ইরানের পণ্যসামগ্রী: ইরানের চিকিৎসা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ও গুণগত মান
ইরানের জলে-স্থলে, ক্ষেত-খামারে, বাগ-বাগিচায়, কল-কারখানায় উৎপাদিত হয় বিচিত্র পণ্য সামগ্রী। এর পাশাপাশি খনি থেকেও আহরিত হয় বিভিন্ন সামগ্রী। ইরানি নরনারীদের মেধা ও মনন খাটিয়েও তৈরি করা হয় বিভিন্ন শিল্পপণ্য।
গত আসরে আমরা বলেছিলাম শিরাজের বিভিন্ন হাসপাতাল এবং মেডিক্যাল সেন্টারে উন্নতমানের চিকিৎসা নিয়ে থাকেন ইরানি এবং বিদেশি রোগীরা। মানব ব্রেনের ইলেক্ট্রিক্যাল স্টিমুলেশন সার্জারি,রেয়ার স্যাকরাম বোন টিউমার সার্জারি,কনকারেন্ট লিভার এবং কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশানের মতো জটিল অপারেশনগুলোও অত্যন্ত যত্ন ও সাফল্যের সাথে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মাধ্যমে এখানকার চিকিৎসা কেন্দ্রগুলোতে করা হয়।
যেহেতু এই শহরটিতে ব্যাপক রোগীর আনাগোণা রয়েছে এবং যেহেতু শিরাজকে সবসময়ই দক্ষিণ এবং মধ্য প্রাচ্যের চিকিত্সার প্রধান কেন্দ্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে,তাই বিশ্বের সর্বাধিক উন্নত সুযোগ সুবিধায় সুসজ্জিত একটি স্বাস্থ্য গ্রাম তৈরি করার পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে এখানে। ৮০০ হেক্টর জায়গাজুড়ে নির্মিতব্য ওই স্বাস্থ্য গ্রামে অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দিয়ে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে। এই হেলথ ভিলেজ বা স্বাস্থ্য গ্রামে হাসপাতালসহ হোটেল,বিশ্রামাগার, ক্লিনিক,মেডিক্যাল সেন্টার,আবাসিক এলাকা যেমন থাকবে তেমনি থাকবে বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেন্দ্র,পক্ষাঘাতগ্রস্ত,দুস্থদের জন্যও চিকিৎসার ব্যবস্থা। এই স্বাস্থ্যগ্রাম প্রকল্পটির কাজ যত দ্রুত শেষ হবে তত দ্রুত তার সুযোগ সুবিধাগুলো কাজে লাগিয়ে উপকৃত হতে পারবে দেশি বিদেশি রোগীরা। কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং এই রোগের কারণে সৃষ্ট অন্যান্য রোগও বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে একটি মারাত্মক সমস্যা।

বিশেষজ্ঞ ও গবেষকদের বক্তব্য অনুযায়ী খ্রিষ্টিয় ২০১৫ সালে সমগ্র বিশ্বে প্রায় ১৮ মিলিয়ন মানুষ মারা গেছে শুধু হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। বর্তমানে চল্লিশ কোটিরও বেশি হৃদরোগী রয়েছে বিশ্বজুড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পূর্বাভাস অনুসারে ২০২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী মানব মৃত্যুর গুরুত্বপূর্ণ কারণ হয়ে দাঁড়াবে এই হৃদরোগ। যদিও সাধারণত চল্লিশ বছর বয়সের পরই হৃদরোগের সমস্যাগুলো দেখা দেয় তারপরও যে-কোনো বয়সেই এই রোগ দেখা দেওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। মহিলাদের মাঝে এখন এই রোগের প্রকোপ বেড়ে যাচ্ছে। তবে হৃদরোগ এখনও পুরুষদের মধ্যেই বেশি দেখা যায়। শহরমুখি জীবনযাপনকারীদের মধ্যে এই হৃদরোগের পাশাপাশি স্থূলতা রোগের প্রবণতা বেশি। বলাবাহুল্য স্থূলতা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান কারণ। বিশ্বব্যাপী এখন প্রায় এক শ কোটি মানুষ অতিরিক্ত ওজন ও ফ্যাট মানে স্থূলতায় আক্রান্ত। ডায়াবেটিস, তামাক ব্যবহার বা ধূমপান, শরীরচর্চাহীনতা, মানসিক চাপ, উচ্চ রক্তচাপ, জেনেটিক সমস্যা ইত্যাদি হৃদরোগে আক্রান্ত হবার অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়।
মুখের ইনফেকশান, বায়ু দূষণ, জন্ম নিয়ন্ত্রণের ট্যাবলেট, অনিদ্রা বা কম নিদ্রা, রক্তে চর্বি বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আরও কিছু কারণ। বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ডাক্তার ও হার্ট-সার্জনরা কার্ডিওভাসকুলার অপারেশানসহ হৃদরোগের বিচিত্র চিকিৎসার ক্ষেত্রে ইরানের ব্যাপক উন্নয়নের প্রশংসা করেছেন। ইরানি চিকিৎসকরা বিশ্বব্যাপী ব্যাপক সুনাম সুখ্যাতিও অর্জন করেছেন। জার্মানিতে বহু হাসপাতালের প্রধান ইরানি। এমনকি আমেরিকাতেও অসংখ্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ইরানি।
বলছিলাম বিশ্বের বহু উন্নত দেশের মেডিক্যাল সেন্টার, হাসপাতালের প্রধান ইরানি। এই ঘটনা ইরানের চিকিৎসা ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য ও গুণগত মানের একটা বিজ্ঞাপন বা ব্র্যান্ডিং বৈ কি। যেহেতু ইরান হচ্ছে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে সবচেয়ে নিরাপদ একটি দেশ সে জন্য এই ব্র্যান্ডিং এবং নিরাপত্তার বৈশিষ্ট্য ইরানের স্বাস্থ্য পর্যটনের উন্নয়নের একটা বৃহৎ কারণ হয়ে উঠেছে। কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের চিকিৎসার জন্য বিশেষ করে হার্টের বিচিত্র অপারেশানের জন্য ইরানের অবস্থান বেশ উঁচু পর্যায়ে রয়েছে। ইরানের কার্ডিওভাসকুলার রোগ গবেষণা কেন্দ্রগুলো জেনেটিক, বায়োকেমিক্যাল, স্টেমসেল বায়োলজি, ফার্মাসিসহ আরও বহু ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের জ্ঞান-গবেষণা ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। বিশেষ করে নতুন আবিষ্কৃত জেনেটিক সিস্টেমকে কাজে লাগিয়ে কার্ডিওভাসকুলার চিকিৎসায় বৈপ্লবিক অগ্রগতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে ইরান।
কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ চিকিৎসার জন্য স্পেশালাইজড একটি মেডিক্যাল সেন্টার রয়েছে ইরানের খোরাসানে রাজাভি প্রদেশের পবিত্র শহর মাশহাদে। জাওয়াদুল আয়িম্যা নামের ওই হাসপাতালে রয়েছে ইন্টারন্যাশনাল পেশেন্ট ডিপার্টমেন্ট মানে আন্তর্জাতিক রোগীদের জন্য আলাদা বিভাগ ও ব্যবস্থাপনা। আইসিইউ, সিসিইউসহ ইকোকার্ডিওগ্রাফি, রেডওলোজি, ডপলার সনোগ্রাফি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ সকল বিভাগই রয়েছে এখানে। মাশহাদের আরেকটি মেডিক্যাল সেন্টার হলো রাজাভি হসপিটাল। ইরানের যতগুলো হাসপাতালে মেডিক্যাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে তাদের মধ্যে এই হাসপাতাল একটি। স্বাস্থ্য পর্যটনের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের সেবা দেওয়ার জন্য কানাডার এসিআই সার্টিফিকেট এবং জার্মানির টেমস সার্টিফিকেট লাভ করেছে এই হাসপাতালটি।
বিরতির আগে বলছিলাম আন্তর্জাতিক মানের সেবা দেওয়ার জন্য ইরানের মাশহাদে অবস্থিত রাজাভি হসপিটাল কানাডা এবং জার্মানির সার্টিফিকেট অর্জন করেছে। এই আন্তর্জাতিক মান বা স্ট্যান্ডার্ড বলতে কোন কোন বিষয়কে বোঝানো হয়ে থাকে মানে মানদণ্ডটা কী-সেটা নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে! হ্যাঁ! একটি চিকিৎসা কেন্দ্রের গুণগত মান যাচাইয়ের মাপকাঠি বলতে বোঝায় চিকিৎসার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি থাকা, হাসপাতালের পরিবেশ আনুকূল্য, রোগীর অধিকার যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা, ওষুধ, স্বাস্থ্য সেবা, নার্সিং, চিকিৎসা, যথাযথ খাবার দাবার, জনশক্তি এবং আর্থিক সংস্থান, শারীরিক সম্পদ ইত্যাদি ক্ষেত্রে রোগীর নিরাপত্তা ও অধিকার সংরক্ষণ করা। রাজাভি স্পেশালাইজড হাসপাতালে সেবার মান যেমন উন্নত তেমনি চিকিৎসা ব্যয়ও সাশ্রয়ী। এই দুটি বৈশিষ্ট্য বিদেশি রোগীদের আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
রাজাভি স্পেশালাইজড হাসপাতালে ফার্সি ভাষাসহ ইংরেজি, আরবি, রুশ, তাজিকি, তুর্কি ইত্যাদি ভাষায় রোগীর সঙ্গে চিকিৎসকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তপক্ষের যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার সুযোগ রয়েছে। সে কারণে বিদেশি রোগীরা এখানে এসে নিজেকে বিদেশি মনে করেন না। #
পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/ মো:আবু সাঈদ/ 20
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।