আগস্ট ২১, ২০২০ ১৭:৪০ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম উপলক্ষ্যে 'চিরভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব' শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার প্রথম পর্ব থেকে সবার প্রতি রইল সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা। ধারাবাহিক এই আলোচনার প্রথম পর্ব পরিবেশন করেছেন আকতার জাহান এবং গাজী আবদুর রশিদ।

 

 নীল সিয়া আসমান লালে লাল দুনিয়া।

আম্মা! লাল তেরি খুনকিয়া খুনিয়া

কাঁদে কোন ক্রন্দসী কারবালা ফোরাতে

সে কাঁদনে আসু আনে সীমারেরও ছোরাতে।

-কাজী নজরুল ইসলাম

আরবী পঞ্জিকার প্রথম মাস হচ্ছে মহররম। আরবী সনের প্রথম মাস মহররম হলেও বছরের শুরুর এই দিনটিতে কোন আনন্দ বা উল্লাসের লেশমাত্র নেই। চলতি বছর এই মহাশোকের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা মহামারির সৃষ্ট বিষাদ। আরবী সনের প্রথম মাসের প্রথম দিনটি শুরু হয় একটি ঐতিহাসিক ঘটনা স্মরণের  মধ্য দিয়ে। যে ঘটনাটি মানব জাতির জন্য অভুতপূর্ব ও চিরন্তন এক আদর্শের জন্ম দিয়েছে। এই আদর্শের জন্ম দিয়েছেন নবী করিম (সা) এর প্রাণপ্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (আ) মহান আত্মত্যাগের মাধ্যমে।

কারবালার মহাবিপ্লব বিশ্বের সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হিসেবে অবিস্মরণীয়। এই মহাট্র্যাজেডির পটভূমি লুকিয়ে ছিল আরব গোত্রগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও দ্বন্দ্বের মধ্যে। মহানবী (সা) নিজে ছিলেন কুরাইশদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত গোত্র তথা হাশেমি গোত্রের। হযরত ইব্রাহিম (আ)'র বংশধারা হতে আসা এ গোত্রের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা কাবা ঘরের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী ছিলেন।  মহানবীর (সা) দাদা আবদুল মোত্তালেব ও পরবর্তীতে আবুতালিব একই কারণে বিশেষ সম্মানের অধিকারী ছিলেন। পরবর্তীকালে মহানবী (সা) মহান আল্লাহর সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ রাসুল (সা) হিসেবে আরব বিশ্বে সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হয়েছিলেন। আর মহানবীর পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হযরত আলী (আ) এবং হযরত ফাতিমার (সালামুল্লাহি আলাইহা) সন্তান হযরত ইমাম হাসান ও হুসাইনও সর্বোচ্চ সম্মানের অধিকারী হওয়ায় গোত্রবাদী ইর্ষায় আক্রান্ত হয়েছিল অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তাই হাশেমি বংশের মোকাবেলায় কুরাইশ বংশের অন্য গোত্রগুলোর মধ্যে এক ধরনের জোট গড়ে ওঠে। আর এ অবস্থা থেকে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে সক্ষম হয়েছিল উমাইয়া বংশ।

উমাইয়াদের উত্থানের সুবাদে এ বংশের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও এক সময় ইসলামের চরম শত্রু হিসেবে কুখ্যাত আবু সুফিয়ানের ছেলে মুয়াবিয়া ছলে বলে কৌশলে মুসলমানদের ওপর ক্ষমতাসীন হয়। এরপর মুয়াবিয়ার সৃষ্ট রাজতান্ত্রিকতাকেই ইসলামের লেবাস পরিয়ে ইসলামকে চিরতরে নির্মূলের যে ষড়যন্ত্র করেছিল ইয়াজিদের নেতৃত্বাধীন মুনাফিক উমাইয়ারা তার বিরুদ্ধে পাহাড়ের মত বাধা হয়ে দাঁড়ান মহানবীর (সা) ছোট নাতি হযরত ইমাম হুসাইন (আ)।

মুয়াবিয়া জীবিত থাকতেই তারই নির্দেশে ইয়াজিদের পক্ষে আগাম বাইয়াত নেয়ার কাজ শুরু হয়েছিল। কিন্তু ইমাম হুসাইন (আ)'র মত শতভাগ নীতি-পরায়ন নিষ্পাপ ইমামের পক্ষে ইয়াজিদের মত চরিত্রহীন ও কুলাঙ্গার ব্যক্তিকে খলিফা হিসেবে মেনে নেয়া সম্ভব ছিল না।  অন্যদিকে ইরাকিরা  ইমাম হুসাইন (আ)-কে মুসলমানদের নেতা বা খলিফা মনে করত। তারা ইমামকে কুফায় আসার আমন্ত্রণ জানায় যাতে সেখান থেকে ন্যায়বিচার-ভিত্তিক ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় এবং উমাইয়া রাজাদের অবৈধ শাষণ, শোষণ, দুর্নীতি, লুটপাট ও খোদাদ্রোহী আচরণ থেকে জনগণ মুক্তি পায়।

মহান ইমাম হুসাইন (আ) ইরাকিদের ও বিশেষ করে কুফাবাসীর আহ্বানে সাড়া দিয়েছিলেন। তবে কুফাবাসী আমন্ত্রণ না জানালেও তিনি কুলাঙ্গার ইয়াজিদের নেতৃত্ব কখনও মেনে নিতেন না।  কুফাবাসীদের চিত্তের দুর্বলতাও জানতেন ইমাম। তাই সেখানকার জনমত বোঝার জন্য তিনি সেখানে পাঠিয়েছিলেন চাচাতো ভাই মুসলিম ইবনে আকিলকে। আকিলকে প্রথমদিকে স্থানীয় জনগণ বিপুল সম্বর্ধনা দেয়। কিন্তু ইয়াজিদের গভর্নর ইবনে জিয়াদের ব্যাপক ধরপাকড় ও নির্যাতন শুরু হলে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। ফলে মুসলিম ইবনে আকিল অসহায় অবস্থায় একাই প্রতিরোধ চালিয়ে শহীদ হন। মুসলিম ইবনে আকিলের শহাদাতের খবর শুনে ইমাম অত্যন্ত শোকাহত হলেও তাঁর বিপ্লবী মিশন তথা কুফাগামী যাত্রা অব্যাহত রাখেন। কিন্তু কুফায় পৌঁছার পথে কারবালা নামক অঞ্চলে ইবনে জিয়াদের বাহিনী ঘিরে ফেলে ইমামের কাফেলাকে। সেখানে ইমামকে ইয়াজিদের এ নির্দেশ জানানো হয় যে, হয় তিনি ইয়াজিদের নেতৃত্ব মানবেন অথবা মৃত্যু বেছে নিতে হবে।

ইমাম হুসাইন (আ) প্রথম থেকেই জানতেন যে তাঁর শাহাদাত ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতিতে মুসলমানদের জাগিয়ে তোলা সম্ভব হবে না। তাই তিনি আপোষ বা সন্ধির দিকে না গিয়ে মুষ্টিমেয় সঙ্গী-সাথীসহ অসম এক যুদ্ধে জড়িয়ে ত্যাগ, সততা ও বীরত্বের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ইসলামের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন। ইয়াজিদের অন্যায় আবদারের কাছে মাথা নত করেননি বলে ইমামের কাফেলা ও সঙ্গীদেরকে ফোরাতের পানি থেকেও বঞ্চিত করেছিল নৃশংস পাশবিক চিত্তের ইয়াজিদ বাহিনী। ইমাম হুসাইন (আ) ও তাঁর পরিবারের অনেক সদস্য পিপাসার্ত অবস্থায় এমন নৃশংসভাবে শহীদ হন যে বিশ্বের ইতিহাসে সেসব নজিরবিহীন। বিখ্যাত ঐতিহাসিক গীবন কারবালার এই ঘটনার করুণ ও মর্মান্তিক অবস্থা প্রসঙ্গে লিখেছেন,

"সেই সুদূর অতীতের সেই করুণ পরিবেশে ইমাম হুসাইনের শাহাদতের ঘটনা ছিল এতই ট্র্যাজিক যে তা সবচেয়ে কঠিন হৃদয়ের অধিকারী পাঠকের মনেও ইমামের জন্য সহানুভূতি জাগিয়ে তোলে।"

শ্রোতা ভাইবোনেরা, আজকের এই আলোচনা আপাতত এখানেই শেষ করছি। কারবালার মহাবিপ্লবের নানা দিক ও শিক্ষা নিয়ে আমরা কথা বলব আগামী পর্বগুলোতে। আশা করছি তখনও আমাদের সঙ্গ দিতে ভুলবেন না। সবাইকে আবারও জানাচ্ছি গভীর শোক ও সমবেদনা। #

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/২১

 

ট্যাগ