম? তিনি বলেছিলেন, যা বিবেকের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ তা-ই হচ্ছে সর্বোত্তম কথা বা বক্তব্য আবার প্রশ্ন করা হলো- এর পরের স্তরের ভালো কথা কোনটি? তিনি বললেন, যে কথা বা বক্তব্যকে শ্রোতা গ্রহণ করে তার দৃষ্টিতে, এরপরের ভালো কথা বা বক্তব্য হচ্ছে সেটা যার পরিণতি সম্পর্কে আপনি নিশ্চিত এবং যাতে কোনো অকল্যাণ নেই এরপর তিনি বলেন, আপনার কথা বা বক্তব্যে যদি এসব বৈশিষ্ট্যের একটিও না থাকে তাহলে বুঝতে হবে তা চতুষ্পদী জন্তুর এক ধরণের শব্দ মাত্র।  

ভালো ও সুন্দর কথা এবং নম্র আচরণ মানুষের এক অমূল্য সম্পদ। ভালো কথার মাধ্যমে একজন ক্ষুব্ধ ব্যক্তিকেও স্থির ও শান্ত অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। সাধারণত অন্যের রাগ, ক্ষোভ, গালমন্দ ও অপমানের মোকাবেলায় নীরবতা ভালো ফল দেয়। পাশাপাশি ঝগড়া না করে ক্ষুব্ধ ব্যক্তির সঙ্গে সদাচারণ করার অর্থ হলো, মন্দ মানুষকেও ভালো আচরণের শিক্ষা দেওয়া। সাধারণত এ ধরণের পরিস্থিতিতে মন্দ আচরণের মানুষের মধ্যেও পরিবর্তন আসে এবং ভালো ব্যবহার করতে শেখে।

আসলে নম্র-ভদ্র আচরণ মৃদু ও কোমল বাতাসের মতো যা মানুষের মনকে আলোড়িত করে এবং প্রশান্তির জন্ম দেয়। মানব সমাজের সর্বোত্তম আদর্শ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)'র কাছে কেউ কোনো আবেদন করলে তিনি তা গ্রহণ করার চেষ্টা করতেন। আর সম্ভব না হলে অত্যন্ত নরম সুরে সুন্দরভাবে তা জানিয়ে দিতেন, রুক্ষ আচরণ করতেন না।

মানুষের কথা ও বক্তব্য হচ্ছে তার ব্যক্তিত্বের পরিচায়ক। ভদ্র মানুষ সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতিতেও বকাঝকা করতে প্রস্তত নন। ভদ্র মানুষ শুধু শব্দ প্রয়োগেই সতর্ক থাকেন এমনটি নয় বরং কথা বলার ধরণ ও স্বর ওঠানামার ক্ষেত্রেও তিনি সতর্ক। সবশেষে সর্বোত্তম কথা বা বক্তব্যের বৈশিষ্ট্য তুলে ধরে আজকের আলোচনা শেষ করব। প্রথমত: সত্য কথা সর্বোত্তম কথার অন্তভুক্ত। মিথ্যাচার কখনোই উত্তম কথা হতে পারে না। দ্বিতীয়ত: নম্র ও ভদ্রভাবে উপস্থাপিত কথা সর্বোত্তম কথার অন্তর্ভুক্ত। তৃতীয়ত: সর্বোত্তম কথার সঙ্গে কাজের মিল থাকবে। যে কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই তা সর্বোত্তম কথা হতে পারে না। চতুর্থত: সর্বোত্তম কথা অন্যের জন্য বিরক্তিকর হয় না, সর্বোত্তম কথা  হবে স্বল্প কিন্তু অর্থপূর্ণ ও সবার কাছে বোধগম্য।

বন্ধুরা, আমরা সবাই সুন্দর, অর্থপূর্ণ ও শিক্ষণীয় কথা বলার চেষ্টা করব-এ প্রত্যাশায় শেষ করছি জীবনশৈলীর আজকের আসর। #

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৭