মার্চ ১৪, ২০২০ ২২:৪০ Asia/Dhaka

আশা করি যে যেখানেই আছেন ভালো ও সুস্থ আছেন। আপনারা জানেন যে, ইরানের জলে-স্থলে, ক্ষেত-খামারে, বাগ-বাগিচায়, কল-কারখানায় উৎপাদিত হয় বিচিত্র পণ্য সামগ্রী। এর পাশাপাশি খনি থেকেও আহরিত হয় বিভিন্ন সামগ্রী।

ইরানি নরনারীদের মেধা ও মনন খাটিয়েও তৈরি করা হয় বিভিন্ন শিল্পপণ্য। গত আসরে আমরা আলোচনা করেছিলাম ইরানে মেশিনে তৈরি কার্পেটের ঐতিহ্য নিয়ে।

কাশানে মখমল এবং রেশমি পণ্য তৈরির বহু কারখানা আগে থেকেই ছিল। এসব কারখানারই একটির নাম হলো রভান্দ। ফারশে রভান্দ মানে রভান্দ কার্পেট। এই রভান্দ কোম্পানির কারখানাতেই চকচকে কৃত্রিম সূতা দিয়ে তৈরি করা হয় প্রথম কার্পেট। মখমলসহ কৃত্রিম সূতা দিয়ে কার্পেট বানানোর কারণে ওই কার্পেটের ওজন ছিল বেশ হালকা। হালকা কার্পেট ধোয়ার জন্য বেশ সুবিধাজনক। দেখতেও ঝকমকে। সুতরাং খুব সহজেই মেশিনে তৈরি কার্পেট ব্যবহারকারীদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। কালের আবর্তনে মেশিনে তৈরি কার্পেটের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে এবং চাহিদা বৃদ্ধির কারণে কার্পেট তৈরির বিচিত্র উপাদানেরও চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে কাশানের রভান্দ কার্পেট কোম্পানি প্রয়োজনীয় কাঁচামাল উৎপাদনেরও পরিকল্পনা হাতে নেয়। ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দেই প্রথমবারের মতো এই কারখানায় তৈরি কার্পেট বাজারে আসে।

রভান্দ কোম্পানির মেশিনে তৈরি কার্পেটগুলো দেখতে অনেকটাই হাতে বোণা কার্পেটের মতো। সে কারণে ব্যবহারকারীদের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় খুব সহজেই। চাহিদার দিকে তাকিয়ে রভান্দের পাশাপাশি আরও বহু কার্পেট কোম্পানি মেশিনে তৈরি কার্পেট উৎপাদনের ব্যাপারে আগ্রহী হয়। গিলান, পার্স, নাকশে ইরান এবং একবাতানের মতো নামকরা ব্র্যান্ডগুলো মেশিনে তৈরি কার্পেট উৎপাদনে এগিয়ে আসে এবং ব্যাপকভাবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। এখন অবশ্য এই মেশিনে তৈরি কার্পেট উৎপাদনের ক্ষেত্রে নামি দামি বহু কোম্পানি তৎপর রয়েছে। এদের মধ্যে কয়েকটি কোম্পানির নাম করা যেতে পারে যেমন, গলিয়ে সোলায়মান, ফারশে মাশহাদ, শিরাজ, মজান্দারন, সেতারেহ কাভির, বস্তনসহ আরও বহু কার্পেট কোম্পানি।

মেশিনে তৈরি কার্পেট উৎপাদনের তিনটি ধাপ রয়েছে। সূতা কাটা পর্ব, বুণন পর্ব এবং পরিপূর্ণ কার্পেট পর্ব। মেশিনে তৈরি কার্পেট উৎপাদনের প্রথম ধাপের শুরুতেই কারখানায় তুলা আনা হয়। এরপর রঙের কাজ সেরে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সূতা কাটা বিভাগে। এই বিভাগেই কার্পেটের জন্য প্রয়োজনীয় সুতা তৈরি করা হয়। সূতা তৈরি হয়ে যাবার পর পরবর্তী ধাপ হলো বুণন কাজ। এই কাজটিই এখন মেশিনের সাহায্যে করা হয়। কার্পেট বুণনের কাজ শেষ হয়ে যাবার পর আসে সর্বশেষ ধাপ। এই ধাপে কোয়ালিটি কন্ট্রোল করা হয়। ফিনিশিং দেয়া, অতিরিক্ত সূতা কেটে ফেলা, কার্পেটের চারপাশে জিগজাগ সেলাই দেওয়া, রোল করা এবং সবশেষে প্যাকিং করা পর্যন্ত সকল কাজ এই পর্বে করা হয়। প্যাকিং শেষে প্রস্তুতকৃত কার্পেট বিক্রির জন্য নির্ধারিত বাজারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ইরানের জাতীয় অর্থনীতির যোগানের ক্ষেত্রে কার্পেট শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম। ইরানের বাণিজ্য, খনি ও শির্প মন্ত্রণালয় তাই কার্পেট শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। বছরে এখন বারো কোটি বর্গমিটার মেশিনে তৈরি কার্পেট উৎপাদন হয় ইরানে। টেক্সটাইল শিল্পে যত জনবল নিয়োজিত রয়েছে তার শতকরা দশ ভাগই কার্পেট শিল্পে কাজ করছে। কার্পেট উৎপাদনে তৎপর ইরানের অঞ্চলগুলোর কথা বলা যেতে পারে। ইরানের মাশহাদ শহর, তেহরান, ইয়াযদ, ইস্ফাহান এবং দেলিজানেই বেশিরভাগ কার্পেট উৎপন্ন হয়। ইস্ফাহান প্রদেশের যে শহরগুলোতে কার্পেট তৈরি হয় সেগুলোর মধ্যে অরন, বিদগোল এবং কশনের নাম উল্লেখযোগ্য। ইরানের কার্পেট তৈরির কারখানার আশিভাগ এইসব এলাকায় অবস্থিত। সমগ্র ইরানে উৎপাদিত মেশিনে তৈরি কার্পেটের প্রায় সত্তর ভাগ উৎপন্ন হয় এখানে। সুতরাং সহজেই ভাবা যেতে পারে এই এলাকার মানুষের প্রধান পেশা কোনো না কোনোভাবে কার্পেট শিল্পের সঙ্গে জড়িত।

কাশানের কারাখানায় উৎপাদিত কার্পেটের গুণগত মান বেশ উন্নত এবং ব্যবহারকারীদের পছন্দের তালিকার শীর্ষে রয়েছে। বিশেষ করে এখানকার মেশিনে তৈরি কার্পেটগুলোর রঙ, ডিজাইন ইত্যাদি দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশের ক্রেতাদেরও মন ছুঁয়েছে। কাশানের কার্পেট অন্তত চল্লিশটি দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, তুরস্ক, জার্মানি, ব্রিটেন, চীন, পাকিস্তান, ইরাক, আফগানিস্তানসহ সেন্ট্রাল এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলো। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মেশিনে তৈরি কার্পেট শিল্প উৎপাদনের গুণগত মানের দিক থেকে বিশ্বে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। আবার কার্পেট উৎপাদনের পরিমাণের দিক থেকেও বিশ্বে দ্বিতীয় রয়েছে ইরান।

মিউজিক শোনার আগে আমরা ইরানি কার্পেটের গুণগত মান এবং উৎপাদনের দিক থেকেও ইরানের শীর্ষস্থানে অবস্থান প্রসঙ্গে কথা বলছিলাম। মেশিনে তৈরি কার্পেটের রঙ, ডিজাইন এবং বুণনের ক্ষেত্রে ইরানি শিল্পী কলাকুশলিরা বেশ দক্ষতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছে। তাদের এই সৃজনশীলতাই কার্পেট শিল্পের উন্নয়নের পাশাপাশি এই শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মেশিনারিজ বা যন্ত্রপাতি তথা প্রযুক্তি ও কারিগরি উন্নয়নেও পরিবর্তন এনে দিয়েছে। বুণন শিল্পের মেশিনারিজ তৈরি করেন যারা তাঁরা মেশিনের সাহায্যে হাতে বোণা কার্পেটের মতো গুণমান রক্ষা করার উপযোগী যন্ত্রপাতিও তৈরি করতে মনোনিবেশ করেছেন। কার্পেট শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিল্পপতিদের এই অগ্রগতি ও সৃজনশীল চিন্তা এই শিল্পকে যে অচিরেই উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দেবে তা ভাবাটা মোটেই অযৌক্তিক হবে না।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ ১৪