জুন ৩০, ২০২০ ১৮:৫৭ Asia/Dhaka
  • সমগ্র বিশ্বে রয়েছে ইস্ফাহানের ব্যাপক পরিচিতি ও সুনাম

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান। গত আসর পর্যন্ত আমরা ইরানের নামকরা প্রদেশ চহর মাহলে বাখতিয়রির কয়েকটি শহর ঘুরে ঘুরে দেখেছি।

চহর মাহলে বাখতিয়রি ইরানের একটি রূপকথার শহর। এখানে রয়েছে লোক সাহিত্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিমণ্ডলে একটি সংহত সমাজ মানস থেকে এর উদ্ভব। গত আসরে আমরা বলেছিলাম যে চহর মাহলে বাখতিয়রি প্রদেশটির একটি অংশে হাফত লাঙ নামক বাখতিয়রি উপজাতিদের একটি গোত্র বসবাস করত। ইরানে বহু উপজাতীয় গোত্র রয়েছে। বাখতিয়রি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী গোত্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে।

এই গোত্রের লোকজন অতিথি আপ্যায়নের ব্যাপারে বেশ খ্যাতিমান। তাদের রয়েছে পোশাক আশাকের নিজস্ব সমৃদ্ধ ঐতিহ্য। পাহাড়ের পাদদেশের আপাত সমান্তরালে তারা কালো রঙের তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করে। এখানকার কুহরাং শহর প্রত্যেক ঋতুতেই আলাদা আলাদা প্রাকৃতিক  রূপ পরিগ্রহ করে। প্রতি বছর বসন্তে এখানকার অধোমুখি টিউলিপ ফুলের বাগান বা ক্ষেত দেখতে বহু মানুষ ভিড় জমায়। আজকের আসরে আমরা যাবো ইরানের বিখ্যাত শহর ইস্ফাহানের দিকে। অর্ধ বিশ্ব খ্যাত এই ইস্ফাহান প্রদেশে রয়েছে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন এবং প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্যাবলি।

ইস্ফাহান প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহর ইস্ফাহান নামেই পরিচিত। ইরানের সুন্দরতম, বিখ্যাত এবং পর্যটক আকর্ষণীয় শহর ইস্ফাহান। কেন এতো বিখ্যাত এই ইস্ফাহান? কারণ এই শহরটি ইসলামি সভ্যতার লালনভূমি এবং ইসলামি সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। প্রচুর প্রাচীন ঐতিহ্য আর সভ্যতার নিদর্শন থাকার কারণে ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে অনেক আগেই। তার পাশাপাশি এখানকার বিশেষ সাতটি স্থাপনা বা নিদর্শন ইউনেস্কোর তালিকাতেও স্থান করে নিয়েছে। এ কারণে ইরানের অন্যান্য প্রদেশের মধ্যেও ইস্ফাহানের একটা বিশেষ স্থান যেমন রয়েছে তেমনি সমগ্র বিশ্বেও রয়েছে ইস্ফাহানের ব্যাপক পরিচিতি ও সুনাম।

যে রকম সুনাম রয়েছে পৃথিবীর আরও বহু শহরেরও। যেমন চীনের শিয়ান, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর, ইতালির ফ্লোরেন্স, রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গ, স্পেনের বার্সেলোনা,  জার্মানির ফ্রাইবুর্গ, কিউবার হাভানা, পাকিস্তানের লাহোর এবং সেনেগালের ডাকার ইত্যাদি শহর। সুন্দর এবং বিখ্যাত এই শহর ইস্ফাহানের ইতিহাসও কিন্তু ব্যাপক চড়াই উৎরাইময়। অনেক ধ্বংসলীলার নীরব সাক্ষী এই ঐতিহাসিক শহরটিও। ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে এই ইস্ফাহান হামলার শিকার হয়েছে। আবার ধ্বংসলীলা কাটিয়ে উঠে পুনরায় আপন ঐশ্বর্যে সুষমামণ্ডিতও হয়েছে। ইস্ফাহান শহরের বেশিরভাগ নিদর্শনই ইসলাম পরবর্তীকালের বিশেষ করে সালজুকি এবং সাফাভি শাসনামলের। এই সময়পর্বের নিদর্শনগুলোর মধ্যে রয়েছে বহু মসজিদ, সরাইখানা, স্কোয়ার, ব্রিজ, স্ট্রিট ইত্যাদি।

ব্যাপক ভাঙাগড়া আর উত্থান-পতনের পর ইস্ফাহান শহরে যেসব নিদর্শন রয়েছে সেগুলোর মধ্যে স্থাপত্যশৈলির কিছু প্রাচীন নমুনা এখনও দেখতে পাওয়া যাবে। ঐতিহাসিক কিছু স্থাপনা যেমন গম্বুজ নির্মাণ, টাইলসের ঐতিহ্যবাহী কারুকাজ, চুনাচকের কারুকাজ, সিমেন্ট বালুর তৈরি নকশা, কাঠের ওপরে খোদাই করা লতাপাতার নকশা ইত্যাদি কারুকাজসহ চমৎকার ক্যালিগ্রাফি বা চারুলিপির অবিকৃত কাজও দেখা যায় যেগুলো ইরানের এই ঐতিহাসিক শহরটির আভিজাত্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ফ্রান্সের বিখ্যাত লেখক অঁন্দ্রে মালরো তাই এই শহর সম্পর্কে বলেছেন: ইস্ফাহানকে শুধুমাত্র বেইজিং এবং ফ্লোরেন্স শহরের সঙ্গেই তুলনা করা যায়। ইস্ফাহানের বিচিত্র সৌন্দর্য বা আকর্ষণ এই শহরটিকে ইরানের সবচেয়ে বেশি পর্যটক আকর্ষণীয় শহরে পরিণত করেছে।

ইরানের রাজধানী শহর তেহরান থেকে চার শ পঁয়ত্রিশ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ইস্ফাহান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এই শহরের উচ্চতা এক হাজার পাঁচ শ সত্তর মিটার। জার্দকূহ বাখতিয়রি পাহাড় থেকে উৎপন্ন ঝরনাধারার বহমানতা থেকে সৃষ্ট জয়ান্দেরুদ নদী এই ইস্ফাহান শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়ার কারণে শহরের সৌন্দর্য বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। তাছাড়া ইস্ফাহান শহরটি ইরানের একেবারে কেন্দ্র স্থানীয় শহর। ঐতিহাসিক কাল পরিক্রমায় এই শহরটি বহু ঘটনা-দুর্ঘটনার সাক্ষ্য বহন করছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই একমত যে ইস্ফাহান শহরটির গোড়াপত্তন করেছিলেন পিশদাদিয়ান রাজবংশের তৃতীয় বাদশাহ তাহমোরাস। ইরানে যখন আলেক্সান্দার মাকদুনি হামলা চালিয়েছিল তখন ইস্ফাহান ছিল গাবিভদের কেন্দ্রিয় শহর। ইস্ফাহানের ইতিহাসে গাবিভ গোত্রের নাম গেই কিংবা জেই অথবা গাবায়ি বা তাবায়ি নামে উল্লেখ করা হয়েছ।

হাখামানেশিদের সময় ইস্ফাহান শহরে ছিল শাসকদের রাজকীয় বাসভবন। বিভিন্ন শহরের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্টও ছিল ইস্ফাহান শহর। বিশেষ করে এই দুই কারণে ইস্ফাহান শহরের গুরুত্ব ছিল ব্যাপক। এই গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই হয়তো গ্রিক ভূগোলবিদ স্ট্রাবন ইস্ফাহান শহরকে ইরানের কেন্দ্রিয় শহর বলে উল্লেখ করেছিলেন। অবশ্য আশকানিদের শাসনামলে তাদের বিশাল সাম্রাজ্যের একটি রাজধানী শহর এবং কেন্দ্র হিসেবে ইস্ফাহানকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। সর্বোপরি ভৌগোলিক দিক থেকেও কেন্দ্রে অবস্থানের কারণে এবং প্রাচীনকালের ব্যবসায়ী কাফেলার চলাচলের মহাসড়কের মাঝে অবস্থানের কারণে ইস্ফাহান বেশ কয়েক যুগ ধরে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে মর্যাদার আসনে ছিল। পশ্চিমের দামেশক এবং আলেপ্পো শহর আর পূর্বের বোখারা এবং সমরকন্দের বণিকেরা এই পথে বাণিজ্য কাফেলা নিয়ে আসা-যাওয়া করতো।

এ কারণেই আলে-জিয়র রাজবংশ, সালজুকি রাজবংশের শাসনকালেও ইস্ফাহান ছিল প্রাদেশিক রাজধানী। সালজুকি রাজবংশের শাসনামলে বহু জ্ঞানী-গুণী শিল্পী ও মনীষীর আনাগোণা ছিল ইস্ফাহানে। তাদের আগমনের সুবাদেই এই শহরে নির্মিত হয়েছে মসজিদ, সরাইখানা, ব্রিজসহ আরও বহু মূল্যবান স্থাপনা। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ৩০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ