প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা) পর্ব-৪
আজ আমরা এমন একজন ফরাসি প্রাচ্যবিদ সম্পর্কে কথা বলব যিনি প্রাচ্য সংক্রান্ত পশ্চিমা গবেষণার ধারায় ব্যাপক ত্রুটি-বিচ্যুতি দেখে বাস্তবতা ও সত্য-অভিমুখী হয়েছিলেন।
খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকের প্রথম দিকে পাশ্চাত্যের রেনেসাঁ বা জাগরণ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কোনো কোনো প্রাচ্যবিদ মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় নির্মাতা ও প্রশিক্ষক এবং সবচেয়ে বড় ঐশী মহামানব হযরত মুহাম্মাদ (সা)’র ব্যক্তিত্বের অশেষ ও বিশ্বজনীন প্রভাবের বিষয়টি ভালোভাবে বোঝার চেষ্টা করেন। তারা এ লক্ষ্যে পশ্চিমা গবেষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য আরবি ভাষা শেখার প্রথা চালু করেন। এ পদক্ষেপের কারণে ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে পশ্চিমা বা ইউরোপীয়দের মন পুরোপুরি বিদ্বেষমুক্ত হয়েছিল তা বলা যাবে না। কিন্তু এর ফলে পুরনো বিদ্বেষপূর্ণ ও শুষ্ক ধারণাগুলোর পরিবর্তে বিশ্বজনীন উপলব্ধির দরজা খুলে যায় এবং ভারসাম্যপূর্ণ বা ন্যায়বিচারপূর্ণ মন্তব্য করার পথ সুগম হয়। ফ্রাঁসোয়া ম্যারি আরোয়েত বা ভল্তেয়ার ছিলেন এমনই এক ফরাসি চিন্তাবিদ, সাহিত্যিক, ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক যিনি মহানবী (সা)’র অতুলনীয় ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তার হীন ধারণা অনেকাংশে পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
ফরাসি প্রাচ্যবিদ ও নাট্যকার ভল্তেয়ার যৌবনের প্রথমদিকে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে পাদ্রি ও মিশনারিগুলোর বিদ্বেষময় কল্প-কাহিনীর শিকার হয়েছিলেন। ফলে তিনি ইসলামের মহানবী (সা) সম্পর্কে অত্যন্ত অবমাননাকর নাটক (Fanaticism, or Mahomet the Prophet ) ‘নবী মোহাম্মাদ’ লিখেছিলেন। নাটকটি প্রথম দেখানো হয় ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে। নানা কারণে নাটকটি তৎকালীন খ্রিস্টধর্ম প্রধান পোপকেও বিক্ষুব্ধ করেছিল। এ নাটকে তিনি মহানবীকে (সা) ইউরোপীয়দের কাছে সবচেয়ে বেশি কুৎসিতভাবে তুলে ধরেন।

কিন্তু পরবর্তীকালে ভল্তেয়ার ব্যাপক চেষ্টা-প্রচেষ্টার পর ইসলাম ধর্ম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে কিছু বাস্তবতা জানতে সক্ষম হন। ফলে তিনি আর ইসলামের মহানবীকে অবমাননার যোগ্য বলে মনে করতেন না বরং ইসলামের ইতিহাসের এক বিমুগ্ধ অনুরাগীতে পরিণত হন। অবশ্য তখনও তিনি মনে করতেন যে মুসলমানরাও অন্যান্য ধর্মের অনুসারীদের মতই নানা কুসংস্কার ও অস্পষ্টতায় আচ্ছন্ন!
ভল্তেয়ার ন্যায়বিচার,ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সহিষ্ণুতার কথা বলতেন এবং সমাজ সংস্কার নিয়ে কথা বলতেন। বাক-স্বাধীনতা ও বুদ্ধিবৃত্তিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তিনি গির্জার ও ফ্রান্সের বুরবোন রাজবংশের বিরোধিতায় নামেন। ধীরে ধীরে তিনি ইসলাম ও মুসলমানদের অনুকূলে কথা বলতে থাকেন। ‘কুসংস্কারের গোরস্থান’ ও ‘সভ্রান্ত ব্যক্তির বিধি-বিধান’ নামক দুই লেখায় তিনি ইসলাম ও ইসলামের মহানবীর (সা) প্রশংসা করেন। তার প্রশংসার এই ধারা ক্রমেই বাড়তে থাকে। ‘অবশেষে যে দিকের অনুরাগী হওয়া উচিত’ শীর্ষক লেখায় ভলতেয়ার ইসলামকে অন্য সব ধর্মের চেয়ে উন্নত বলে প্রকাশ্যেই মন্তব্য করেন।
ভলতেয়ার বহু বছর ধরে ধর্মগুলোর বাস্তবতা সম্পর্কে জানার জন্য ব্যাপক গবেষণা ও অনুসন্ধানে মশগুল ছিলেন। তিনি বহু বই পড়ে ও নানা ধর্মের অনুসারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ পথে কঠোর পরিশ্রম করেন। বিজ্ঞ লোকদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তিনি তাদের সহায়তা চাইতেন যাতে সত্যকে জানা যায়। ভলতেয়ার মনে করতেন বুদ্ধিবৃত্তিক নানা যুক্তি-প্রমাণের ভিত্তিতে বোঝা যায় যে স্রস্টার অস্তিত্ব রয়েছে। তিনি বলতেন ঘড়ি-নির্মাতা যেমন ঘড়ি তৈরি করেন তেমনি এ বিশ্ব-জগতেরও একজন স্রষ্টা রয়েছেন। ভলতেয়ার বলেছেন, আমার মাথার ওপরের আকাশ ও রাতের তারকারাজি দেখতে পারাটাই আমার জন্য মহান স্রস্টার অস্তিত্বের প্রমাণ হিসেবে যথেষ্ট।
খ্রিস্টিয় ১৭৬৩ সালে ভলতেয়ারের চিন্তাধারায় বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে। এ বছরই মহানবী (সা) ও তাঁর অনুসারীদের সম্পর্কে ভলতেয়ারের বিদ্বেষপূর্ণ ধারণার অবসান ঘটে। ৪০ বছর ধরে ধর্ম ও ইতিহাস সম্পর্কে গবেষণার পর তিনি মহানবীর (সা) প্রশংসা করে বলেছেন: নিঃসন্দেহে মোহাম্মাদ অত্যন্ত বড় মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁর গুণ ও পূর্ণতার ছোঁয়ায় বড় বড় মানুষও গড়ে তুলেছেন। তিনি ছিলেন প্রাজ্ঞ আইন-প্রণেতা, শক্তিশালী দ্বিগ্বিজয়ী, ন্যায়পরায়ন শাসক ও খোদাভীরু নবী এবং তিনিই বিশ্বে সবচেয়ে বড় বিপ্লব ঘটিয়েছেন।
'কুসংস্কারের গোরস্থান'শীর্ষক বইয়ে ভলতেয়ার উল্লেখ করেছেন যে দুনিয়ার সব ধর্মই পৃথিবীর গোরস্থানে ঠাঁই নেবে, কিন্তু একমাত্র যে জীবন্ত চেহারাটি নিজেকে তুলে ধরছে তা মুহাম্মাদের (সা) চেহারা।
ভলতেয়ার খ্রিস্ট ধর্মের সমালোচনা করে বলেছেন,এ ধর্ম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম পালন করা উচিত। নানা ধর্মের প্রকৃতি বিশ্লেষণের পর ভলতেয়ার ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে বলেছেন, যে ধর্ম মুহাম্মাদ এনেছেন তা নিঃসন্দেহে খ্রিস্ট ধর্মের চেয়ে উন্নত। তাঁর ধর্মে কখনও কোনো এক ইহুদিকে (হযরত ঈসা) খোদা বলে দাবি করা হয়নি, এক ইহুদি নারীকে (হযরত মরিয়ম) খোদার মা বলে ভাবা হয়নি এবং অন্য ইহুদি নবীদের ব্যাপারে ঘৃণা ও বিদ্বেষ পোষণ করা হয়নি। তাঁর ধর্ম তথা ইসলাম কখনও খ্রিস্টানদের পাগলামিপূর্ণ কুফ্রি বা অবিশ্বাসের পথ ধরেনি এবং কখনও এক খোদাকে তিন খোদা ও তিন খোদাকে এক খোদা বলে মনে করেনি.... এক খোদার প্রতি বিশ্বাস কেবল মুহাম্মাদের ধর্মেরই মূলনীতি। (সূত্র:ভলতেয়ার-এর রচনাবলী, খণ্ড-২৬, পৃষ্ঠা-২৯২)
ভলতেয়ার ১৭৭৬ খ্রিস্টাব্দে মহানবীর (সা) প্রতি চরম অবমাননাকর নাটকটি লেখার কথা স্মরণ করে বলেছিলেন,
আমি মোহাম্মাদের প্রতি অনেক অন্যায় করেছি। মোহাম্মাদের মধ্যে রয়েছে এমন বিস্ময়কর কিছু যা খুবই পছন্দনীয় ও হৃদয়-জুড়ানো। মানুষ তাঁর প্রতি বিস্মিত ও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হতে বাধ্য হয়। কারণ তিনি একাই বিপুল অংশীবাদী বা মুশরিক জনগণের মোকাবেলায় রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। ওই মুশরিকরা মোহাম্মাদের (সা) চিন্তাধারাকে বিলুপ্ত করতে চেয়েছিল। তিনি মানুষকে এক আল্লাহর ইবাদতের দিকে আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বহু বছর ধরে আল্লাহর পথে আহ্বান জানাতে গিয়ে নির্যাতন ও নানা যন্ত্রণা সহ্য করেছেন। #
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/০২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।