আগস্ট ২৩, ২০২০ ১৫:৫৫ Asia/Dhaka

শোকাবহ মহররম উপলক্ষে 'চিরভাস্বর কারবালার মহাবিপ্লব' শীর্ষক ধারাবাহিক আলোচনার দ্বিতীয় পর্ব থেকে সবার প্রতি রইল সংগ্রামী সালাম ও গভীর শোক আর সমবেদনা। কবি ফররুখ আহমদ লিখেছেন- জীবনের চেয়ে দৃপ্ত মৃত্যু তখনই জানি/শহীদী রক্ত হেসে ওঠে যবে জিন্দেগানী।

কারবালার মহাবিপ্লব বিশ্ব-ইতিহাস ও সভ্যতার এক অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আজ হতে প্রায় ১৪০০ বছর আগে ঘটে-যাওয়া সেই বিপ্লব মানব-সভ্যতাকে যতটা প্রভাবিত করেছে ও করে যাচ্ছে এবং করবে- ও অস্তিত্ব-জগতের শেষ দিনটি পর্যন্ত এর প্রভাব ও শিক্ষাগুলো মানবজাতিকে যতটা নাড়া দেবে তেমনটি আর কোনো বিপ্লবের ক্ষেত্রেই সম্ভব হবে না। কিন্তু কেনো কারবালার এ মহাবিপ্লব মুক্তিকামী বিশ্ব-মানবতাকে এত প্রবলভাবে দোলা দেয় এবং কেনো এ বিপ্লবের মহানায়কদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করতে মানুষ গর্ব অনুভব করে? –এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজারই চেষ্টা করব আমরা আজকের এই আলোচনায়।

পৃথিবীতে যা যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা অর্জনের জন্যও তত বেশি শ্রম বা মূল্য দিতে হয়। একত্ববাদ, স্বাধীনতা,মানবতা ও উচ্চতর সব মূল্যবোধেরই সমষ্টি হল ইসলাম। তাই ইসলাম মানবজাতির জন্য মহান আল্লাহর সবচেয়ে বড় উপহার। এই ইসলাম মানবজাতির কাছে এসেছে হাজার হাজার বছর ধরে এক লাখ বা দুই লাখ নবী -রাসুলের অশেষ ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তের বিনিময়ে। পরিপূর্ণ ধর্ম ইসলামের মহাতরীর অগ্রযাত্রা বিশ্বনবী(সা.)’র মাধ্যমে অতীতের ইতিহাসের সব রেকর্ড ভঙ্গ করে। কিন্তু বিশ্বনবী (সা.)’র তিরোধানের পর এই মহাতরীর অগ্রযাত্রা ধীরে ধীরে স্তিমিত হতে থাকে। এ প্রসঙ্গে খিলাফত যুগের শেষের দিকের কয়েকটি গৃহযুদ্ধের কথা উল্লেখ করা যায়। কুচক্রী ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহলের ষড়যন্ত্রে বিশ্বনবী (সা.)’র  হিজরতের প্রায় ৪০ বছর পরই ইসলামের নামে চালু হয় রাজতন্ত্র। ভোগবাদও গোত্রবাদসহ জাহিলি যুগের নানা প্রভাব আবারও প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। এক পর্যায়ে পরিস্থিতি এত শোচনীয় হয়ে ওঠে যে একজন মদ্যপায়ী, ব্যাভিচারী, জুয়াড়ী ও পুরোপুরি ফাসিক চরিত্রের এক ব্যক্তি ইসলামী খেলাফতের কর্ণধার হয়ে বসে।

কিন্তু ইয়াজিদ ও তার দলবলের প্রকাশ্য পাপাচার দেখেও একমাত্র হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) ছাড়া কেউ তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হতে বা প্রকাশ্যে কথা বলতেও সাহসী হয়নি।

আসলে সে যুগে উমাইয়া শাসকগোষ্ঠী ও তাদের সহযোগীরা ইসলামের লেবাস পরেই ইসলামের বারোটা বাজানোর আয়োজন পাকাপোক্ত করছিল। ইসলামের এমন দুর্দিনে যিনি স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও সত্যের ঝাণ্ডা উঁচিয়ে প্রকৃত ইসলামকে আবারও জাগিয়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি ছিলেন মহামতি হযরত ইমাম হুসাইন (আ.)।

হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) লক্ষ্য করেন যে, ইসলামের শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে পুরোপুরি বিলুপ্তির ব্যবস্থা করছে উমাইয়া রাষ্ট্রযন্ত্র।  তাই ইসলামকে রক্ষার ও মানুষকে সঠিক পথ দেখানোর গুরু দায়িত্ব পালনের জন্য এগিয়ে আসেন এই মহান ইমাম। তিনি নিজেই এ প্রসঙ্গে বলেছেন:

  “আপনারা জেনে রাখুন যে এরা তথা বনি উমাইরা সব সময়ই শয়তানের সঙ্গী। তারা আল্লাহর নির্দেশ ত্যাগ করেছে এবং প্রকাশ্যে  দুর্নীতি ও অনাচার করে যাচ্ছে। তারা আল্লাহর বিধানকে নিষিদ্ধ করেছে এবং জনগণের সম্পদকে ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত করেছে। তারা আল্লাহ যা যা নিষিদ্ধ বা হারাম করেছেন সেসবকে হালাল বা বৈধ করেছে এবং আল্লাহ যেসবকে হালাল করেছেন সেসবকে হারাম করেছে।

ইমাম হুসাইন (আ.) আরো বলেছেন,

 “হে আল্লাহ! আপনি তো জানেন, আমাদের পক্ষ থেকে যা হচ্ছে তা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নয়। দুনিয়ার স্বার্থ হাসিলও আমাদের লক্ষ্য নয়। বরং তোমার দ্বীনকে বাঁচিয়ে রাখা,  তোমার ভূখণ্ডে সংস্কার আনা ও নির্যাতিত ব্যক্তিদের স্বস্তি দেয়ার জন্যই  আমরা কিয়াম করেছি যাতে ধর্মের ফরজ বিষয় ও বিধানগুলো বাস্তবায়ন করা হয়।”

এভাবে বিশ্বনবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইতের সদস্য হিসেবে ইমাম হুসাইন (আ) দুনিয়ার বুকে ইসলামকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষার জন্য কারবালার মহাবিপ্লবে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মহান আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী আন্তরিক চিত্তে যথাসময়ে এই জরুরিতম দায়িত্বটি পালনের জন্য নিজের সন্তান ও জীবনসহ সব কিছু বিলিয়ে দেয়ার মত সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন হযরত ইমাম হুসাইন (আ)। তাই মহান আল্লাহও তাঁর একনিষ্ঠ এই প্রেমিক ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য বিশ্বের সব যুগের মু'মিন মানুষের হৃদয়ে দান করেছেন অনন্য মমত্ববোধ আর শ্রদ্ধা। একদিকে এই মহান ইমাম ও তাঁর সঙ্গীদের  অতুলনীয় বীরত্ব, সাহসিকতা ও আপোসহীনতা এবং চরম আত্মত্যাগ আর অন্যদিকে ইয়াজিদের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন তাগুতি বাহিনীর চরম নৃশংসতা ও পাশবিকতার ফলে সৃষ্ট মর্মান্তিক নানা ঘটনা ও দৃশ্যপট কারবালার মহাবিপ্লবকে করেছে মানবজাতির ইতিহাসের সবচেয়ে হৃদয়-বিদারক ও বীরত্বপূর্ণ অধ্যায়। তাই মুসলিম ও অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই এ বিপ্লবের মহানায়ক ও তার বীর সঙ্গীদের জন্য অশ্রু বিসর্জন করে আসছে গর্বভরে। মানবজাতির শোকের এই অশ্রুকে জমা করা হলে তা হবে হয়ত একটি সাগরের সমান।

অন্যদিকে মহাপাপিষ্ঠ ইয়াজিদ এবং তার সঙ্গী ও দলবল বা পৃষ্ঠপোষকদের প্রতি মানুষের মনে যে ঘৃণা জমে আছে তাও সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তাই কারবালার মহাবিপ্লব হচ্ছে শোককে শক্তিতে পরিণত করার ও জুলুম আর খোদাদ্রোহীতাকে মোকাবেলার সবচেয়ে শক্তিশালী অস্ত্র। এ অস্ত্র পরমাণু বোমার চেয়েও লক্ষ-কোটি গুণ বেশি শক্তিশালী। কারবালার মহাবিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকৃত শিক্ষা পেতে হলে আমাদেরকে জানতে হবে এ মহাবিপ্লবের নানা দিকের বিস্তারিত ব্যাখ্যা, পটভূমি ও সত্যিকারের ইতিহাস।#

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/২৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ