আগস্ট ২৪, ২০২০ ১৬:৪০ Asia/Dhaka

কারবালার মহাবিপ্লবের মহানায়ক ইমাম হুসাইন (আ) যা যা চেয়েছিলেন তা সফল হয়েছে কি? প্রতিটি খোদায়ি বিপ্লবের থাকে তাৎক্ষণিক বা সমসাময়িক লক্ষ্য ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য। ইমাম হুসাইনের বিপ্লবের ফলে জালিম উমাইয়া তাগুতি ও খোদাদ্রোহী মুনাফিক গোষ্ঠী ইসলামকে গলা টিপে চিরতরে হত্যার যে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করতে চেয়েছিল তা সম্ভব হয়নি।

ইমাম ও তাঁর সঙ্গীদের অপূর্ব আত্মত্যাগ মুসলিম জাতির নিভু নিভু বিবেকের ওপর এনেছিল প্রবল কষাঘাত। যাদের মধ্যে ঈমানের কিছু আলো ছিল ও যারা ইসলামকে এবং সত্যকে মোটামুটি অনুসরণ করতে চাইতেন তারাও বিবেকের প্রবল দংশনে আত্মহারা হয়ে ওঠেন। ফলে দেখা দেয় তাউয়াবিন বা তওবাকারীদের আন্দোলন এবং গোটা ইসলামী ভূখণ্ডে উমাইয়া ও ইয়াজিদি স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জনমত প্রবল হয়ে ওঠে। ফলে ক্ষমতা হারানোর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে কুলাঙ্গার উমাইয়া শাসক গোষ্ঠী।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, কারবালা বিপ্লবের প্রভাবের কারণেই ব্যাপক ত্রাস ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েও আশুরার ঘাতক মুনাফিক চক্র রক্ষা পায়নি। তাদের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সবাই বীর মুখতারের প্রতিশোধ আন্দোলনের আগুনে পুড়ে কঠোর শাস্তি পায়। মহানবীর (সা) আহলে বাইতের পবিত্র সদস্যদের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং এক পর্যায়ে নবীবংশকে ক্ষমতায় বসানোর আন্দোলন শুরু হয় ও এ আন্দোলনের জের ধরেই পতন ঘটে উমাইয়া রাজবংশের। যদিও এ অন্দোলনের মহান উদ্দেশ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল মহানবীর চাচার বংশের একদল ব্যক্তি, কিন্তু এরি মধ্যে প্রকৃত মুহাম্মাদি ইসলামের সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানগত ভিত্তি জোরদার হয়ে ওঠে।

অন্যদিকে কারবালার সুদূরপ্রসারী প্রভাবের কারণে এ মহাবিপ্লব হয়ে উঠে যুগে যুগে স্বৈরশাসক ও খোদাদ্রোহী শাসকদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী জাতিগুলোর বিশেষ করে মুসলিম জাতিগুলোর দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলার অনন্য আদর্শিক অনুপ্রেরণার উৎস। তাই বলা যায় যে ইমাম হুসাইনের তাৎক্ষণিক বা সমসাময়িক ও সুদূরপ্রসারী লক্ষ্যগুলো মোটামুটি ভালোভাবেই সফল হয়েছে এবং হুসাইন-বিরোধী ইয়াজিদি চেতনাধারীদের আদর্শ সব সময়ই আশুরা সংস্কৃতির আদর্শিক চেতনার দিক থেকেই সবচেয়ে বড় হুমকি ও চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন।

ইমাম হুসাইন (আ) মুয়াবিয়ার প্রায় বিশ বছরের অবৈধ শাসনামলে অনেক ধৈর্য ধরে সংখ্যায় অতি অল্প হলেও এমন একদল খাঁটি মুমিন ও অনুরাগী গড়ে তুলতে পেরেছিলেন যাঁরা ইসলাম ও ন্যায়ের ঝাণ্ডাকে উঁচু করার জন্য জীবনের সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাঁদের কাছে এ লক্ষ্য অর্জনের পথে শাহাদত বরণ করা ছিল শিশুর কাছে মাতৃস্তন্যের চেয়েও অনেক বেশি প্রিয়। আশুরার রাতে ইমাম তাঁদের পরীক্ষা করেছিলেন চূড়ান্তভাবে। তিনি তাঁদেরকে বার বার বলেছিলেন, তোমরা চলে যাও! তোমরা পালিয়ে যাও রাতের আঁধারে! কেন আমার জন্য জীবন বিসর্জন দিবে? ওরা শুধু আমাকেই পেতে চায় ও আমাকেই নতজানু করতে বা হত্যা করতে চায়! কিন্তু তাঁরা বলেছিলেন: "আমরা আপনার জন্য কেবল একবার নয় হাজার বারও মরতে প্রস্তুত। আমাদেরকে যদি বার বার পুড়িয়ে হত্যা করা হয়, ছাই করা হয় ও আবার জীবন ফিরে পাই তবুও আপনার জন্য বার বার জীবন বিসর্জন দিতেই থাকব!" তাই হযরত ইমাম হুসাইন (আ) পরবর্তীতে নিজ বোন হযরত জাইনাবকে বলেছিলেন, আমার সঙ্গীরা ইতিহাসের সর্বোত্তম সঙ্গী! অর্থাৎ ইমাম হুসাইন তার বোনকে এটাই বলতে চেয়েছেন যে, আমার এই সঙ্গীদেরকে আমার পরীক্ষা করা হয়ে গেছে! আগামীকাল শাহাদত নিশ্চিত জেনেও তাঁরা আমাকে ছেড়ে পালিয়ে যেতে প্রস্তুত নয়! তাই আগামীকাল কি হবে তা নিয়ে দুর্ভাবনায় নিমজ্জিত না হতে তিনি বোনকে অনুরোধ করেন।

শহীদ সম্রাট ইমাম হোসাইন (আ.) আশুরার রাতে তার সঙ্গী-সাথীদেরকে প্রশংসা করে বলেন, ‘‘আমি পৃথিবীতে তোমাদের চেয়ে বিশ্বস্ত ও উত্তম কোনো সহযোগীর সন্ধান পাইনি।’’ ইমাম হুসাইন (আ) কিন্তু বললেন না : নিরাপরাধ হওয়া সত্ত্বেও আগামীকাল তোমাদেরকে হত্যা করা হবে! বরং তিনি এমন এক সনদপত্র পেশ করলেন যার মাধ্যমে তাঁর সহযোগীরা বদরের যুদ্ধে রাসূলুল্লাহর (সা.) সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন হলেন, তাঁর পিতা হযরত আলী (আ.)-এর সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদা-সম্পন্ন হলেন।

নবীদের যারা সাহায্য করেছেন তাদের সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে বলা হচ্ছেঃ

‘‘কত নবী যুদ্ধ করেছেন,তাদের সাথে বহু আল্লাহওয়ালা ছিল। আল্লাহর পথে তাদের যে বিপর্যয় ঘটেছিল তাতে তারা হীনবল হয়নি ও নতি স্বীকার করেনি। আল্লাহ ধৈর্যশীলদেরকে পছন্দ করেন।’’ (আল ইমরানঃ ১৪৬)

অথচ ইমাম হোসাইন (আ.) প্রকারান্তরে তাঁর সহযোগীদেরকে আম্বিয়া কেরামের এ সকল সহযোগীদের চেয়েও মর্যাদাসম্পন্ন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। ইমামের সঙ্গীরা কিভাবে এতটা সাহসী ও ত্যাগী হতে পেরেছিলেন? এর উত্তর হল দুনিয়ার লোভ-লালসা, পদ, ক্ষমতা ও সম্পদের মোহ বা পরিবার-পরিজন, নিজ গোত্র বা বন্ধু-বান্ধবের সাহচর্য এবং আপোষকামী জীবনকে ভালোবাসার ও অনেক দিন বাঁচার মানবীয় দুর্বলতাকে তারা মন থেকে নির্মূল করতে পেরেছিলেন। কিন্তু মুসলিম উম্মাহর বিশাল অংশই এ পরীক্ষায় জঘন্যভাবে ফেল করেছিল। তাদের কাছে ইসলাম, ন্যায়বিচার ও সত্যের চেয়েও গুরুত্ব পেয়েছিল দুনিয়ার অল্প কয়েক বছরের জীবন, নিজ গোত্র এবং পরিবার-পরিজনের মায়া বা সম্পদ ও পদের আকর্ষণ!

যারা ঈমান ও ইসলামকে বুঝতে পেরেছিলেন এবং তা শিখতে পেরেছিলেন মহানবীর (সা) পবিত্র আহলে বাইত থেকে তাঁদের কাছে তাগুতি শক্তির সঙ্গে আপোষকামীর জীবন ছিল সবচেয়ে ঘৃণার জীবন। কারবালার সেই আদর্শেরই প্রতিফলন দেখা গেছে ইরানের ইসলামী বিপ্লবে। যারা ইসলামের মহাশত্রু ও যারা মুনাফিক তাদেরকে কখনও কোনো বিপ্লবী মুসলমান কোনো ধরনের সুবিধা দিতে ও এমনকি তাদের প্রতি হাসিমুখে কথা বলতেও প্রস্তুত নয়। পবিত্র কুরআনও এটাই শিক্ষা দেয়। বড় শয়তান মার্কিন সরকার ও ইহুদিবাদী ইসরাইলকে এবং তাদের সহযোগী মুনাফিক চক্রকে এ জন্যই সর্বোচ্চ মাত্রায় ঘৃণা করেন বিশ্বের বিপ্লবী মুসলমানরা। তাই কারবালার শহীদদের জন্য অনুরাগ ও শোক প্রকাশেরই আরেকটি দিক হল তাঁদের বা তাদের আদর্শের শত্রুদের প্রতিও সর্বোচ্চ ঘৃণা করা এবং তাদেরকে অভিশাপ দেয়া ও তাদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা প্রকাশ্যে সবাইকে জানিয়ে দেয়া যাতে মহান আল্লাহও সন্তুষ্ট হন।#

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/২৪

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ