মার্চ ১০, ২০২০ ২২:৪১ Asia/Dhaka

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ইসলামের ব্যাপক প্রচার ও প্রসার প্রথম থেকেই কাফির-মুশরিক ও মুনাফিক গোষ্ঠী এবং কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের নানা ধরনের ব্যাপক শত্রুতা,বিষাক্ত প্রচারণা ও যুদ্ধসহ নানা ধরনের বাধার শিকার হয়েছিল।

পশ্চিমা পণ্ডিত বা বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রাচ্যবিদদের পক্ষ থেকেও এ জাতীয় শত্রুতার শিকার হয়েছিল পবিত্র ধর্ম ইসলাম। তাদের বেশিরভাগই ইসলাম সম্পর্কে নিরপেক্ষ, যৌক্তিক ও ন্যায়বিচারপূর্ণ অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বিস্ময়ের ব্যাপার হল ইউরোপে ইসলাম ও মহানবীর (সা) সবচেয়ে বড় মু’জিজা পবিত্র কুরআনের অনুবাদ ও মূল গ্রন্থটির প্রকাশ ও প্রচার খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতক পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিল। পবিত্র কুরআন প্রকাশ ও প্রচারের দায়ে একদল ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হত।                               

কিন্তু পাশ্চাত্যের একদল চিন্তাবিদ ও পণ্ডিত মনে করতেন কুরআনকে এ জন্যই প্রচার করা উচিত যাতে মুহাম্মাদের (সা) কথিত ‘মিথ্যাচারগুলো’ সবার কাছে স্পষ্ট হয়! ফলে তারা কুরআন অনুবাদ করে তা প্রচারও করেন। কিন্তু এতে ফল হল সম্পূর্ণ উল্টো! ইউরোপীয় শিক্ষিত সমাজের অনেকের কাছেই বরং এটা স্পষ্ট হল যে পবিত্র কুরআন একটি যৌক্তিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ধর্মের শিক্ষাই তুলে ধরছে! অন্যদিকে তিন খোদার মতবাদসহ খ্রিস্ট ধর্মের নানা বিশ্বাস ও গির্জাগুলোর বক্তব্য বা দাবিগুলোই প্রশ্নের সম্মুখীন হতে লাগল। ইউরোপীয় বুদ্ধিবৃত্তিক আলোকায়ন বা এনলাইটেনমেন্টের যুগে সেখানকার কোনো কোনো লেখক ইসলামকে বিশুদ্ধ একত্ববাদী ও খাঁটি ঐশী ধর্ম এবং কুরআনকে বিশ্বজগতের স্রস্টার প্রশংসাসূচক ও যৌক্তিক বক্তব্যের বই হিসেবে দেখতেন। প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ও প্রাচ্যবিদ অ্যাডওয়ার্ড গিবন ছিলেন এমনই একজন ব্যক্তিত্ব। তিনি 'রোম সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন' শীর্ষক একটি বই লিখেছিলেন। ছয় খণ্ডের এ বই প্রকাশ হয়েছিল খ্রিস্টিয় ১৭৭৬ থেকে ১৭৮৮ সনে। ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ বই হিসেবে খ্যাত বইটির পঞ্চাশতম অধ্যায় ‘মুহাম্মাদ (সা) ও ইসলামের আবির্ভাব’ শিরোনামে পৃথকভাবে মুদ্রণ ও প্রকাশ করা হয়।

ইউরোপের কথিত ক্রুসেডার ও নতুন কিছু গবেষণার আলোকে মহানবীর (সা) জীবনী ও ইসলামের ইতিহাসের প্রারম্ভিক পর্যায়গুলো 'রোম সাম্রাজ্যের অবক্ষয় ও পতন' শীর্ষক বইয়ে তুলে ধরেছিলেন গিবন। তিনি মহানবীকে আধ্যাত্মিক নানা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এমন ব্যক্তি হিসেবে তুলে ধরেন যিনি মক্কায় বসবাসের সময় খাঁটি একত্ববাদ প্রচার শুরু করেছিলেন।

গিবন মহানবীর (সা) আবির্ভাব প্রসঙ্গে লিখেছেন,নিঃসন্দেহে খ্রিস্টানরা মুহাম্মাদ সম্পর্কে অশোভন কথা বলেছেন ও তাঁকে নীচ বা হীন বলে মনে করেছে। আর এভাবে তারা শত্রুর মর্যাদা ও গুরুত্ব কমাতে গিয়ে বরং তাঁর মর্যাদা ও সম্মান বাড়িয়ে দিয়েছে। এরপর তিনি মুসলমান ও খ্রিস্টানদের মতের অমিল তুলে ধরেন। মুসলমানদের বিশ্বাস তুলে ধরে গিবন লিখেছেন: ' মহান আল্লাহর কৌশল বা পরিচয় মানুষকে জানানো ও মানুষের মধ্যে আল্লাহর বিধি-বিধান প্রচলন করাই ছিল যুগে যুগে নবী পাঠানোর প্রকৃত উদ্দেশ্য। হযরত আদম থেকে কুরআন নাজিল হওয়ার সময় পর্যন্ত যত নবী এসেছেন তাঁদেরকে নির্ভরযোগ্য ও সত্যিকারের নবী মনে করতেন মুহাম্মাদ। এ দীর্ঘ সময়ে এক লাখ ২৪ হাজার নবী এসেছেন। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন বড় ধরনের নবী ও রাসুল। তাঁরা ছিলেন একই অপরিবর্তনীয় ধর্মের প্রচারক।'

গিবন এরপর লিখেছেন: 'মুসলমানদের কাছে এই মহান নবী-রাসুলদের সম্মান ও গ্রহণযোগ্যতা বেড়েছে। মহানবী (সা) মুসলমানদেরকে শিখিয়েছেন যে ঈসায়ি ধর্মের প্রবর্তককে ভালবাসতে ও সম্মান করতে হবে। মুসলমানদের এই সম্মান প্রদর্শনের সঙ্গে রহস্য লুকিয়ে আছে। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে:  'যখন ফেরেশতাগণ বললো, হে মারইয়াম আল্লাহ তোমাকে তাঁর এক বানীর তথা এক সম্মানিত অস্তিত্বের সুসংবাদ দিচ্ছেন, যার নাম হল মসীহ তথা মারইয়াম-তনয় ঈসা, দুনিয়া ও আখেরাতে তিনি মহাসম্মানের অধিকারী এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠদের অন্তর্ভুক্ত'। হযরত মুসা ও ঈসা যে শেষ নবীর আগমনের কথা বলেছিলেন সে প্রসঙ্গে গিবন লিখেছেন, 'মুসা ও ঈসা ধর্মকে ভালবাসতেন। তাঁরা ছিলেন আধ্যাত্মিক সাধক ও সংযমী। তাই তারা এমন একজন নবীর আবির্ভাবের ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলেন যিনি হবেন তাদের চেয়ে উত্তম ও বেশি মর্যাদার অধিকারী। তাঁরা এই নিশ্চিত বিশ্বাসের ব্যাপারে প্রফুল্ল ও সন্তুষ্ট ছিলেন।....মুহাম্মাদও ইসলাম ধর্মের ভিত্তিকে এ দুই ধর্মের তথা খ্রিস্ট ও ইহুদি ধর্মের সত্যতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করেন যা ইসলামের আগে ওহি হিসেবে মুসা ও ঈসার কাছে পৌঁছেছিল। মুহাম্মাদ এ দুই নবীর উত্তম গুণাবলী ও অলৌকিক ঘটনাগুলোতে বিশ্বাস করতেন।'

এরপর গিবন লিখেছেন,'মুহাম্মাদ আরবের মূর্তিগুলোকে মহান আল্লাহর আরশের সমীপে চূর্ণবিচূর্ণ করেন এবং নামাজ আদায়,দোয়া ও সাদক্বা প্রদানের মত পছন্দনীয় প্রথাগুলোকে নরবলির স্থলাভিষিক্ত করেন। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হল মুমিনদের মধ্যে ভালবাসা ও পরোপকারের অনুভূতি সৃষ্টি করা। তিনি তার অনুসারীদের এমনসব কাজ করতে বলতেন যেগুলো সমাজসহ অনেক ক্ষেত্রের জন্যই ছিল কল্যাণকর। তাঁর প্রচারিত মঙ্গলময় শিক্ষা ও বিধি-বিধানের সুবাদে লোভ, প্রতিহিংসা এবং বিধবা ও ইয়াতিমদের প্রতি জুলুম নিষিদ্ধ হয়। এ ছাড়াও বিবাদরত গোত্রগুলো একই ধর্মের অনুসারী হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়।'

অবশ্য ব্রিটিশ সাংসদ,ঐতিহাসিক ও প্রাচ্যবিদ অ্যাডওয়ার্ড গিবন তার এ বইয়ে নানা ঘটনার বর্ণনা দেয়ার সময় অনেক ভুলও করেছেন। তার এসব ভুল অনিচ্ছাকৃত এবং এসবের উৎস হল নানা বই ও ঐতিহাসিক সূত্রে উল্লেখিত ভুল বর্ণনা।  #

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।