আগস্ট ২৫, ২০২০ ১৫:৫৪ Asia/Dhaka

কারবালার মর্মবিদারী ঘটনা মানব ইতিহাসের এমন এক বিস্ময়কর ঘটনা, যার সামনে বিশ্বের মহান চিন্তাবিদরা থমকে গিয়ে পরম বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে স্তুতি-বন্দনায় মুখরিত হয়েছেন এই নজিরবিহীন আত্মত্যাগের।

কারণ, কারবালার কালজয়ী বিপ্লবের মহানায়করা 'অপমান আমাদের সয় না বা স্পর্শও করে না” -এই শ্লোগান দিয়ে ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সংখ্যায় হাতে গোনা জনাকয়েক হওয়া সত্ত্বেও খোদায়ী প্রেম ও শৌর্যে পূর্ণ টগবগে অন্তর নিয়ে জিহাদ ও শাহাদাতের ময়দানে এসে প্রতারণা ও প্রবঞ্চনার অন্ধকার জগতকে পেছনে ফেলে উর্দ্ধজগতে মহান আল্লাহর সনে পাড়ি জমান। তাঁরা নিজ কথা ও কাজ দিয়ে জগতবাসীকে জানিয়ে দিয়ে যান যে, ‘‘যে মৃত্যু সত্যের পথে হয়, তা মধূর চেয়েও সুধাময়।’’

কারবালার মহাবিপ্লবের মহানায়ক হযরত ইমাম হুসাইনের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের তাৎক্ষণিক, সমসাময়িক ও সুদূর-প্রসারী লক্ষ্যগুলোর সাফল্য সম্পর্কে আমরা আলোচনা করেছি গত পর্বে। কারবালার মহাবিপ্লব ছিল একটি পরিপূর্ণ বিপ্লব ও সংস্কার-আন্দোলন। ইসলামকে জীবন্ত করার এ আন্দোলন কেবল মুসলমান ও অমুসলমানের বা কাফেরের মধ্যে পার্থক্য তুলে ধরে না, একইসঙ্গে তা মুমিন ও মুনাফিকের এবং মুসলমান ও দুর্বল মুসলমানের পার্থক্য তুলে ধরে। সৎকাজের আদেশ ও অসৎ কাজে নিষেধ করা বা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার কুরআনি আদর্শকে পুনরুজ্জীবন করেছিল কারবালার মহাবিপ্লব। এ মহাবিপ্লবের প্রতিটি পদে পদে রয়েছে পবিত্র কুরআনের শিক্ষার প্রতিফলন ও বাস্তবায়ন। আশুরার চেতনা, আদর্শ ও সংস্কৃতিও গড়ে উঠেছে কারবালার কুরআনি আদর্শের আলোকেই। হযরত ইমাম হুসাইন (আ) এবং তাঁর মহান সঙ্গীরা সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে নবী-রাসুলদের আদর্শেরই অনুসরণ করেছেন যা পবিত্র কুরআনের আলোকে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য ফরজ বা অবশ্য পালনীয় কর্তব্য।

শোককে শক্তিতে পরিণত করার প্রথা কি কারবালার ঘটনার পর থেকেই শুরু হয়েছে?  মহানবী (সা) কি ওহোদের যুদ্ধে শহীদ তাঁর প্রিয় চাচা হযরত হামজার জন্য জনসমাবেশ করে দলবদ্ধভাবে শোক-প্রকাশকে অনুমোদন দেননি? মহান আল্লাহ কি তাঁর প্রিয় বান্দাহদের আত্মত্যাগের ঘটনাগুলোকে পবিত্র কুরআনে প্রশংসার সঙ্গে উল্লেখ করেননি? হযরত ইব্রাহিমের কুরবানি, মূর্তি ভাঙ্গার ঘটনা, শয়তানের প্রতি পাথর নিক্ষেপ এবং হজের সময় কাফির ও মুশরিকদের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদের ঘটনা এবং জালিম ও খোদাদ্রোহীদের প্রতি কুরআনে মহান আল্লাহর লা’নত দেয়া বা অভিশাপ বর্ষণ মুসলমানদেরকে কি শিক্ষা দেয়? 

হযরত ইমাম হুসাইন (আ) নিজে তাঁর শাহাদাতের বিষয়ে ও শহীদদের জন্য শোক প্রকাশের আয়োজন করার ওসিয়ত করেছিলেন। যুগে যুগে নবী-রাসুলরা ইমাম হুসাইন (আ)’র আত্মত্যাগ ও কষ্টের কথা স্মরণ করে আগাম শোক-প্রকাশ ও অশ্রু বিসর্জন করেছেন।

মহান আল্লাহ যেমন মানুষের হেদায়াত বা সুপথ প্রদর্শনের জন্য জ্ঞান ও যুক্তির চর্চাকে গুরুত্ব দিয়েছেন তেমনি আবেগ অনুভূতির প্রকাশকেও ব্যবহার করতে বলেছেন। ইসলামের মহাপুরুষদের জন্মদিন যেমন আনন্দের দিন তেমনি তাঁদের ত্যাগ, শাহাদাত ও কুরবানির দিনগুলোও মুসলমানদের জন্য দুঃখ প্রকাশের দিন ও অশ্রু বিসর্জনের দিন। আকর্ষণ ও বিকর্ষণ তথা শোক প্রকাশ ও ঘৃণা প্রকাশ দু'টিই প্রেমের জন্য জরুরি। প্রিয়জনের শত্রুকে ঘৃণা করা ছাড়া কি তার প্রেমিক বলে দাবি করা যায়? মহান আল্লাহ চান আমরা ক্রোধ ও ঘৃণার মত আবেগ অনুভূতিগুলোকে যেন শয়তান ও শয়তানের দোসর জালিম আর তাগুতি শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবহার করি।  হাদিসে বলা হয়েছে জালিম শাসকের সামনে সত্য বলাও জিহাদ এবং জালিমকে ঘৃণা করা ঈমানেরই একটি স্তর। আর জালিমের বিরুদ্ধে জীবন ও সম্পদ বিলিয়ে দিয়ে সংগ্রাম করা হচ্ছে ঈমানের সর্বোচ্চ স্তর।

যারা মহান আল্লাহর প্রিয় ব্যক্তিদেরকে কষ্ট দিয়েছিল, তাঁদেরকে অবরূদ্ধ করে দিনের পর দিন পিপাসার্ত রেখেছিল এবং তাঁদের শিশু সন্তানদেরকেও পানি দেয়নি তাদেরকে ঘৃণা করাটা কি স্বাভাবিক বিষয় নয়? যারা জীবন্ত অবস্থায় নবীজীর প্রিয় নাতিকে জবাই করে দেহ থেকে তাঁর মস্তক বিচ্ছিন্ন করেছিল, তাঁর পিপাসার্ত দুধের শিশুর গলায় বিষাক্ত ও শাখাযুক্ত তির নিক্ষেপ করে তাঁকে শহীদ করেছিল তাদের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ ও তাদের অভিশাপ দেয়াটা কি কুরআনী নীতির অনুসরণ নয়!? মহান আল্লাহ যেখানে কুরআনে বলেছেন, সেদিন প্রশ্ন করা হবে কোন্ অপরাধে কন্যা শিশুদের জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছিল!-সেখানে কারবালার শহীদদের নৃশংসভাবে শহীদ করার কারণে মহান আল্লাহ কতটা ক্রুদ্ধ হয়েছেন তা কি স্পষ্ট হয় না?

যেখানে মহানবী (সা) ও তার পরিবারের প্রতি সালাম ও দরুদ পাঠানো ছাড়া মুসলমানদের নামাজ শুদ্ধ হয় না সেখানে মহররম মাসে নবী পরিবারের সদস্যদের প্রতি সীমাহীন বর্বরতার স্মরণে প্রতি বছর সেই একই মাসে শোক প্রকাশ ও অশ্রু বিসর্জন কি মানবিকতার সহজাত প্রকাশ নয়?

কারবালার মহানায়ক ইমাম হুসাইনের এবং তার সঙ্গীদের লাশের ওপর ঘোড়া দাবড়ানো হয়েছিল ইয়াজিদি বাহিনীর সর্দারদের নির্দেশে। ইমাম-শিবিরের তাঁবুগুলোতে আগুন লাগানো হয়েছিল এবং নবী-পরিবারের মহিলাদের অসম্মান করা হয় নানাভাবে। এমনকি শিশুদের ওপর অত্যাচার করা হয় এবং ইমামের শিশু-কন্যার কানের দুল পর্যন্ত জোর করে নিতে গিয়ে ইয়াজিদি সেনা তার কানকে রক্তাক্ত করেছিল! কারবালার মহাবিপ্লবে খোদাদ্রোহী শিবিরের জুলুম ও বর্বরতা যেমন ছিল সর্বোচ্চ ও চরম পর্যায়ের তেমনি ইমাম শিবিরের ব্যক্তিদের আত্মত্যাগ, ধৈর্য, খোদাপ্রেম ও বীরত্বও ছিল সর্বোচ্চ পর্যায়ের। তাই স্বাভাবিক মানবিকতার আলোকেই ও কুরআনি সংস্কৃতির আলোকেই এইসব ঘটনাকে বার বার স্মরণ করে অশ্রু বিসর্জন করা এবং আল্লাহর শত্রুদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শন ও অভিশাপ বর্ষণ করে কারবালার বীরদের মত আত্মত্যাগী ও খোদাপ্রেমিক হওয়ার মহড়া দেয়া অত্যন্ত বরকতময় ও শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতিরই অংশ। এইসব ঘটনাকে বার বার স্মরণের ফলেই কারবালার ইতিহাসকে বিকৃত করা সম্ভব হয়নি এবং মহানবীর আহলে বাইতের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও গভীর অনুরাগকেও ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়নি।

আশুরার সংস্কৃতির চর্চা অব্যাহত থাকার কারণেই বিগত চল্লিশ বছরে নানা ধরনের অবরোধ, যুদ্ধ ও পাশবিকতা উপেক্ষা করে ইসলামী ইরান বিশ্বের বুকে সগৌরবে মাথা উঁচু করে রাখতে সক্ষম হয়েছে এবং একই পথে এগিয়ে যাচ্ছে লেবানন, ইরাক, ফিলিস্তিন ও ইয়েমেনের মজলুম জাতিগুলো।#

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/২৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ