ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০ ১৯:২৫ Asia/Dhaka

বন্ধুরা! সালাম ও শুভেচ্ছা নিন। আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আপনারা জানেন যে, ইরানের জলে-স্থলে, ক্ষেত-খামারে, বাগ-বাগিচায়, কল-কারখানায় উৎপাদিত হয় বিচিত্র সামগ্রী।

এর পাশাপাশি খনি থেকে উৎপন্ন  বিভিন্ন সামগ্রী এবং ইরানি নরনারীদের মেধা ও মনন খাটিয়ে তৈরি করা হয় বিভিন্ন শিল্পপণ্য। গত আসরে আমরা আলোচনা করেছিলাম টেক্সটাইল ও পোশাক শিল্প নিয়ে। টেক্সটাইল শিল্পে ন্যানো বিজ্ঞান উৎপাদনে বিশ্বে শতকরা প্রায় তিন ভাগের অধিকারী ইরান। জ্ঞান-বিজ্ঞান উৎপাদনে ইরানের শতকরা এই হার ফ্রান্সের সম পর্যায়ের এবং স্পেন ও জাপানের মতো দেশগুলোর চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে।

ইরান বিষয়ক গবেষক ও বিশেষজ্ঞদের লেখাজোখা অনুযায়ী এই অভিমত ব্যক্ত করা হয়েছে যে ইরানে টেক্সটাইল শিল্প তথা বুনন ও সূতা কাটা শিল্পের সূত্রপাত হয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব দশ হাজার বছর আগে। কাশানের সিয়ালক এলাকায় বুনন শিল্প ও সূতাকাটা শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রাচীন যেসব নিদর্শন পাওয়া গেছে সেসব থেকে বিশেষজ্ঞরা এই মত দিয়েছেন। মাদরাই সর্বপ্রথম এই শিল্পে অবদান রেখেছে। তারা স্থানীয় প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করে বিশেষ করে পশম, কটনসহ আরও অন্যান্য ধরনের তুলাজাতীয় প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে চমৎকার সব কাপড় তৈরি করেছেন। কেবল কাপড়ই নয় শতরঞ্জিসহ ম্যাট এবং এ জাতীয় আরও বহু শিল্প তৈরি করেছে তারা। শিরাজের তাখতে জামশিদ বা পার্সপোলিসের প্রাচীন নকশায় সেসব শিল্পের নিদর্শন দেখতে পাওয়া যায়।

ফরাসি ইতিহাসবিদ রেনে গ্রোসে লিখেছেন বিভিন্ন স্থানে খনন কাজ চালিয়ে যেসব প্রাচীন শিলালিপি, পাথর খোদাই করা নকশা কিংবা ভাস্কর্য পাওয়া গেছে সেসব থেকে প্রাচীন ইরানের মানুষের পরিধেয় বস্ত্র বা পোশাক আশাকের ধরন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। মানুষের সর্বপ্রাচীন যে ভাস্কর্যটি ইরানে পাওয়া গেছে সেটি খ্রিষ্টপূর্ব চার হাজার বছর আগেকার বেশ ছোট্ট একটি ভাস্কর্য। কাশানের সিয়ালক এলাকায় প্রাপ্ত ওই ভাস্কর্যে যে পোশাকের নিদর্শন লক্ষ্য করা গেছে তা থেকে অনুমিত হয় ইরানের ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা পশুর চামড়াকে সরাসরি পশুর শরীর থেকে আলাদা করে আস্ত চামড়াটাই পরতো না। তারা বরং ওই চামড়া থেকে পশমগুলোকে আলাদা করে নিয়ে কাপড় বানাতো।

পুরাতত্ত্ব গবেষকদের খনন কাজ থেকে পাওয়া অন্যান্য নিদর্শনের মধ্যে কিছু কয়েনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। এসব কয়েন পাওয়া গেছে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রাচীন শহর শুশ এবং চোগামিশ প্রাচীন টিলায়। এসব কয়েনের খোদাই করা ছবিতে লক্ষ্য করা যায় কিছু মানুষ সুতো কাটছে। ঐতিহাসিক ইয়াহিয়া কেরমান এলাকাতেও পশুর পশম দিয়ে তৈরি কাপড়ের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। ওই কাপড়কে বিশেষজ্ঞ পুরাতত্ত্ববিদগণ খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগের বলে মত দিয়েছেন। দমাগনের হেসর টিলাতেও পাওয়া গেছে প্রাচীন একটি মাকু যা খ্রিষ্টপূর্ব তিন হাজার বছর আগের বলে মনে করা হচ্ছে।

ইরানে কাপড় বোনার প্রাচীন খতিয়ান দেখছিলাম আমরা। সময়ের পরিক্রমায় ইরানের কাপড় বুনন ও উৎপাদন শিল্পে এসেছে ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতি। শতাব্দীর পর শতাব্দীর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এই শিল্পে ইরানিরা নিয়ে এসেছে ব্যাপক বৈচিত্র্য। রঙে, ডিজাইনে সবকিছুতেই। খ্রিষ্টীয় এগারো এবং বারো শতাব্দীতে মানে সালজুকি যুগের ঐতিহাসিক পর্বে রেশম মানে সিল্কের কাপড় বোনার কথা বর্ণিত হয়েছে। ফলে ওই সময় থেকেই কাপড়ের রঙে এবং ঔজ্জ্বল্যে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করে। এরপর সাফাভি শাসনামলে মানে খ্রিষ্টীয় ষোলো থেকে আঠারো শতকে ইরানে কাপড় বুনন শিল্পে নকশায়, ডিজাইনে, গুণগত মানে ও বৈচিত্র্যে আসে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। ইরানের কাপড় বুনন শিল্পের ইতিহাসে এই যুগটিকে বলা হয়ে থাকে স্বর্ণালি যুগ।

সোনালি যুগে সিল্কের কাপড়, কটন, সাটিনের কাপড় বা অ্যাটলাস ফেব্রিক্স, মখমল ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের কাপড়ে বুনন ও নকশায় ব্যাপক অগ্রগতি সাধিত হয়। ইরানের ধ্রুপদী সাহিত্যের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে এই ফেব্রিক শিল্পেও। সাফাভি যুগের এইসব ফেব্রিকের নমুনা এখনও বিশ্বের নামকরা বিভিন্ন মিউজিয়ামে দেখতে পাওয়া যাবে। লন্ডনের ভিক্টোরিয়া এবং অলব্রাইট মিউজিয়ামেও শোভা পাচ্ছে ইরানি ফেব্রিকের নিদর্শন। প্রাচীন ওইসব কাপড়গুলো এখন যথেষ্ট উচ্চমূল্য হলেও ইরানের কোথাও কোথাও যে তৈরি হচ্ছে না তা নয়। এখনও জরির কাপড়, মখমল কাপড় ইত্যাদি ইরানের তেহরান, ইস্পাহান, কাশানসহ বিভিন্ন এলাকায় তৈরি করা হচ্ছে। টেক্সটাইল শিল্পে এখন উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। টেক্সটাইল, ফেব্রিক এবং গার্মেন্টস শিল্পে ইরানে বর্তমানে সাড়ে নয় হাজারেরও বেশি শিল্প কারখানা ও প্রতিষ্ঠান তৎপর রয়েছে। ইরানের শতকরা তের ভাগ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে এইসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে।

বিশ্ব বাজারে এখন চলছে প্রতিযোগিতা। প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে কোনো শিল্পের টিকে থাকার জন্য প্রয়োজন আধুনিকায়ন এবং গুণগত মান নিশ্চিত করা। আধুনিক টেকনোলজির ব্যবহার এক্ষেত্রে অবশ্যম্ভাবী। সেইসঙ্গে মেধা ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে নতুন নতুন উৎপাদনে অগ্রসরতাও খুবই প্রয়োজন। ন্যানো টেকনোলজি এ ধরনের একটি উদ্ভাবনী। ইরান ন্যানো টেকনোলজিতেও বেশ অগ্রসর এখন। এই ন্যানো টেকনোলজিকে ফেব্রিক শিল্পে কাজে লাগানোর ফলে ভোক্তাদের চাহিদা মেটানোর কাজে সাফল্য এসেছে অনেক। ন্যানো টেকনোলজির প্রয়োগে সময় এবং অর্থ দুটোরই সাশ্রয় হয়েছে।

ইরান এই শিল্পের উন্নয়নে কিছু মেশিনও তৈরি করেছে। বিএসএফ এবং সিএফ মেশিন সুতো তৈরির মেশিন। এগুলোর সাহায্যে উৎপাদিত সুতোর মান যেমন উন্নত তেমনি রঙের কোয়ালিটিও একেবারে পাকা। বেশ দ্রুতই সুতো তৈরি করা যায় এইসব মেশিনের সাহায্যে। ইরানের বিজ্ঞানীরা যারা এসব মেশিন বানিয়েছে তারা কিন্তু বসে নেই। আরও উন্নত মেশিন তৈরির পাশাপাশি উৎপাদিত মেশিন এবং মেশিনে তৈরি পণ্য সামগ্রীর বাজার সৃষ্টিতে তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ১৮