কুরআনের আলো
সূরা আস-সাফফাত: আয়াত ৯৩-১০১ (পর্ব-১১)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা আস-সাফফাতের ৯৩ থেকে ১০১ নম্বর আয়াতের তাফসির উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ৯৩ থেকে ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
فَرَاغَ عَلَيْهِمْ ضَرْبًا بِالْيَمِينِ (93) فَأَقْبَلُوا إِلَيْهِ يَزِفُّونَ (94) قَالَ أَتَعْبُدُونَ مَا تَنْحِتُونَ (95) وَاللَّهُ خَلَقَكُمْ وَمَا تَعْمَلُونَ (96)
“অতঃপর সে (মূর্তিগুলোর কাছে গেল এবং) ডান হাতে তাদের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানল।”(৩৭:৯৩)
“তখন লোকজন তার দিকে ত্রস্তব্যস্ত হয়ে ছুটে এলো।”(৩৭:৯৪)
“(ইব্রাহিম) বলল: তোমরা (স্বহস্তে) নির্মিত পাথরের পূজা কর কেন? (৩৭:৯৫)
“অথচ আল্লাহ তোমাদেরকে এবং তোমরা যা নির্মাণ করছ (তাদের) সবাইকে সৃষ্টি করেছেন।” (৩৭:৯৬)
গত আসরে আমরা বলেছিলাম, মূর্তিপূজকদেরকে আল্লাহ তায়ালার প্রতি উদাসিনতার ঘুম থেকে জাগ্রত করার জন্য হযরত ইব্রাহিম (আ.) উপযুক্ত সুযোগের সন্ধানে ছিলেন। তিনি তাদেরকে একথা বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, এই মূর্তিগুলোর কিছু করার ক্ষমতা নেই এবং তাদের ভাগ্য নির্ধারণেও এদের কোনো ভূমিকা নেই। এ কারণে উৎসবের মৌসুমে সবাই যখন শহর থেকে বেরিয়ে যায় তখন তিনি অসুস্থতার ভান করে শহরে থেকে যান। এরপর তিনি একটি কুঠার হাতে শহরের মন্দিরে চলে যান এবং সবচেয়ে বড় মূর্তিটিকে অক্ষত রেখে বাকি সবগুলোকে ভেঙে চুরমার করে দেন। উৎসব শেষে মূর্তিপূজকরা শহরে ফিরে অবিশ্বাস্য এক দৃশ্যের সম্মুখীন হয়। তারা দেখতে পায় তাদের ছোট-বড় উপাস্যগুলো ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে।
এর আগে হযরত ইব্রাহিমের মুখে তারা এসব মূর্তির অনেক বদনাম শুনেছিল এবং একমাত্র তিনিই শহরে থেকে গিয়েছিলেন। তাই তাদের বুঝতে অসুবিধা হয় নি যে, এই কাজ ইব্রাহিমেরই। তাই তারা কালবিলম্ব না করে হযরত ইব্রাহিমের কাছে গিয়ে ক্ষুব্ধ কণ্ঠে এ কাজের ব্যাখ্যা জানতে চায়। তাদের রাগান্বিত অবস্থা দেখে হযরত ইব্রাহিম মোটেও বিচলিত না হয়ে স্থিরচিত্তে উপযুক্ত দলিল ও প্রমাণ তুলে ধরে তাদের প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি বলেন, কোনো বুদ্ধিমান মানুষ কি নিজের হাতে তৈরি জিনিসের উপাসনা করতে পারে? যদি সৃষ্টি উপাস্য হতে পারে তাহলে তার স্রষ্টা কি উপাস্য হতে পারে না? তিনি উপস্থিত লোকজনকে উদ্দেশ করে বলেন, আসুন! আমরা মূর্তির উপাসনা বাদ দিয়ে সেই একক সত্ত্বার উপাসনা করি যিনি এই মূর্তিগুলোর পাশাপাশি আমার এবং আপনাদের সবার স্রষ্টা।
এই চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১. সমাজের ভ্রান্ত কৃষ্টি ও সংস্কৃতি নির্মূলের জন্য উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে এবং সময়মতো তার ভিত্তিমূলে আঘাত হানতে হবে।
২. মানুষের হাতে নির্মিত যেকোনো বস্তু প্রকৃতপক্ষে আল্লাহরই সৃষ্টি। কাজেই জ্ঞানবিজ্ঞানের উৎকর্ষের এই যুগে মানুষ যা কিছু আবিষ্কার করুক না কেন তার জ্ঞান আল্লাহই মানুষের মস্তিষ্কে দিয়ে দিয়েছেন এবং এর প্রকৃতি স্রষ্টা তিনিই।
সূরা সাফফাতের ৯৭ ও ৯৮ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
قَالُوا ابْنُوا لَهُ بُنْيَانًا فَأَلْقُوهُ فِي الْجَحِيمِ (97) فَأَرَادُوا بِهِ كَيْدًا فَجَعَلْنَاهُمُ الْأَسْفَلِينَ (98)
“তারা বলল: এর জন্য একটি উঁচু ভিত নির্মাণ কর এবং অতঃপর তাকে আগুনের জাহান্নামে নিক্ষেপ কর।”(৩৭:৯৭)
“তারপর তারা তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র আঁটতে চাইল, কিন্তু আমি তাদেরকেই পরাভূত করে দিলাম।” (৩৭:৯৮)
মুশরিকরা হযরত ইব্রাহিমের যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য মেনে নেয়ার পরিবর্তে তাঁকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা আল্লাহর নবীকে আগুনে জ্বালিয়ে হত্যা করার লক্ষ্যে বিশাল ও সুউচ্চ অগ্নিকুণ্ড নির্মাণ করে। এরপর তারা হযরত ইব্রাহিমকে ওই জ্বলন্ত আগুনে নিক্ষেপ করে। কিন্তু আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছায় বিশাল অগ্নিকুণ্ড হযরত ইব্রাহিমের জন্য ফুল বাগানে পরিণত হয় এবং জ্বলন্ত আগুনের তাপমাত্রা তাঁর জন্য আরামদায়ক হয়ে যায়। মুশরিকদের অবাক করে দিয়ে তিনি আগুনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসেন এবং এভাবে শত্রুদের ষড়যন্ত্র থেকে মহান আল্লাহ তাঁর নবীকে রক্ষা করেন।
এই দুই আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- কুফর ও শিরকের কোনো যৌক্তিক ভিত্তি নেই। এ কারণে মুশরিকরা সব সময় বলপ্রয়োগ করে তৌহিদ বা একত্ববাদের মোকাবিলা করতে চায়।
২- আল্লাহ তায়ালার প্রেরিত পুরুষরা মানুষকে জুলুম ও কুফরের অন্ধকার থেকে মুক্তি দেয়ার জন্য যেকোনো বিপদ মাথা পেতে নেন; এমনকি প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়াকেও ভয় করেন না।
৩- প্রাকৃতিক নিয়মকানুন আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছাতেই পরিচালিত হয়। তাই তিনি ইচ্ছা করলে নিয়মের বিপরীত ঘটনাও ঘটতে পারে। আল্লাহর ইচ্ছাতেই প্রচণ্ড আগুনে হযরত ইব্রাহিম (আ.) সম্পূর্ণ অক্ষত থেকেছেন।
এই সূরার ৯৯ থেকে ১০১ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَقَالَ إِنِّي ذَاهِبٌ إِلَى رَبِّي سَيَهْدِينِ (99) رَبِّ هَبْ لِي مِنَ الصَّالِحِينَ (100) فَبَشَّرْنَاهُ بِغُلَامٍ حَلِيمٍ (101)
(ইব্রাহিম এই ঘটনা থেকে রক্ষা পেল) এবং বলল: আমি আমার পালনকর্তার দিকে চললাম, তিনি অতি শীঘ্রই আমাকে পথপ্রদর্শন করবেন।” (৩৭:৯৯)
“হে আমার পরওয়ারদেগার! সৎকর্মশীলদের মধ্য থেকে আমাকে (একটি পুত্র সন্তান) দান কর।” (৩৭:১০০)
“সুতরাং আমি তাকে এক ধৈর্যশীল পুত্রের সুসংবাদ দান করলাম।” (৯৯:১০১)
হযরত ইব্রাহিম (আ.) কাফেরদের ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা পাওয়ার পর বাবেল অঞ্চলে নিজের রেসালাতের দায়িত্বের ইতি টানেন। তিনি শামদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, ইতিহাসের দীর্ঘ পরিক্রমায় এই অঞ্চলে বহু নবী-রাসূল ও আউলিয়ার আগমন ঘটেছে। হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা করেন। সেইসঙ্গে তিনি তাঁর রিসালাতের দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা এবং তা অব্যাহত রাখার জন্য আল্লাহর কাছে সৎকর্মশীল পুত্রসন্তান কামনা করেন। মহান আল্লাহ তাঁর নবীর এ মুনাজাত কবুল করেন এবং তাঁকে ইসমাইল ও ইসহাক নামের দুই পুত্র সন্তান দান করেন যাদের দু’জনই ছিলেন পুতপবিত্র ও মহান চরিত্রের অধিকারী। পরবর্তীতে আল্লাহর তায়ালা এই দু’জনকেই নবুওয়্যাত দান করেছিলেন।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১. ঐশী পুরুষগণ আল্লাহর রাস্তায় পথচলা শুরু করেন এবং গন্তব্যকে আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছার ওপর ছেড়ে দেন। সেইসঙ্গে মহান আল্লাহর ওপর পরিপূর্ণ নির্ভরতার মাধ্যমে তাঁর কাছে সঠিক পথের দিশা পাওয়ার আবেদন জানান।
২. আমরাও যদি আল্লাহর রাস্তায় পথ চলা শুরু করতে পারি তাহলে এই স্থির বিশ্বাস রাখতে হবে যে, তিনি দয়াপরবশ হয়ে আমাদেরকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেবেন এবং আমাদের চলার পথ মসৃণ করবেন।
৩. সৎকর্মশীল সন্তান কামনা করার শিক্ষা নবী-রাসূলরা আমাদেরকে দিয়ে গেছেন। এ ধরনের সন্তান সুস্থ ও সুন্দর সমাজ গঠনে অপরিহার্য।#