ইরানি কবি আলীকুলি ওয়াজিরি
আজ আমরা হিজরি দ্বাদশ শতকের তথা খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি জীবনীকার ও কবি আলীকুলি খান ওয়াজিরির জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।
হিজরি দ্বাদশ শতকের তথা খ্রিস্টিয় অষ্টাদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি জীবনীকার ও কবি আলীকুলি খান ওয়াজিরির জীবন ও অবদান সম্পর্কিত গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি তার জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল একটি ব্যক্তিগত ট্র্যাজেডি। ওয়ালে দ'গেস্তানি নামে খ্যাত এই কবি ও লেখকের চাচাতো বোনের সঙ্গে তার বিয়ের কথা থাকলেও এক বিশেষ পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে খাদিজেহ সুলতান নামের ওই নারীর বিয়ে হয়ে যায় অন্য এক ব্যক্তির সঙ্গে। ওয়ালে ভারতের মোগল রাজদরবারে চলে আসার পর খাদিজেহ’র সঙ্গে ওয়ালের মাঝে মধ্যে পত্র-যোগাযোগ হয়েছিল। এক পর্যায়ে খাদিজেহ ভারতে যাওয়ার উদ্যোগ নেয়, কিন্তু পথিমধ্যে পশ্চিম ইরানের কেরমানশাহ অঞ্চলে মারা যান। কয়েক মাস পর এ সংবাদ যখন দিল্লিতে ওয়ালে তথা আলীকুলির কানে পৌঁছায় তখন তিনি প্রবল শোকে কাতর হয়ে মারা যান। ১১৭০ হিজরিতে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আলীকুলির বয়স হয়েছিল ৪৬। তাকে দিল্লীতেই দাফন করা হয়। কিন্তু তার কবরের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায়নি।
ওয়ালে দ'গেস্তানি তথা আলীকুলি খান ওয়াজিরি ছিলেন একাধারে কবি ও জীবনীকার।
তার লেখা চারটি সাহিত্য-কর্ম বা বই দেখা যায়। দিওয়ানে ওয়ালে নামে খ্যাত তার কাব্যে রয়েছে ক্বাসিদা, গজল ও নানা ধরনের ফার্সি কবিতা। কবি নিজামির লাইলি ও মাজনুন কাব্যের স্টাইলে লেখা এ কাব্যের মোট পংক্তির সংখ্যা তিন হাজার ২৩০ । অবশ্য কোনো কোনো সূত্রে এই কাব্যের কবিতার পংক্তির সংখ্যা প্রায় চার হাজার বলে উল্লেখ করা হয়েছে। তার লেখা এইসব কবিতা ১১৫৭ হিজরিতে সংগ্রহ করেন মির শামসুদ্দিন ফকির দেহলাভি। আলীকুলির সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ও আন্তরিক বন্ধু ছিলেন শামসউদ্দিন ফকির দেহলাভী।
অবশ্য আলীকুলির এ কাব্যে খাদিজেহ'র মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে লেখা এই কবির কবিতাগুলো স্থান পায়নি। তাই গবেষকরা মনে করেন আলীকুলির কাব্যের কবিতাগুলো এমন সময় সংগ্রহ ও সংকলন করা হয় যখন খাদিজেহ সুলতান জীবিত ছিলেন। ওই কাহিনীর পরিণতি বা শেষাংশ উল্লেখ করা হয়নি কাব্যে। কারণ তখনও তারা জীবিত ছিলেন এবং তারা পুনর্মিলনের ব্যাপারে আশাবাদী ছিলেন।
হাকেম লাহোরি নামের একজন লেখক তার একটি বইয়ে লিখেছেন যে ওয়ালে তথা আলীকুলির দিওয়ান বা কাব্যের মোট পংক্তির সংখ্যা প্রায় সাত হাজার। রামপুরের বিখ্যাত লাইব্রেরিতে ওয়ালেহ'র এই কাব্যের যে কপিটি রয়েছে তাতে এই দাবিকে সত্য মনে করা যায়। কারণ এই কপিতে দেখা গেছে কাব্যটির মোট পংক্তির সংখ্যা ছয় হাজার ৮২১। এই সংস্করণে ওয়ালের ১৮টি ক্বাসিদা, ৫৬১টি গজল, তিনটি দ্বিপদী কবিতা ও ৫৪৭টি রুবাই বা চতুর্পদী কবিতা রয়েছে। এ ছাড়াও এতে রয়েছে ছোট ছোট ৭০টি কবিতা। কিন্তু ওয়ালেহর এ কাব্যটির অন্য যেসব সংস্করণ রয়েছে তাতে আলীকুলির কবিতার সংখ্যা এই সংস্করণের চেয়ে কম দেখা যায়। অবশ্য লন্ডনের ইন্ডিয়ানা অফিস এবং আলীকুলির রিয়াদুশ শোয়ারা নামকী জীবনী গ্রন্থে এমন দুটি ক্বাসিদা রয়েছে যা রামপুরের লাইব্রেরিতে থাকা সংকলনে নেই।
কবি ওয়ালে বা আলীকুলি তুর্কি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় কবিতা লিখেছেন। তার কাব্যে তুর্কি ভাষায় লেখা কয়েকটি গজল ও রুবাই বা চতুর্পদী কবিতা রয়েছে। এ ছাড়াও এতে রয়েছে উর্দু ভাষায় লেখা একটি রুবাই।
ওয়ালে তথা আলীকুলি ফার্সি সাহিত্য-আকাশের অন্যতম নক্ষত্র। দুঃখজনকভাবে তার কবিতার দিকে তেমন একটা দৃষ্টি দেয়া হয়নি। ফার্সি সাহিত্যে বড় বড় অনেক কবি থাকায় ওয়ালেহ'র কবিতা তাদের কবিতার ভিড়ে খুব একটা স্থান পায়নি। কেবল জীবনীকাররা ওয়ালের কবিতার ব্যাপক প্রশংসা করেছেন। বিশেষ করে প্রেম বিষয়ক তার কবিতা ও গজলগুলোর উচ্ছসিত প্রশংসা দেখা যায় এসব বইয়ে। রুবাই লেখার ক্ষেত্রেও অসাধারণ দক্ষতা দেখিয়েছেন ওয়ালে। তার যুগের শীর্ষস্থানীয় রুবাই লেখকদের মধ্যে ওয়ালে ছিলেন অন্যতম। আলীকুলির রুবাইয়াত সুফিবাদী ও প্রেমের ভাবধারায় সমৃদ্ধ।
বিশ্বের নানা অঞ্চলে ওয়ালের লেখা কাব্যের হস্তলিখিত ১৬টি কপি দেখা যায়। এসবের বেশিরভাগই নাস্তা'লিক পদ্ধতিতে লেখা। দিল্লির একটি লাইব্রেরিতে ওয়ালে দ'গেস্তানির হাতে লেখা একটি বইয়ের মূল কপি রয়েছে। এই বইটির নাম বাইয়াদ। এতে ফার্সিভাষী অনেক কবি ও লেখকের কবিতা ও বক্তব্য স্থান পেয়েছে।
ওয়ালের লেখা আরেকটি বইয়ের নাম মুনশাআত তথা পত্রাবলী। এতে বিভিন্ন ব্যক্তির চিঠি-পত্র স্থান পেয়েছে। নানা বিষয়ে লেখা এইসব চিঠির কোনো কোনোটি পদ্য আকারে রয়েছে। খাদিজেহ সুলতানের কাছে ওয়ালের লেখা কিছু চিঠিও রয়েছে এ বইয়ে। খাদিজেহ'র কাছে তিনি অন্তত একশটি চিঠি লিখেছিলেন। যাই হোক এ বইটির শেষাংশে দিওয়ানে ওয়ালের একটি সংস্করণও রয়েছে যা লেখা হয়েছিল হাতে। এই সংস্করণটির মূল কপি রামপুরের রাজা বা রেজা লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত রয়েছে।
ওয়ালের সবচেয়ে বিখ্যাত বইটির নাম রিয়াদ আশ শোয়ারা। ভারতে আসার পর কবিদের জীবনী সংক্রান্ত এ বইটি লেখেন তিনি। হিজরি ১১৬০ থেকে ১১৬২ সনে এ বই লিখেছিলেন ওয়ালে। বইটির রয়েছে মোট ৫টি খণ্ড। অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য এ বইয়ে কবিদের কবিতার উদ্ধৃতি ও সেসবের সমালোচনাও রয়েছে।#
পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১২
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।