আগস্ট ২৯, ২০২০ ১৪:৪৯ Asia/Dhaka

মহান তাসুয়া বা আশুরার পূর্ব দিন। ১৩৮১ বছর আগে এই দিনে অর্থাৎ ৬১ হিজরির নয়ই মহররম কুফায় ইয়াজিদের নিযুক্ত কুখ্যাত গভর্নর ইবনে জিয়াদ  ইমাম হুসাইন (আ.)’র ছোট্ট শিবিরের ওপর অবরোধ জোরদারের ও হামলার নির্দেশ দেয়। এর আগেই আরোপ করা হয়েছিল পাশবিক পানি-অবরোধ। পশু-পাখী ও অন্য সবার জন্য ফোরাতের পানি ব্যবহার বৈধ হলেও এ অবরোধের কারণে কেবল নবী-পরিবারের জন্য নিষিদ্ধ করা হয় এই নদীর পানি। ইয়াজিদ বাহিনীর সেনা সংখ্যাও ক্রমেই বাড়তে থাকে এবং দশই মহররমের দিনে তা প্রায় বিশ বা ত্রিশ হাজারে উন্নীত হয়।

ইমাম হুসাইন (আ.) নয়ই মহররমের বিকালের দিকে এক দিনের জন্য যুদ্ধ পিছিয়ে দেয়ার প্রস্তাব দেন যাতে দশই মহররমের রাতটি শেষবারের মত ইবাদত বন্দেগিতে কাটানো যায়। ইয়াজিদ বাহিনীর প্রধান প্রথমে রাজি না হলেও পরে এ প্রস্তাবে রাজি হয়। বিকালেই হযরত ইমাম হুসাইন (আ.) নিজ সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। সঙ্গীরা আবারও তাঁর প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার করেন।

নয়ই মহররম কালজয়ী কারবালা বিপ্লবের চূড়ান্ত প্রস্তুতি ও পরিণতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিন। মানব ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রস্তুতি অর্জনের সর্বশেষ দিন। এই পরীক্ষায় সফল হয়েছিলেন  ইমাম হুসাইন (আ.) ও তাঁর প্রায় ৭২ জন সহযোগী। আর এ জন্যই তাঁরা  ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন।

মহররমের নবম দিবস উপলক্ষে ইমাম হুসাইনের সৎভাই হযরত আবুল ফজল আব্বাসকে (সালামুল্লাহি আলাইহ) স্মরণ করা হয়। তিনি ছিলেন হযরত আলীর স্ত্রী উম্মুল বানিনের চার পুত্র সন্তানের মধ্যে সবার বড়। হযরত আবুল ফাজল আব্বাস-এর মর্যাদা সম্পর্কে নিস্পাপ ইমামগণ বলেছেনঃ ‘‘অবশ্যই আল্লাহর নিকট আব্বাসের মর্যাদা এমন যে, সমস্ত শহীদ তাতে গর্ব করবে ।’’

কারবালার ঘটনার সময় আবুল ফজল আব্বাসের বয়স ছিল প্রায় ৩৪ বা ৪৫ বছরের মতো। তিনি ছিলেন কয়েক জন সন্তানের পিতা; এদের মধ্যে একজন ছিলেন আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস যিনি অত্যন্ত দীর্ঘজীবী ছিলেন। বর্ণিত আছে যে,একিদন হযরত ইমাম যায়নুল আবদীন (আ.) তাঁকে দেখলেন; তখন কারবালার ঘটনাবলী তাঁর মনে পড়ে গেলো এবং ইমামের চোখ বেয়ে অশ্রুধারা নেমে এলো।

হযরত আব্বাসের উপাধি ছিলো সাক্কা বা পানি বহনকারী। তাঁকে এ উপাধি দেয়া হয়েছিলো কারণ তিনি তাঁর ভাইয়ের জন্য আশুরার দিন পানি আনতে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সেখানে পৌঁছানোর আগেই বা মতান্তরে পানি মোশকে ভরে ইমাম শিবিরে ফেরার পথে শহীদ হয়ে যান। তাঁর কবরটি ফোরাত নদীর তীরে তাঁর শাহাদাতের স্থানেই আছে। সেদিন তিনি ছিলেন ইমাম হুসাইনের (আ.) পতাকাবাহী।

আবু নসর বুখারি বর্ণনা করেছেন মুফাযযাল বিন উমার থেকে যে, ইমাম জাফর আস সাদিক্ব (আ.) বলেছেন, “আমার চাচা আব্বাস ছিলেন বুদ্ধিমান এবং তার ছিলো দৃঢ় বিশ্বাস। তিনি আবু আব্দুল্লাহর (ইমাম হুসাইনের ) সাথে থেকে যুদ্ধ করেছেন এবং অনেক কষ্ট ও বিপদ-আপদ সয়ে শহীদ হয়েছেন। বনি হানিফা তার রক্তের দায়ভার বইছে। তিনি ছিলেন চৌত্রিশ বছর বয়স্ক যখন তাকে হত্যা করা হয়। তার এবং উসমান, জাফর এবং আব্দুল্লাহরও মা ছিলেন উম্মুল বানীন, যিনি ছিলেন হিযাম বিন খালিদ বিন রাবি’আর কন্যা।

নয়ই মহররমের বিকালে যখন ইয়াজিদের কুফাস্থ গভর্নর ইবনে জিয়াদের বাহিনী ইমাম শিবিরে হামলার জন্য প্রস্তুত হয় তখন হযরত ইমাম হুসাইন (আঃ) তার ভাই আব্বাসকে দুশমনদের কাছে পাঠান এবং তাঁকে বলেন যে শত্র পক্ষকে বলবে, আমি আজ রাতে আমার প্রতিপালকের সাথে একান্ত আলাপন করবো, নফল নামায আদায় করবো, দো‘আ ও ইস্তেগফার করবো। তুমি যেভাবেই পারো এদেরকে বুঝিয়ে আজ রাতের অবকাশ চাও ও কাল সকাল পর্যন্ত তাদেরকে হামলা থেকে বিরত রাখো। আমি কাল এদের সাথে যুদ্ধ করবো। শেষ পর্যন্ত শত্রুরা ঐ রাতের জন্য হামলা থেকে বিরত থাকে।

বর্ণিত হয়েছে, আবুল ফজল আব্বাস আশুরার দিন রণাঙ্গনে যাবার আগে ইমাম হুসাইন (আঃ)-এর কাছে অনুমতি চাইতে আসনে এবং বলেনঃ ‘‘প্রিয় ভাইজান! আমাকে রণাঙ্গনে যাবার অনুমতি দিন। আমি বেঁচে থাকাতে খুবই অশান্তি বোধ করছি।’’

আবুল ফযল আব্বাস ছিলেন অসাধারণ সুন্দর ও অত্যন্ত দীর্ঘদেহী। এ কারণে শৈশব কালেই তাকে ‘‘ক্বামারে বানী হাশেম’’ বা বনি হাশেমের পূর্ণচন্দ্র  বলা হতো।  তিনি বনি হাশেমের মাঝে পূর্ণচন্দ্রের মত সমুদ্ভাসিত ছিলেন। ইমাম হুসাইন (আ) যখন আশুরার পূর্বরাতে সঙ্গীদের সবাইকে পরীক্ষা করার লক্ষ্যে বলেছিলেন, ইচ্ছে করলে যে কেউ চলে যেতে পারেন ও রাতের আঁধারের মধ্যে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ নিতে পারেন তখন চারদিক থেকে সকলেই বলতে শুরু করলেন, আমরা তা করবো না। সকলের আগে যিনি একথা বললেন তিনি হলেন হযরত ইমামের (আঃ) মহান ভ্রাতা আবুল ফজল আব্বাস।

ইমাম হুসাইন (আ) পিপাসায় কাতার হয়ে ফোরাতের তীরে উপস্থিত হলেন। সাথে রয়েছেন তার  (সৎ) ভাই আব্বাস। ইবনে সা’দের বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ল দু’জনের ওপর। তাদের পথ বন্ধ করল। বনী দারাম গোত্রের এক দুরাচার আবুল ফযল আব্বাস-এর দিকে তীর নিক্ষেপ করলে তা তাঁর পবিত্র মুখে বিদ্ধ হয়। ইমাম হুসাইনই তা টেনে বের করে নেন ও তাঁর হাত রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। তিনি সেই রক্ত ছুড়ে ফেলে বললেন : ‘হে আল্লাহ ! এ জনগোষ্ঠী তোমার নবী নন্দিনীর সন্তানের ওপর এ জুলুম চালাচ্ছে, এদের বিরুদ্ধে তোমার দরবারে বিচার দিচ্ছি। ইবনে সা’দের বাহিনী মুহূর্তের মধ্যে ইমাম হুসাইনের কাছ থেকে হযরত আব্বাসকে ছিনিয়ে নেয়। চতুর্মুখী আক্রমণ ও তরবারির সম্মিলিত আঘাতে হযরত আব্বাস শহীদ হন। তাঁর শাহাদাতে ইমাম হুসাইন কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। কবি তাই তো বলেছেন :

 ‘‘কতই না উত্তম ব্যক্তি –যার জন্য ইমাম হুসাইন (আ) কারবালার এ কঠিন মুসিবতের সময়ও কেঁদেছেন। তিনি ছিলেন ইমাম হুসাইনের (সৎ) ভাই, তাঁর বাবা ছিলেন হযরত আলী, তিনি আর কেউ নন রক্তাক্ত বদন আবুল ফযল আব্বাস। তিনি ছিলেন ইমাম হুসাইনের সহমর্মী, কোনো কিছুই তাকে এপথ থেকে সরাতে পারেনি। প্রচণ্ড পিপাসা নিয়ে ফোরাতের তীরে পৗঁছেন, কিন্তু ইমাম হুসাইন যেহেতু পান করেননি তিনিও তাই পানি মুখে নেননি।

অন্য কবি বলেন : ‘মুষ্টির মাঝে পানি নিলেন, মনভরে পান করে তৃষ্ণা নিবারণ করবেন কিন্তু যখনই ইমাম হুসাইনের পিপাসার কথা মনে পড়লো, হাতের মুঠোর পানিতে অশ্রু ফেলে ফিরে আসলেন।

হযরত আবুল ফযল আব্বাস-এর এ মহান আত্মত্যাগ সকল লেখক, চিন্তাশীলের দৃষ্টিতেই গুরুত্বপূর্ণ।

আল্লামা মজলিসী তার বিখ্যাত গ্রন্থ ‘বিহারুল আনওয়ার’-এ লিখেছেন, ‘হযরত আব্বাস ফোরাতের তীরে গেলেন। যখনই অঞ্জলি ভরে পানি পান করতে চাইলেন তখন হঠাৎ ইমাম হুসাইন ও তাঁর আহলে বাইতের পানির পিপাসার যন্ত্রণার কথা মনে পড়ল। তাই তিনি পানি ফোরাতেই ফেলে দিলেন,পান করলেন না।

আরেকজন কবি বলেন : ‘আবুল ফযল আব্বাস তাঁর সবচেয়ে মূল্যবান প্রাণ ইমাম হুসাইনের জন্যই উৎসর্গ করেছেন। ইমাম হুসাইন (আ) পান করেননি বলে তিনি নিজেও পান করলেন না। মানুষের কর্মের সর্বোত্তম কর্ম ও মূল কাজই তিনি করলেন। আপনি তো গৗরবের দিবসে রাসূলের দুই নাতির ভাই, আর আপনিই তো পানি পানের দিবসে করেছেন আত্মত্যাগ, হে আবুল ফযল!

পানি টলটলায়মান, বাদশাহ তৃষ্ণায় ওষ্ঠাগত,

উদ্যম তার অন্তরে হাতে রয়েছে পানির মশক,

মুর্তাযার সিংহ শাবককে হামলা করলো এমনভাবে

এ যেন অগণিত নেকড়ের মাঝে এক বাঘ।

এমন একটি বদন কেউ দেখেনি যাতে কয়েক হাজার তীর,

এমন একটি ফুল কেউ দেখেনি যাতে রয়েছে কয়েক হাজার কাঁটা।

আশুরা দিবসের পূর্ব-রাত

তাসুয়া বা নয়ই মহররমের দিন শেষে নেমে এল আশুরার পূর্ব রাত। যেন মহাপ্রলয়ের পূর্ব রাত। কারবালা প্রান্তরের বাতাসেও আজ শোকের পূর্বাভাস। বোবা পশুরাও টের পেয়ে গেছে তাদের মধ্যেও অস্বাভাবিক অস্থিরতা। আজ আকাশের তারাগুলোর কোন ঝিকিমিকি নেই, নিস্প্রভ। তাদের মধ্যেও মেঘের আড়ালে লুকাবার প্রচেষ্টা। ফোরাত নদীর পানির প্রবাহ আজ বারবার থমকে দাড়াচ্ছে । বোবা পরিবেশ আর পশুগুলোর বুক ফাটা আর্তনাদে কি যেন বলতে চাইছে । কিন্তু হায়! আমরা তাদের ভাষা বুঝি না। শুধু বাতাসের দীর্ঘশ্বাস আমাদের কানে এসে বাজছে । হ্যাঁ , আগামীকাল রাসুলের কলিজার টুকরো খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতেমার নয়নমনি ইমাম হুসাইন ( আ. ) শহীদ হবেন । নবীজী যে গলদেশে চুম্বন করেছেন সেখানে ছুরি চালানো হবে; যে দেহে তিনি তার অসংখ্য পবিত্র চুম্বনের পরশ বুলিয়েছেন সেই মোবারক দেহের উপর দিয়ে দশটি ঘোড়া দাবড়ানো হবে। হায় কারবালা! হায় হুসাইন!

আগামীকাল সারা বিশ্ব শোকে দুলে উঠবে। স্বয়ং রাসুল এই শোকের স্বত্বাধিকারী। সাত আসমানের ফেরেশতারাও শোকের পোষাক পড়েছেন। ইমাম হুসাইন (আ.) এর বোন যাইনাবের কান্নায় ফেরেশতাদের অশ্রুর বাঁধ ভেঙে গেছে। তাদের ব্যাথা ভরা আহাজারীতে খোদার আরশ আজ কেঁপে উঠেছে। খাতুনে জান্নাত হযরত ফাতিমাও অশ্রু সজল চোখে শরীক হয়েছেন এ মাতমে। কারবালার উষর প্রান্তরে নবী পরিবারের সদস্যদেরকে ইয়াজিদের সৈন্যরা পরিবেষ্টন করে রাখার নয় দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। এ নয় দিন ইমাম হুসাইন (আ.) ইয়াজিদের বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে বহু নসিহত করেন। তারা যে জঘণ্য পাপ করতে উদ্যত হয়েছে তিনি সে সম্পর্কে তাদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করেন।  ইয়াজিদের নিযুক্ত কুফার শাসনকর্তা উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদ ক্রমেই শঙ্কিত হয়ে ওঠে। সে ওমর ইবনে সাদের নেতৃত্বে কারবালায় হাজার হাজার সেনা পাঠাতে থাকে। এই সেনা সংখ্যা অচিরেই বিশ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ইমাম হুসাইন (আ.) তারপরও শত্রুদের সুপথ দেখানোর ব্যাপারে হাল ছাড়েন না। তাঁর অন্তর যে দয়ায় আপ্লুত। তিনি যে বিশ্ববাসীর জন্য রহমত, নবীজীর দৌহিত্র! তাঁর দেহে মহাবীর হযরত আলীর রক্ত প্রবাহিত।

ইমাম শেষ মুহূর্তে তৃষ্ণার্ত অবস্থায় শত্রু সেনাদেরকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "তোমরা কি আমাকে চেন না? তোমরা কি জাননা যে আমার নানা ছিলেন রাসুলে খোদা (সা.)? তোমরা কি জান আমার পিতা আলী বিন আবু তালিব? তোমরা কি জাননা আমার মা হযরত ফাতেমা জাহরা (সা.) হলেন মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.) এর কন্যা? তোমরা কি জান আমার নানী ছিলেন ইসলাম গ্রহণকরী প্রথম মহিলা হযরত খাদিজা (রা.)? তোমরা কি জান না যে সাইয়্যেদুস শোহাদা হযরত হামজা (রা.) ছিলেন আমার পিতার চাচা? তোমরা কি জান না হযরত জাফর তাইয়াব (রা.) ছিলেন আমার চাচা? তোমরা কি জানো রাসুলে খোদার পবিত্র তরবারী আমার হাতে রয়েছে? তোমরা কি জান আমার মাথার এ পাগড়িটি মহানবী (সা.) এর? তোমাদের কি জানা নেই আমার পিতা হযরত আলী (আ.) প্রথম ব্যক্তি যিনি ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং জ্ঞান ও ধৈর্যের ক্ষেত্রে অতুলনীয়? আমার রক্ত তোমরা কি করে হালাল মনে করেছো, অথচ আমার বাবা হাউজে কাউসারের পানি পান করাবেন। কিয়ামতের দিন হামদের পতাকা তাঁরই হাতে থাকবে।"

পাপে যখন মানুষের অন্তর সম্পূর্ণ কলুষিত হয়ে যায় তখন কোন নূরই তাদেরকে হেদায়েত করতে পারে না। ইমাম হুসাইন (আ.) এর এই বলিষ্ঠ ও আবেগময়ী ভাষণেও এজিদের বিভ্রান্ত সৈনিকদের মনে কোন পরিবর্তন এলো না। ইবনে জিয়াদ যুদ্ধ শুরুর জন্য তার সেনাপতি ইবনে সাদকে চরম পত্র দিল। হয় আমিরুল মোমেনিন হিসেবে এজিদের আনুগত্য স্বীকার করতে হবে নতুবা মৃত্যু। এছাড়া আর কোন পথ ইমামের সামনে খোলা রইল না। ইমাম এজিদের আনুগত্যের পরিবর্তে আল্লাহর আনুগত্যকেই বেছে নিলেন। কারণ তিনি নিজেই দোয়া করতেন, "হে আল্লাহ! যতদিন পর্যন্ত আমি তোমার আনুগত্য করি অনুসরণ করি, ততদিন আমার হায়াত বাড়িয়ে দিও। আর যদি তা শয়তানের চারণভূমিতে পরিণত হয় তাহলে আমাকে তোমার কাছে তুলে নিও।"

ইমাম হুসাইন (আ.)’র জীবনের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল শাহাদত। কারণ, রাসুলে খোদা স্বয়ং বলেছেন, শাহাদাত হচ্ছে সবচেয়ে বড় পুণ্য। মনে পড়ে গেল তাঁর মহান পিতার শাহাদতের সময়কার কথাটি, সেটি হলো, কাবার প্রভুর কসম আমি সফল হয়েছি। তিনি বলেছিলেন খোদার কসম, অনাকাঙ্ক্ষিত কিছুই ঘটেনি। মনে পড়ে গেল  নানাজী রাসূল (সা.)’র কথা। তিনি আধ্যাত্মিক জগতে তাঁর উচ্চ মর্যাদার সুসংবাদ তাঁকে দিয়েছিলেন।

এসব ভাবতে ভাবতে তাঁর ক্লান্ত অবসন্ন চোখে তন্দ্রা চলে এলো। স্বপ্নে দেখলেন নানাজান রাসুলে খোদাকে, পিতা হযরত আলীকে, স্নেহময়ী মা ফাতিমাকে, আর ভাই ইমাম হাসানকে (তাদের সবার ওপর মহান আল্লাহর অশেষ রহমত ও দরুদ বর্ষিত হোক)। তাঁরা বললেন, হে হুসাইন! তুমি আগামীকালই আমাদের সাথে মিলিত হবে। এর পরপরই তার তন্দ্রা ভেঙ্গে গেল। ইমাম তাঁর বোন বিবি যাইনাবকে স্বপ্নের কথা খুলে বললেন। ভাইয়ের নিশ্চিত শাহাদাতের কথা শুনে বোনের মন কি আর মানে? যাইনাব (সা.) চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। ইমাম তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন।

ইমাম (আ.) পরদিনের মহা কুরবানির জন্য প্রস্তুত হলেন। এই কুরবানি হবে সম্পূর্ণ নিষ্কলুষ ও আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। এতে তিল পরিমাণ খাঁদ থাকতে পারবে না। কারণ, আগামীকাল যারা আল্লাহর রাস্তায় শহীদ হবেন তাঁদের প্রতিটি রক্ত বিন্দু শত সহস্র রক্ত বিন্দুতে নয় বরং লক্ষ-কোটি রক্ত বিন্দুতে পরিণত হয়ে সমাজ-দেহে সঞ্চালিত হবে। শহীদের খুন রক্তশূন্যতায় আক্রান্ত সমাজ-দেহে নতুন রক্ত প্রবাহ দান করে। তাঁদের ব্যক্তিত্ব ও স্মৃতি যুগযুগ ধরে মানুষকে মুক্তির প্রেরণা যোগায়। তাদেরকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস ও চেতনা দান করে। শহীদরা কিয়ামত পর্যন্ত অমর থাকবেন এবং শেষ বিচারের দিন আল্লাহ তাঁদেরকে এমন জৌলুসসহ হাজির করবেন যে স্বর্গীয় বাহনে উপবিষ্ট নবী-রাসূলরাও তাঁদেরকে সম্মান দেখানোর জন্য নীচে অবতরণ করবেন।

তাই ইমাম তাঁর কাফেলার মধ্যে যাদের নিয়্যতে বিন্দু পরিমাণ গোলমাল আছে তাদের কাছ থেকে মুক্ত হতে চাইলেন। তিনি সবাইকে একস্থানে সমবেত করলেন এবং শাহাদাতের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় ভাষণ দিলেন। তিনি মহান আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, "আমি আমার সঙ্গী সাথীদের চেয়ে কোন সাথীকে বেশি নেককার এবং আমার আহলে বাইতের চেয়ে কোন পরিবারকে বেশি উত্তম মনে করি না। মহান আল্লাহ তোমাদের সবাইকে উত্তম প্রতিদান দিন।"

ভয়াবহ আশুরার পূর্বাভাস নিয়ে ঘনিয়ে এলো অন্ধকার। ধৈর্য্যের মূর্ত প্রতীক ইমাম হুসাইন (আ.) সকলকে কাছে ডাকলেন। বললেন, "ভায়েরা আমার! জেনে রাখো আজকের এই রাত হবে তোমাদের শেষ রাত। আমার সাথে থাকলে তোমরা কেউ রেহাই পাবে না। আগামীকালই আমাকে ও আমার পরিবার পরিজনকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হবে। এমনকি আমার দুধের বাচ্চাকেও এরা রেহাই দেবে না। ভাইসব, তোমরা ইচ্ছে করলে চলে যেতে পারো। আমার হাতে তোমরা যে বায়াত করেছো, তা আমি ফিরিয়ে নিলাম। তোমরা এখন মুক্ত। আমার জন্যে শুধু শুধু তোমরা কেন প্রাণ দেবে? শত্রুরা শুধু আমাকে চায়, তোমাদেরকে নয়। এখন অন্ধকার রাত। যার ইচ্ছা চলে যাও, কেউ দেখতে পাবে না।"

ইমাম ভাষণ শেষ করে তাঁর ভাই আব্বাসকে প্রদীপ নিভিয়ে দিতে বললেন। নির্ভরযোগ্য ও বেশিরভাগ বর্ণনাকারীর বর্ণনা অনুযায়ী যখন অন্ধকার হয়ে এলো তখন ইমামের সাথে আসা কেউই ইমাম বাহিনী ত্যাগ করার সুযোগ নিলেন না। অথচ রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ ছিল। ইমাম হুসাইনের সঙ্গীদের সংখ্যা ছিল একশো জনেরও কম।

আত্মত্যাগের আদর্শে বলীয়ান বিশুদ্ধ অন্তরের এই মর্দে মুমিনদের দিকে তাকিয়ে ইমামের প্রশান্ত মুখটা উজ্জ্বল দীপ্তিমান হয়ে উঠল। মহাকালের মহাত্যাগের জন্যে এরকম বিশুদ্ধ হৃদয়গুলোই তাঁর প্রয়োজন ছিল। তবুও তিনি তাঁর সাথীদের জিজ্ঞেস করলেন, "তোমরা কেন গেলে না?" এ প্রশ্ন শুনে আহলে বাইতের সদস্যরা বলে উঠলেন, "একি বলছেন হযরত! আমরা আপনাকে একা ফেলে কিভাবে চলে যাব? লোকের কাছে গিয়ে কীভাবে মুখ দেখাব? আমরা কি বলব মহানবী (সা.) এর সন্তানকে আমরা একা ফেলে চলে এসেছি। তা কখনো হবে না। নিজের জীবন দিয়ে দেব তবুও আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনার সাথে থেকে শহীদ হব।"

বীরত্ব ও সাহসিকতার অনন্য পরাকাষ্ঠা ইমাম হুসাইন ( আ ) এর ভাই আব্বাস সবার আগে এগিয়ে এসে বললেন , 'আমরা তোমাকে একা রেখে নিজ নিজ শহরে ফিরে যাবো-এরকম কোনো দিন যেন না আসে ৷'

মুসলিম বিন আউসাজা দাঁড়িয়ে বললেন, "প্রিয় ইমাম একি বলছেন আপনি! আপনাকে দুশমনদের হাতে ফেলে রেখে পালিয়ে যাব? খোদা আপনার পরে যেন আমাদের জীবিত না রাখেন। আমরা যুদ্ধ করব। গায়ে শক্তি থাকা পর্যন্ত দুশমনের গায়ে তলোয়ার চালাব, বর্শা চালব। ওগুলো ভেঙে গেলে পাথর মেরে মেরে যুদ্ধ করব।"

সাঈদ বিন আবদুল্লাহ হানাফী বললেন, প্রিয় ইমাম! খোদার কসম আপনাকে রেখে আমরা কোথাও যাবো না। আপনার জন্যে যদি নিহত হই এবং জীবন্ত দগ্ধ হই এবং তা যদি ৭০ বারও হয় তবুও আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না। আপনি মরে যাবেন আর আমরা বেঁচে থাকব এ কি করে হয়? যুহাইর ইবনে কাইন উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, হে মহানবীর প্রিয় সন্তান, খোদার শপথ, আপনি ও আপনার পরিবারকে রক্ষার জন্যে ইচ্ছে করে একবার মরে আবার জীবিত হই, আবার মরে আবার জীবিত হই-এভাবে হাজারবার মরে বেঁচেও চাই নবীজীর খান্দান এবং এই যুবকদের জীবন সকল প্রকার বালা-মুসিবত্‍ থেকে রক্ষা পাক ৷'

ইমাম হাসানের ইয়াতিম পুত্র তেরো বছরের সুদর্শন কাসেম (আ) ইমামের পাশে চীত্কার করে বললেন, চাচাজান ! আমিও কি এই যুদ্ধক্ষেত্রে মারা যাবো? ইমাম তাঁর দিকে দয়ার্দ্র চিত্তে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, মৃত্যু তোমার দৃষ্টিতে কেমন? কাসেম বললেন, 'চাচাজান! আল্লাহর দ্বীনের সহযোগিতা করতে গিয়ে এবং জুলুম-অত্যাচার দূর করতে গিয়ে যেই মৃত্যু ঘটে তাকে আমি মধুর চেয়েও বেশি মিষ্টি বলে মনে করি !'  ইমাম এবার দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, হ্যাঁ, ভাতিজা আমার! তুমিও শহীদ হবে ৷ একথা শুনে এই কিশোর তখনই অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হতে লাগলেন৷ আর ইমাম হুসাইন (আ) চাঁদের রূপালি জ্যোত্স্নায় তাঁর সঙ্গী-সাথীদের জন্যে দোয়া করলেন ৷ অবজ্ঞাপূর্ণ দৃষ্টিতে তিনি শত্রুদের শিবিরগুলোর দিকে তাকিয়ে পবিত্র কোরআনের সূরা আল-ইমরানের ১৭৮ এবং ১৭৯ নম্বর আয়াত দুটি তিলাওয়াত করলেনঃ ‘কাফেররা যেন এই চিন্তা না করে যে, তাদের আমরা যে অবকাশ দিয়েছি তা তাদের মঙ্গলের জন্যে ৷ আমরা তাদেরকে অবকাশ দেই এইজন্যে যে,যাতে তারা তাদের গুনাহের পরিমাণ আরো বাড়িয়ে তোলে,তাদের জন্যে রয়েছে লাঞ্ছনাদায়ক শাস্তি ৷ এটা সম্ভব নয় যে, আল্লাহ মুমিনদেরকে তাদের অবস্থার মধ্যে ফেলে রাখবেন, তবে যে পর্যন্ত না ভালো থেকে মন্দ আলাদা হয়।   

সঙ্গী-সাথীদের এরকম দৃঢ়তা দেখে ইমামের চেহারা মুবারক এক অভূতপূর্ব প্রফুল্লতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। তিনি মহান আল্লাহকে ধন্যবাদ জানালেন। ইমাম হুসাইন (আ.)’র ভাষণের পর সবাই ছত্রভঙ্গ হয়ে মশগুল হলেন ইবাদতে। কেউ সিজদায়, কেউ নামাজে, কেউ মুনাজাতে। কারবালার প্রান্তর সিক্ত হয়ে উঠল বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শহীদদের অশ্রুতে। দুনিয়ার সব ফেরেশতা যোগ দিলেন তাদের এই প্রার্থনায়। #

পার্সটুডে/মু. আমির হুসাইন/আশরাফুর রহমান/২৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

 

ট্যাগ