জুন ২৬, ২০২০ ১৩:২৯ Asia/Dhaka

করোনার মধ্যে বাংলাদেশের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট এবং স্বাস্থ্যখাত নিয়ে রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ, সরকারের সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান ও বিশিষ্ট সাহিত্যিক ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ বলেছেন, ‘বাজেটে বরাদ্দ কতটা-তার চেয়ে বড় কথা সক্ষমতা, অবকাঠোমো এবং বাস্তবায়ন’।তিনি বলেন, করোনায় মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। সাক্ষাৎকারটি তুলে ধরা হলো। এটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবুদর রশীদ

রেডিও তেহরান: ড. আবদুল মজিদ, বিশ্ব মহামারি করোনার মধ্যে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট পেশ করা হয়েছে। তো এ বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ  সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?

ড. আবদুল মজিদ: ধন্যবাদ। বাংলাদেশে প্রায় এক দশক ধরে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাখাতের বরাদ্দ কমেই যাচ্ছিল। এইখাতে যেখানে জিডিপির  তিন বা চার শতাংশ হওয়া উচিত ছিল। সেখানে পয়েন্ট সাত কিংবা পয়েন্ট আট ভাগ চলে গিয়েছিল বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ।

করোনাকালে বাংলাদেশের বাজেট চিত্র

তো যাইহোক, করোনার কারণে লক্ষ্য করা গেল এমনিতেই তো স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ অপ্রতূল ছিল তারপরও এর আগে যথাযথভাবে সেই বরাদ্দ ব্যবহৃত হয় নি। নানাধরণের অব্যবস্থানা, স্বাস্থ্যখাতের ক্রয়ে দুর্নীতিসহ আরও বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্যখাত একদমই নিগৃহীত ছিল। তারই ফলাফল পাওয়া গেল বিশ্ব মহামারি করোনা মোকাবেলার সময়। এসময় দেখা গেল স্বাস্থ্যখাতটি খুবই অপ্রস্তুত অবস্থায় থাকা একটি খাত। সেই নিরিখে এবারের বাজেটে বিভিন্নমহল থেকে দাবি উঠেছে; পরামর্শ দেয়া হয়েছে যে, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এবারের বাজেটে স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বেড়েছে কিছুটা। তবে যাই বাড়ুক সেটা খুব বেশি না। খুব বেশি বাড়ান সম্ভব নয়। কারণ আমাদের অর্থনীতিতে জিডিপির যে আকার এবং অনান্য খাতের যে ডিমান্ড সেই টাকা থেকে বাঁচিয়ে স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ বেশি করা আসলে খুব কঠিন। কিন্তু এখানে বিবেচনার বড় বিষয়টি হচ্ছে, বরাদ্দ যাইহোক সেটি ব্যবহার করার সক্ষমতা বা সেটার সংস্থাপনের সক্ষমতা এবং অবকাঠানো আছে কি না? সেটি গড়ে উঠেছে কি না? শুধু বরাদ্দ বাড়িয়ে দিলেই যে স্বাস্থ্যখাত সুস্থির হয়ে উঠবে তেমনটি নয়। সরকার স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ বাড়িয়েছে। আর বাড়ানোটাই যুক্তিযুক্ত হবে যদি তা যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হয়। 

 রেডিও তেহরান:  ড. আবদুল মজিদ, আপনি যেমনটি বললেন, এবারের বাজেটে স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ বাড়ান হয়েছে এবং সেটাই যৌক্তিক। তো এ প্রসঙ্গ ধরেই জানতে চাইব, মহামারি করোনা অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা নিয়ে নানা প্রশ্ন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের সক্ষমতা আপনার দৃষ্টিতে কেমন?

ড. আবদুল মজিদ: দেখুন, স্বাস্থ্যখাত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত যেখানে সরকারি বিনিয়োগ না হলে মানুষ বড়রকমের সমস্যায় পড়বে। আর সেজন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত জিডিপির কমপক্ষে দুই বা তিন ভাগ স্বাস্থ্যখাতের জন্য বরাদ্দ দিতে হবে। একইসাথে সক্ষমতা বৃদ্ধি বা অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। একেবারে দূরগ্রাম পর্যন্ত স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে যাওয়ার  বিষয়টি থাকে। এটাই থাকে উদ্দেশ্য। আর সেভাবেই বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে আমাদের জিডিপির শতকরা ১ ভাগও স্বাস্থ্যখাতের বরাদ্দ ছিল না। আর যেটুকু ছিল সেটাও যথাযথভাবে বা পরিকল্পিতভাবে ব্যবহার করা হয় নি। এক্ষেত্রে অনেক উদাহরণ দেয়া যাবে। এবার করোনার সময় দেখলাম হাসপাতাল আছে, বেড আছে কিন্তু সেভাবে লোকবল নেই। চিকিৎসকের পোষ্টিং আছে কিন্তু সেখানে তিনি থাকেন না। এই যে প্রশাসনিকসহ অন্যান্য যেসব বিষয় আছে সেগুলো সমানতালে দেখা না হলে বরাদ্দ কম বেশিতে তো কিছু যায় আসে না।

কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্য সেবাদান

দেখুন, আমাদের স্বাস্থ্যখাতে একেবারে গ্রাম পর্যায়ে কমিউনিটি ক্লিনিক আছে। এটি সরকারের খুব ভালো একটা উদ্যোগ। কিন্তু এই কমিউনিটি ক্লিনিকে ডাক্তার আছে কিনা, মানুষের সহজ অ্যাকসেস আছে কিনা কিংবা যেসব সাধারণ ওষুধ থাকার কথা সেগুলো আছে কি না; সেটি  দেখার বিষয় আছে। যে কারণে আমরা সবাই বর্তমানে পরামর্শ দিচ্ছি বা বলছি সামাজিক নিরাপত্তা খাতে দরিদ্র দুঃস্থ বা বিধবাদের যেসব টাকা দেয়া হচ্ছে শুধু এই টাকা দিলে হবে না। যদি তাদের চিকিৎসার কোনো বিষয় থাকে এবং চিকিৎসা করতে গিয়ে যদি তাকে যে টাকা দেয়া হচ্ছে তার সব খরচ হয়ে যায় তাহলে তো এটি অর্থবহ হবে না। বরং যদি যে টাকা দেয়া হচ্ছে তা থেকে একটা অংশ কেটে নিয়ে কমিউনিটি  ক্লিনিককে শক্তিশালী করা উচিত। দরিদ্র দুঃস্থ বা বিধবাটি যদি তার দোর গোড়ায় চিকিৎিসা সেবা পায় তাহলে তো তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে  দুশ্চিন্তা দূর হতে পারে। সুতরাং সক্ষমতা বৃদ্ধিটাই হবে প্রধান বিষয়।

রেডিও তেহরান: ড. আবদুল মজিদ, করোনার কারণে বিশ্বের প্রায় ৫০ ভাগ মানুষ জীবিকা হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে বলে জানিয়েছে আইএমএফ। তো অর্থনৈতিক এ ঝুঁকির বাইরে সামাজিক এবং মানসিক যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে করোনায় সে সম্পর্কে আপনি কি বলবেন?

ড. আবদুল মজিদ: খুব সুন্দর একটা বিষয়ে আপনি প্রশ্ন করেছেন। আমি এ বিষয়ে একটা কলাম লিখেছি। যা জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে। করোনায় মারাত্মকভাবে মানসিক এবং সামাজিক সংকট সৃষ্টি করেছে। মহামারি করোনা প্রথমত একজন মানুষের স্বাস্থ্যগত সমস্যা সৃষ্টি করেছে। করোনায় দ্বিতীয় সমস্যাটি হচ্ছে অর্থনৈতিক। কারণ সাধারণ মানুষ করোনায় বেকার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু  তৃতীয় ক্ষতিটা খুবই মারাত্মক। করোনায় মানুষের আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান, মানবিক মর্যাদাবোধ, মানুষের প্রতি মানুষের সহানুভূতি দেখানোর যে চিরন্তন সংস্কৃতি বা ধর্ম সেটিকে একদম নড়বড়ে করে দিয়েছে কোভিড-১৯।

করোনা ভাইরাসে মানুষ পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে

সামাজিক দূরত্ব রক্ষাা করার কথা বলা হচ্ছে। হ্যাঁ একথা ঠিক সামাজিক দূরত্বটা কখনও কখনও ঠিক রাখা হচ্ছ; কখনও না। কিন্তু বিষয়টি এমন হয়ে গেছে যে মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। মানুষ পারিবারিক এবং সামাজিকভাবে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এমন একটা ভয় ও আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে প্রতিটি মানুষ ইনডিভিজুয়াল হয়ে গেছে।

ধরুন, শোনা গেল একটা বাড়িতে করোনার রুগী আছে। অমনিই সেখানে লকডাউন করা হলো। সেই বাসায় বাচ্চাসহ অন্যরা আছে। অথচ প্রতিবেশিীরা এসে এমন একটি বাড়িতে ছয়টা তালা লাগিয়ে গেছে। যাতে তারা না বেরোতে পারে। মিডিয়ায় এমন খবর এসেছে। অথবা কেউ  বিদেশ থেকে যারা দেশে ফিরেছেন। প্রবাসীরা আমাদেরকে রেমিটেন্স পাঠান। তারা বিদেশে চাকরি হারিয়ে কষ্ট নিয়ে দেশে ফিরেছেন। তারা নিদারুণ মানসিক অসুবিধা নিয়ে ফিরেছেন। অথচ দেশে ফেরার পর তাদেরকে জরিমানা করা হচ্ছে। কোয়ারেন্টাইন মানেনি, কেন মানল না এসব কারণে। তাদের বাড়িতে লাল ফ্লাগ টাঙিয়ে দেয়া হচ্ছে। এরঅর্থ হচ্ছে এই বাড়িতে একজন আসামি আছে বা এধরনের কিছু অর্থ...! এই যে অমানবিক আচরণের একটা চিত্র ফুটে উঠছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়। 

যেমন ধরুন, আমি মারা গেলে আমার জানা হবে কিনা সেটা আমি নিজেও জানি না। সাধারণ সময় আমরা যেটা করতাম কেউ অসুস্থ হলে আমরা হাসপাতালে তাকে দেখতে যেতাম। তার প্রতি সহানুভূতি দেখাই। কিন্তু এখন করোনায় এমন একটা ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে যে মানুষ মানুষ থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। আমার দৃষ্টিতে এটি তৃতীয় এবং অনেক বড় ক্ষতি। দেখতে হবে মানুষ যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে যায়। মানুষের যে সহজাত সহানুভূতি, প্রত্যাশা মনোবল, মানসিক চিন্তাশক্তি সেটা যেন ভেঙ্গে  না যায়। দৈন্য আশা কুহকিনী' বলে যে কথাটা কবি বলেছেন, সেই আশাতো থাকছে না। কোথায় সেই আশা? সেই আশা যাতে জিইয়ে থাকে সে বিষয়টি দেখতে হবে সবাইকে। এর পেছনে বড় ধরণের একটা শক্তি বা প্রবণতা কাজ করেছে। আর সেটি হচ্ছে মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলা এবং মানুষের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করা।

 রেডিও তেহরান: জনাব, ড, মোহাম্মদ আবদুল মজিদ, সবশেষে আপনার বক্তব্যের প্রসঙ্গ ধরেই জানতে চাইব-করোনায় যে মানুষের মধ্যে মানবিকতা এবং ভালোবাসা লোপ পেয়েছে। যে বিবেকহীনতা তৈরি হয়েছে সে সম্পর্কে বিশ্বজুড়ে রেডিও তেহরানের শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কি বলবেন?
ড. আবদুল মজিদ: রেডিও তেহরানের বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে আমি বলব, আমরা মানুষ। আমরা মহান আল্লাহর সৃষ্টি। আমরা আল্লাহর প্রতিনিধি। সুরা বাকারার ৩০ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ফেরেশতাদের বলেছেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি সৃষ্টি করব। মানুষকে আল্লাহর প্রতিনিধি করা হয়েছে। আমরা তো বলছি, আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি। আর আমরা মানুষ পৃথিবীতে আল্লাহর প্রতিনিধি। আল্লাহ নিজে এসে কাজ করেন না। আমার মাধ্যমেই আল্লাহ কাজ করান। আল্লাহর ৯৯ টা নামের মধ্যে ৩৬ টা নামের অর্থ হচ্ছে তিনি সহানুভূতিশীল। 'তুমি সর্প হয়ে দংশন কর ওঝা হয়ে ঝাড়' অর্থাৎ একইসাথে ব্যালেন্সিং'র বিষয়টি আছে। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্ক হচ্ছে মহব্বত এবং রহমতের। সুফিবাদে প্রেমের কথা খুব বেশি করে বলা হয়েছে। মানুষের সম্পর্কের বড় ভিত্তি হচ্ছে 'প্রেম'। আর সেই মৌলিক বিষয়টি যদি আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে যায় তাহলে তো পৃথিবীতে বসবাস করার আর কোনো পরিবেশ থাকে না। ফলে আমরা সবাই একটা আত্ম জীজ্ঞাসায় ব্যপৃত হই যে, পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক, সাহানুভূতি দেখান কিংবা মানবিক হওয়ার বিষয়টি সেটি যেন ভুলে না যাই। আর সেজন্যেই আমি বলতে চাই এভাবে যে, আমরা শুধু দুই হাত ধৌত করি না সাথে সাথে আমাদের বিবেককেও ধৌত করতে হবে। শুধু সাবান দিয়ে দুই হাত ধুলেই আমাদের মানবিকতার উন্নতি হবে।

রেডিও তেহরান: তো জনাব ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ-করোনা পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশের ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেট এবং স্বাস্থ্যখাতসহ অন্যান্য বিষয়ে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ড.আবদুল মজিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।#
 

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/২৬
 

ট্যাগ