আগস্ট ২৭, ২০২০ ১৫:৩২ Asia/Dhaka

কারবালার মহাবিপ্লব নানা কারণে বিশ্ব-ইতিহাসে অনন্য। এ মহাবিপ্লব মৃতপ্রায় ইসলামকে জীবন্ত করেছিল ও ইসলামের প্রাণ-প্রবাহকে সতেজ করে আবারও ইসলামী জাগরণের এবং মুক্তি আন্দোলনের জোয়ার বইয়ে দিয়েছিল। তাই অতীতে মহররম বা আশুরায় যা যা ঘটেছে সব ম্লান হয়ে গেছে কারবালার মহাবিপ্লব ও হুসাইনি আশুরার কাছে।

ইমাম হুসাইনের মেরাজ হয়েছিল এমন এক অনন্য ও রক্ত-রঞ্জিত মে'রাজ যার জন্য গৌরব বোধ করতে পারেন মহানবী (সা) ও তাঁর পবিত্র আহলে বাইত এবং মহান আল্লাহ তাঁর এমন সৃষ্টির জন্য ফেরেশতাদের কাছে করতে পারেন শ্রেষ্ঠ মহামানবদের সৃষ্টির অনন্য গৌরব! মহানবী (সা) তাই বলেছিলেন, হুসাইন আমা থেকে ও আমি হুসাইন হতে! খাজা মইনউদ্দিন চিশতির ভাষায় হুসাইন হল- 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ'র ভিত্তি ও ধর্মের আশ্রয়স্থল। ইমাম হুসাইন (আ) ইসলাম ধর্মের সম্মান ও ইজ্জত বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন বলেই একই ধরনের কথা বলেছেন মহাকবি ইকবাল।

পশ্চিমারা ও তাদের অন্ধ অনুসারী কথিত আধুনিকতাবাদীরা বলে ইসলাম ভাগ্য-নির্ভর ধর্ম। কিন্তু কুরআন বলে, ‘‘আল্লাহ কোনো জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজ থেকেই তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে অগ্রসর হয়।’’ আরেকটি আয়াতে পবিত্র কুরআন একটা কলূষিত জাতির পরিণতি তুলে ধরে বলছে, "আল্লাহ কোনো জাতির জন্যে যে নেয়ামত দান করেছেন তা তিনি ফিরিয়ে নেন না যতক্ষণ তারা নিজেরাই তা বর্জন করে।’’ ( আনফাল: ৫৩)

অর্থাৎ যখন কোনো জাতি কলূষতায় নিমজ্জিত হয়, ফেতনা-ফ্যাসাদে ভরে যায়,তাদের সমাজ এভাবে তাদের নিজেদেরকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যায়,তখনই আল্লাহও তাদেরকে নেয়ামত থেকে বঞ্চিত করেন। যতক্ষণ কোনো জাতি নিজেরাই নিজেদের দুর্দশা কাটিয়ে উঠতে এগিয়ে আসবে না, যতক্ষণ কোনো জাতি পরিশ্রমী ও ত্যাগী হবে না, যতক্ষণ কোনো মুক্ত স্বাধীন চিন্তার পথ ধরবে না ততক্ষণ পর্যন্ত সে জাতি উন্নত হবে না, মুক্তি পাবে না।

ইরানে মহররমের শোকানুষ্ঠান

অন্যদিকে যখন কোনো জাতি তাদের অবস্থা পরিবর্তন করতে উঠে পড়ে লাগবে, পরিশ্রম করবে, কল্যাণের রাস্তা বেছে নিতে পারবে একমাত্র সে জাতিই আল্লাহর সমর্থন লাভ করবে। পবিত্র কোরআনের ভাষায় তারা আল্লাহর ফায়েজ, রহমত ও সহযোগিতার অধিকারী হবে। যদি অন্যের ওপর ভরসা করে নিস্ক্রিয় হয়ে বসে থাকে থাকলে সমস্যার সমাধান হতো তাহলে ঐ পরিস্থিতিতে হযরত ইমাম হুসাইনও (আ.) সবার আগে তাই করতেন। কিন্তু কেন তা তিনি করেননি? কারণ তিনি নিজেই নিজ জাতির তথা নানার উম্মতের ভাগ্য পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন। তিনি সমাজকে কলূষমুক্ত করতে চেয়েছিলেন যে কলুষতা বজায় থাকলে সবাইকে একই পরিণতি ভোগ করতে হবে।

কিন্তু ইমাম হোসাইন (আ.) কিভাবে সমাজকে কলুষতা মুক্ত করবেন? কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন? সোজা কাজতো আমরাও করতে পারি। সাধারণ সমস্যা সমাধান করা সবার পক্ষে সম্ভব। ইসলাম বলেছে: কেউ মারা গেলে তার জানাযায় ও কুরআনখানিতে অংশ নাও। সবাই এসব কাজ করেও থাকে। কিন্তু ইসলাম সবসময় এ ধরনের সাধারণ কাজ চায় না। কখনো কখনো ইমাম হুসাইনের (আ.) মত পদক্ষেপ নিতে হয়, বিদ্রোহ করতে হয়। এমন কিছু করতে হয় যা কেবল ঐ সময়ের মুসলিম সমাজকেই ঝাঁকুনি দেবে না বরং এক বছর পর তা এক রকমভাবে, পাঁচ বছর পর আরেক রকমভাবে আত্মপ্রকাশ করবে। এমন কি ৫০ বছর-১০০ বছর, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তা সত্যের পথে সংগ্রামকারীদের জন্যে এক আদর্শ হিসেবেই চিরজাগরুক থাকবে। আর এটিই হলো নিজেদের ভাগ্যে নিজেরাই পরিবর্তন আনা।  

ইমাম হুসাইন (আ) নিজেকে মানুষ ও মানবতার জন্যে উৎসর্গ করেছিলেন। একত্ববাদ, ন্যায়পরায়ণতা এবং মনুষ্যত্বের শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষায় তিনি নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। আর এ কারণেই সব মানুষই তাঁকে ভালোবাসে, তাঁকে শ্রদ্ধা করে। যখন কোনো মানুষ এমন একজনকে দেখে যার নিজের জন্যে কিছুই নেই, মান-সম্মান, মর্যাদা, মানবতা যা আছে তা সবই অন্যের জন্যে -তখন সে নিজেকে ঐ ব্যক্তির সাথে একাত্ম করে নেয়। কেউ যদি ইমাম হুসাইনের (আ.) মর্মান্তিক শাহাদাত উপলক্ষে শোক মিছিল করে, অথচ অমানুষ ইয়াযিদের নামের পাশে সম্মানসূচক নানান শব্দও ব্যাবহার করে থাকে-তাহলে সে কারবালা থেকে কোন শিক্ষাই নিতে পারল না। মহাপুরুষদের শ্রদ্ধা করা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। কিন্তু মহাপুরুকে যেমন সম্মানভরে স্মরণ করা হয় তেমনি কাপুরুষকেও অবশ্যই ঘৃণা করা উচিত। মহাপুরুষ ও কাপুরুষ উভয়কেই যদি আমরা শ্রদ্ধা করলাম-তাহলে হক আর বাতিলের মধ্যে আর কি-ই বা তফাৎ থাকলে?

যে বৈশিষ্ট্য কোনো আন্দোলন ও বিদ্রোহকে মহান করে তা হলো এমন এক বিশেষ পরিস্থিতিতে এ আন্দোলন অনুষ্ঠিত হবে যখন কোনো মানুষ এর ধারণাও করতে পারে না। ঘন অন্ধকারের মধ্যে এক খণ্ড আলোর ঝলকানি, ব্যাপক জুলুম-স্বৈরাচারের মধ্যে ন্যায়পরায়ণতার বজ্র আওয়াজ, চরম স্থবিরতার মধ্যে প্রকাণ্ড ধাক্কায় নিস্তব্ধ নিশ্চুপের মধ্যে হঠাৎ গর্জে ওঠা। যেমন, নমরুদের মতো একজন অত্যাচারী শোষক পৃথিবীকে গ্রাস করে ফেলে। কিন্তু আজীবন এ পিরিস্থিতি অব্যাহত থাকেনি। হঠাৎ করে একজন ইবরাহীমের (আ.) আবির্ভাব ঘটে ও নমরুদের কাল হয়ে দাঁড়ায়। কুরআনে মহান আল্লাহ বলেছেন, ‘‘ইবরাহীম একাই এক অনুগত জাতি ছিলেন।’’ (নাহলঃ ১২০) তেমনি ফেরাউনের মতো একজন নির্দয় ও অহংকারীও রক্ষা পায়নি। পরাক্রমশালী ফেরাউনের বিরুদ্ধেও একজন মূসা (আ) গর্জে ওঠেন।

আরব যখন শোষণ, মূর্তিপূজা, কন্যা সন্তানকে জীবিত হত্যা, রক্তপাত, ব্যাভিচার ও কুসংস্কারের অন্ধকারে তখন একজন মুহাম্মদের (সা.) আবির্ভাব হয় যিনি বলতে থাকেন:  ‘‘ বলো, আল্লাহ ছাড়া কোনো উপাস্য নেই, তবেই তোমরা সুখী হতে পার।” স্বৈরাচারী উমাইয়ারা সব ধরনের অপকর্মের সাজ-সরঞ্জামে সজ্জিত হয়েছিল, এমনকি ধর্মকে ভাঙ্গিয়েও স্বৈরতন্ত্র পাকাপোক্ত করতে, টাকা দিয়ে হাদীস জাল করে একদল দুনিয়ালোভী মুসলমানকে জিহাদের নামে ইমাম হুসাইনের (আ.) বিরুদ্ধে দাঁড় করায়!  তারা নবীর নাতিকে হত্যার শুকরিয়ায় একাধিক মসজিদ নির্মাণ করে! এমনই বিপর্যয়ের সময় ইমাম হুসাইন (আ.) মুক্তির মশাল জ্বালিয়েছিলেন। যখন মানুষের মানুষের মতামত ও সত্য প্রকাশের কোনো সাহস ছিল না। কোনো প্রতিরোধ অবাস্তবে মনে হতো- ঠিক তখনই ইমাম হুসাইন (আ.) বীরদর্পে বিরোধিতায় নামলেন, বজ্রকণ্ঠে সত্যের স্লোগান তুলে দুনিয়া কাঁপিয়ে খোদাদ্রোহী স্বৈরাচারের মেরুদণ্ড গুঁড়িয়ে দিলেন। আর এ কারণেই তাঁর আন্দোলন মহিমা লাভ করেছে ও  তা কালের গণ্ডি ছাড়িয়ে যুগ-যুগান্তরের মুক্তিকামী ও সত্যান্বেষী মানুষের অনুকরণীয় আদর্শ হয়েছে।#

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/২৬

 

ট্যাগ