জুলাই ০৬, ২০২০ ১৫:৫৪ Asia/Dhaka

বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান। গত আসরে আমরা ইরানের নামকরা প্রদেশ ইস্ফাহানে গিয়েছিলাম।

ইস্ফাহান প্রদেশের কেন্দ্রিয় শহরের নাম ইস্ফাহান। ইস্ফাহানকে বলা হয় 'নেসফে জাহান' মানে অর্ধ বিশ্ব। বিখ্যাত এই ইস্ফাহান প্রদেশে রয়েছে ঐতিহাসিক বহু নিদর্শন এবং প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্যাবলি। হাখামানেশিদের সময় ইস্ফাহান শহরে ছিল শাসকদের রাজকীয় বাসভবন। বিভিন্ন শহরের সঙ্গে যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ ট্রানজিট পয়েন্টও ছিল ইস্ফাহান শহর। বিশেষ করে এই দুই কারণে ইস্ফাহান শহরের গুরুত্ব ছিল ব্যাপক।                                                             

এই গুরুত্বের কথা বিবেচনা করেই হয়তো গ্রিক ভূগোলবিদ স্ট্রাবন ইস্ফাহান শহরকে ইরানের কেন্দ্রিয় শহর বলে উল্লেখ করেছিলেন। ভৌগোলিক দিক থেকেও কেন্দ্রে অবস্থানের কারণে এবং প্রাচীনকালের ব্যবসায়ী কাফেলার চলাচলের মহাসড়কের মাঝে অবস্থানের কারণে ইস্ফাহান বেশ কয়েক যুগ ধরে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে মর্যাদার আসনে ছিল। এ কারণেই আলে-জিয়র রাজবংশ, সালজুকি রাজবংশের শাসনকালেও ইস্ফাহান ছিল প্রাদেশিক রাজধানী। সালজুকি রাজবংশের শাসনামলে বহু জ্ঞানী-গুণী শিল্পী ও মনীষীর আনাগোণা ছিল ইস্ফাহানে। তাদের আগমনের সুবাদেই এই শহরে নির্মিত হয়েছে মসজিদ, সরাইখানা, ব্রিজসহ আরও বহু মূল্যবান স্থাপনা। তাই ইরানের সুন্দরতম, বিখ্যাত এবং পর্যটক আকর্ষণীয় শহর ইস্ফাহান। এই শহরটি ইসলামি সভ্যতার লালনভূমি এবং ইসলামি সাংস্কৃতিক রাজধানী হিসেবে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

মোঙ্গলদের হামলায় যদিও ইরানের অন্যান্য শহরের মতো ইস্ফাহান শহরটিও ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল তারপরও শাহ আব্বাস সাফাভি তার শাসনামলে নিজেদের রাজধানী শহর হিসেবে ইস্ফাহানকে নির্বাচন করার মধ্য দিয়ে পুনরায় শহরটির হারানো ঐতিহ্য ও ঐশ্বর্য ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চালিয়েছেন। হিজরি নয় শ সাতাত্তর সালের কথা এটি। শাহ আব্বাস এ ক্ষেত্রে সফলও হয়েছেন। মাত্র কয়েক বছর পরই ইস্ফাহান তার আগের রূপ ফিরে পেয়েছিল। এমনই জাকজমকপূর্ণ শহরে পরিণত হয় ইস্ফাহান যে আন্তর্জাতিক রাজধানীর মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়। ইউরোপ এবং দূরপ্রাচ্য থেকে যেসব বাণিজ্যিক কাফেলা বিভিন্ন দেশে বাণিজ্যের উদ্দেশে গমনাগমন করে ইস্ফাহান তাদের কাছে ব্যাপক আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক শহর হিসেবে পরিগণিত হয়। ইস্ফাহানমুখি হয়ে পড়ে ইউরোপ এবং দূরপ্রাচ্যের ব্যবসায়ীরা।

বর্তমানে ইস্ফাহান ইরানের কেন্দ্রিয় একটি প্রাচীন শহর হিসেবে পরিচিত। তেহরান এবং মাশহাদ শহরের পর তৃতীয় জনসংখ্যাবহুল শহর ইস্ফাহান। মাশহাদ শহরের পর দ্বিতীয় প্রধান পর্যটক আকর্ষণীয় শহরও ইস্ফাহান এবং রাজধানী তেহরান শহরের পর দ্বিতীয় প্রধান শিল্পশহর এই ইস্ফাহান। ইস্ফাহান শহরটিতে রয়েছে দেখার মতো বহু নিদর্শন। কোনোটি প্রাকৃতিক কোনো কোনোটি ঐতিহাসিক। সুতরাং প্রকৃতি প্রেমিক কিংবা পুরাতত্ত্ব গবেষক বা ইতিহাসবিদ সবার কাছেই ইস্ফাহান একটি আকর্ষণীয় এবং গবেষণাযোগ্য একটি শহর হিসেবে বিবেচিত।

ইস্ফাহান নিয়ে কথা হচ্ছিল। পর্যটন শহরের মর্যাদায় অভিষিক্ত হবার কারণে ইস্ফাহান শহর হস্তশিল্প সামগ্রীর জন্যও গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করেছে। ইস্ফাহানের শিল্পীরা হস্তশিল্প সামগ্রী তৈরিতে খুবই নিপুণ এবং অভিজ্ঞতা সম্পন্ন। মিনিয়েচার শিল্প, কাঠ খোদাই শিল্প, গালিচা তৈরি শিল্প, শূচিকর্মের মাধ্যমে তৈরি জুতা শিল্প, হ্যান্ড পেইন্টেড বা ব্লক প্রিন্টিং শিল্প, ভিটরিয়াস এনামেল শিল্প, লতাপাতার নকশার কাজ, সিরামিক শিল্পের কারুকাজ, রূপার বিভিন্ন কারুকাজ এবং রূপা কিংবা তামা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন রকমের তৈজস নির্মাণ শিল্প ইত্যাদির জন্য ইস্ফাহান একটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে পরিণত হয়েছে। এসব শিল্পের জন্য ইস্ফাহানের শিল্পীরা অসম্ভব রকমের দক্ষতা দেখিয়েছে। বলতে দ্বিধা নেই যে ইস্ফাহানের অধিবাসীদের আয়ের অন্যতম উৎস হলো এই হস্তশিল্প।

এর বাইরেও ইস্ফাহানের লোকজন যেসব পেশায় নিয়োজিত থেকে অর্থনৈতিক যোগান দিচ্ছে তাদের মধ্যে রয়েছে কৃষিকাজ এবং পশুপালন। এই দুটি পেশা কেবল ইস্ফাহান শহরেই নয় বরং এই শহরের আশেপাশেও এগুলোর প্রচলন রয়েছে। আরও দুটি পেশাও ইস্ফাহানে ব্যাপকভাবে প্রচলিত। একটি হলো মৌমাছি বা মধুর চাষ অপরটি মাছের চাষ। ইস্ফাহানের অর্থনীতিতে এখানকার শিল্প কল-কারখানারও ব্যাপক প্রভাব বিস্তারকারী ভূমিকা রয়েছে। এখানে রয়েছে লোহা গলানোর কারখানা, বিখ্যাত মোবারাকে স্টিল শিল্প কারখানাটিও এই ইস্ফাহান শহরেই অবস্থিত। এখানে রয়েছে ইস্ফাহান পলি-অ্যাক্রিলিক কারখানা, সামরিক শিল্প কারখানা, খাদ্য পণ্য সামগ্রী তৈরির কারখানা, প্লাস্টিকের সামগ্রী তৈরির কারখানা, স্পিনিং অ্যান্ড কটন ইন্ডাস্ট্রিজসহ আরও বহু কল-কারখানা।

এবারে যাওয়া যাক শিল্প কল-কারখানার বাইরে অর্থনীতির অন্যান্য চালিকাশক্তির খোঁজে। ইস্ফাহানে রয়েছে সমৃদ্ধ খনিজ সম্পদ। এখানকার খনিজ সম্পদ ইস্ফাহান প্রদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রাখতে সক্ষম। বিশেষ করে এখানে রয়েছে পাথরের খনি, রয়েছে স্বর্ণের খনি এমনকি সীসার খনিও। বহু রকমের শোভাবর্ধনকারী মূল্যবান পাথরের খনি রয়েছে এখানে। এগুলোর মধ্যে ট্রাভেরটাইন, মার্বেল পাথর, চাইনিজ পাথর, মর্মর পাথর এবং গ্র্যানাইট পাথর-এই পাঁচ প্রকারের পাথর উল্লেখযোগ্য। পাথরের প্রাচুর্য বা মজুদের দিক থেকে বিশ্বে ইস্ফাহানের অবস্থান চার নম্বরে। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার সুযোগ নেই ছোট্ট এ আসরে।

ইস্ফাহানের লোকজন বেশিরভাগই শিয়া মাজহাবের অনুসারী মুসলমান। তবে আর্মেনিয় খ্রিষ্টান যেমন আছে তেমনি আছে ইহুদি, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য ধর্মীয় সংখ্যালঘুরাও। ইস্ফাহানের অধিবাসীরা ফার্সি ভাষাতেই কথা বলে তবে ইস্ফাহানি একটা আঞ্চলিক ঢং বা ধরণ আছে তাদের ভাষাভঙ্গিতে। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ০৬

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ