কুরআনের আলো
সূরা আস-সাফফাত: আয়াত ১২৩-১৩২ (পর্ব-১৫)
পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা আস-সাফফাতের ১২৩ থেকে ১৩২ নম্বর আয়াতের তাফসির উপস্থাপন করা হবে। এই সূরার ১২৩ থেকে ১২৬ আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
وَإِنَّ إِلْيَاسَ لَمِنَ الْمُرْسَلِينَ (123) إِذْ قَالَ لِقَوْمِهِ أَلَا تَتَّقُونَ (124) أَتَدْعُونَ بَعْلًا وَتَذَرُونَ أَحْسَنَ الْخَالِقِينَ (125) اللَّهَ رَبَّكُمْ وَرَبَّ آَبَائِكُمُ الْأَوَّلِينَ (126)
“এবং নিশ্চয়ই ইলিয়াস ছিল (আমার) রাসূল।” (৩৭:১২৩)
“যখন সে তার সম্প্রদায়কে বলল: তোমরা কি ভয় কর না?” (৩৭:১২৪)
“তোমরা কি বা'আল দেবতার এবাদত করবে এবং সর্বোত্তম স্রষ্টাকে পরিত্যাগ করবে?” (৩৭:১২৫)
“যে আল্লাহ তোমাদের পালনকর্তা এবং তোমাদের পূর্বপুরুষদের পালনকর্তা?” (৩৭:১২৬)
হযরত ইব্রাহিম ও হযরত মুসা আলাইহিমুস সালামের ঘটনা বর্ণনা করার পর এই চার আয়াতে আল্লাহর আরেক নবী হযরত ইলিয়াস (আ.)’র সত্য কাহিনী উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হচ্ছে: তিনি সর্বপ্রথম তাঁর জাতিকে মূর্তিপূজা ও শিরক এবং যেকোনো ধরনের গোনাহ ও জুলুম পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান। বেপরোয়া ও জালিম মানুষেরা আল্লাহর সঙ্গে অন্য কাউকে শরিক করে এবং এর ফলে তাদের আত্মা মরে যায়। এ কারণে তারা সবচেয়ে নিকৃষ্ট পাপকাজ করতেও দ্বিধা করে না। হযরত ইলিয়াস (আ.) মূর্তিপূজকদের উদ্দেশ করে বলেন: যে মূর্তি তোমরা নিজেদের হাতে তৈরি করো সেই মূর্তির সামনে কীভাবে মাথানত করো? অথচ তোমরা নিজেদের স্রষ্টাকে সম্পূর্ণ ভুলে গেছ। তোমাদের এই মূর্তিগুলোর কি কোনো কিছু সৃষ্টি করার ক্ষমতা আছে যে, এগুলোর সামনে মাথানত করছো? তোমরা, তোমাদের পূর্বপুরুষ এবং তোমাদের সন্তানদের তৈরি করার ক্ষমতা কি এসব মূর্তির আছে?
আল্লাহর নবী তাঁর জাতিকে উদ্দেশ করে আরো বলেন: কেন তোমাদের ও তোমাদের পূর্বপুরুষদের অস্তিত্ব সৃষ্টিকারী এবং বিশ্বজগত পরিচালনাকারী আল্লাহকে ত্যাগ করে তোমরা এসব নিষ্কর্মা মূর্তির কাছে ধর্না দিচ্ছো? মূর্তিপূজকরা হযরত ইলিয়াসের প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে অন্য কোনো যুক্তি দেখাতে না পেরে শুধু একথা বলত যে, তাদের পূর্বপূরুষরাও যেহেতু এসব মূর্তির পূজা করত তাই তারাও একই কাজ করে। এর জবাবে আল্লাহর নবী তাদেরকে বলেন, তোমাদের পূর্বপুরুষদেরও তো আল্লাহ তায়ালাই সৃষ্টি করেছিলেন, মূর্তিরা নয়।
এ চার আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে:
১- সব নবী-রাসূলগণ মানব জাতিকে এক আল্লাহর ইবাদত করতে এবং তিনি ছাড়া অন্য সব কিছুর পূজা করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
২- নবীরা মানুষকে হেদায়েত করতে গিয়ে মানুষের বোধগম্য প্রশ্ন উত্থাপন করেন যাতে তাদের উদাসিনতার ঘুম ভাঙে। মানুষের সামনে যখন সর্বশক্তিমান ও মহাপরাক্রমশালী আল্লাহর বিপরীতে নিষ্কর্মা মূর্তির তুলনা করা হয় তখন সুস্থ বোধসম্পন্ন মানুষের অন্তর জাগ্রত না হয়ে পারে না।
সূরা সাফফাতের ১২৭ থেকে ১২৯ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে বলা হয়েছে:
فَكَذَّبُوهُ فَإِنَّهُمْ لَمُحْضَرُونَ (127) إِلَّا عِبَادَ اللَّهِ الْمُخْلَصِينَ (128) وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الْآَخِرِينَ (129)
“অতঃপর তারা তাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল। অতএব তাদেরকে অবশ্যই (এই কুফরির কারণে বিচার করার জন্য) তলব করা হবে।" (৩৭:১২৭)
“কিন্তু আল্লাহ তা'আলার খাঁটি বান্দাগণকে (তলব করা হবে না)।” (৩৭:১২৮)
“আমি পরবর্তীদের মধ্যে তাদের জন্য (সুনাম ও সুখ্যাতি) রেখে দিয়েছি।” (৩৭:১২৯)
অতীতের বহু নবী রাসূলের মতো হযরত ইলিয়াস (আ.)’র উম্মতের বেশিরভাগ মানুষ তাকে নবী হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। কি কি কারণে মূর্তিপূজা ত্যাগ করা জরুরি এসব মানুষ সেকথা শুনতেই রাজি হয়নি। পবিত্র কুরআন বলছে: এ ধরনের অস্বীকৃতির পরিণতিতে মানুষ নানা ধরনের জঘন্য পাপকাজে লিপ্ত হয় এবং আল্লাহ তায়ালার আজাবে নিপতিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করে। শুধুমাত্র অল্প কিছু মানুষ হযরত ইলিয়াস (আ.)’র প্রতি ঈমান আনে এবং খাঁটি মনে আল্লাহর ইবাদত করে। এসব মানুষ মহান সৃষ্টিকর্তার আজাব থেকে রক্ষা পায়। পরবর্তী আয়াতে বলা হচ্ছে: মহান আল্লাহ নবী-রাসূলদের পরিশ্রমকে স্বীকৃতি দেন এবং যুগ যুগ ধরে মানুষের মধ্যে তাঁদের সুনাম সুখ্যাতি ছড়িয়ে দেন।
এই তিন আয়াতের কয়েকটি শিক্ষণীয় দিক হচ্ছে:
১- মানুষের জীবনের সফলতা তার পার্থিব জীবনের ওপর নির্ভর করে না বরং তার কর্মের পরিণতি কিয়ামতের দিন স্পষ্ট হবে। সেদিন বোঝা যাবে তারা সফল ও জান্নাতবাসী নাকি ব্যর্থ ও জাহান্নামবাসী।
২- খাঁটি মন নিয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদত হচ্ছে মানুষের মুক্তির একমাত্র উপায়। কিন্তু রিয়া বা লোকদেখানো ইবাদত মানুষকে আল্লাহর ক্রোধ থেকে মুক্তি দিতে পারবে না।
এই সূরার ১৩০ থেকে ১৩২ নম্বর পর্যন্ত আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:
سَلَامٌ عَلَى إِلْ يَاسِينَ (130) إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ (131) إِنَّهُ مِنْ عِبَادِنَا الْمُؤْمِنِينَ (132)
“ইলিয়াসের প্রতি সালাম ও দরুদ বর্ষিত হোক!” (৩৭:১৩০)
“এভাবেই আমি সৎকর্মশীলদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি।” (৩৭:১৩১)
“সে ছিল আমার বিশ্বাসী বান্দাদের অন্তর্ভূক্ত।” (৩৭:১৩২)
হযরত ইলিয়াস (আ.)’র ইতিহাস বর্ণনা করার পর কুরআনে কারিমে বলা হচ্ছে: আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী ইলিয়াসের প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করছেন। ১৩০ নম্বর আয়াতে ইলিয়াসের পরিবর্তে ইলিয়াসিন শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে যেটি হযরত ইলিয়াসেরই আরেকটি নাম। যেমন সিনা ও সিনিন একই ভূখণ্ডের নাম।
সূরা সাফফাতে কয়েকজন নবীর ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করে সবশেষে এসব নবীর ভূয়সী প্রশংসা করে তাদের প্রতি দরুদ ও সালাম পেশ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলছেন: আমি এভাবেই আমার সৎকর্মশীল বান্দাদের পুরস্কৃত করি।
হযরত ইলিয়াস (আ.) সংক্রান্ত আলোচনার শেষাংশেও এই একই বিষয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হচ্ছে: আল্লাহর রাস্তায় জীবন উৎসর্গকারী এবং পরোপকারী ব্যক্তিদের কর্ম ও পরিশ্রমকে আল্লাহ তায়ালা বিফলে যেতে দেন না। মহান আল্লাহর বিধান হচ্ছে- সৎকর্মশীলদের সর্বোত্তম পুরস্কার দান করা। নবী রাসূলদের পাশাপাশি যেকোনো সাধারণ মানুষও এই সৎকর্মশীল ব্যক্তিদের অন্তর্ভূক্ত হতে পারেন। শর্ত হচ্ছে, আল্লাহর প্রতি ঈমান এনে তাঁর নির্দেশিত পথে চলতে এবং গুনাহমুক্ত জীবনযাপন করতে হবে। কিন্তু যে ব্যক্তি নিজের স্রষ্টা আল্লাহকে অস্বীকার করে এবং তাঁর সামনে মাথানত করতে অপারগতা প্রকাশ করে সে ব্যক্তি ভালো কাজ করলেও আল্লাহর কাছে সে কোনো পুরস্কার পাবে না। সে দুনিয়াতে যাদের জন্য কাজ করবে তাদের কাছ থেকে প্রশংসা ও প্রতিদান পাবে কিন্তু পরকালে তার কোনো প্রতিদান নেই। শুধুমাত্র ঈমান না থাকার কারণে তার ভালো কাজের কোনো মূল্য আল্লাহ দেবেন না।
এই তিন আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:
১- আমাদের উচিত আল্লাহর কাছ থেকে নবী-রাসূল ও আউলিয়াদের সালাম দেয়ার শিক্ষা নেয়া।
২- সৎকর্মশীল ও নেককার বান্দাদের প্রতি বিশেষ অনুগ্রহ আল্লাহ তায়ালার অন্যতম রীতি এবং এ রীতি কিয়ামত পর্যন্ত চালু থাকবে।#