অক্টোবর ১৩, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা বলেছি, বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে পাশ্চাত্যের আধুনিক শহুরে জীবন মানুষকে ক্রমেই ব্যক্তি কেন্দ্রিকতা ও স্বার্থপরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এর ফলে মানুষ আরও বেশি একঘরে হয়ে পড়ছে, একাকীত্ব অনুভব করছে।

পাশ্চাত্যে যন্ত্র ও প্রযুক্তির প্রভাব পারস্পরিক সম্পর্ক ও সহযোগিতাকে আরও জটিল করে তুলেছে। মানুষের জীবনে প্রযুক্তির ব্যবহার যত বাড়ছে ব্যক্তি তত বেশি আত্মকেন্দ্রিকতা বাড়ছে। এর ফলে সামাজিক সম্পর্কে দূরত্ব ও শূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ কার্যত একা হয়ে পড়ছে। এর ফলে মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ব্রিটেনের মানসিক স্বাস্থ্য ফাউন্ডেশন এক রিপোর্টে বলেছে, প্রযুক্তি কখনোই মানুষে মানুষের যে সম্পর্ক সেটার বিকল্প হতে পারে না। তাদের মতে, ব্রিটেনে প্রতি দশ জনে একজন একাকীত্ব বোধ করছে। দীর্ঘ সময় ধরে কাজে ব্যস্ত থাকার পর যখন আবার যন্ত্র ও প্রযুক্তি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তখন তার সম্পর্কের ভিত্তি ও মাধ্যম হয়ে ওঠে যন্ত্র। টাইমস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত এক প্রতিবেদনে এক জরিপের ফলাফল তুলে ধরে বলা হয়েছে, উত্তরদাতাদের প্রায় অর্ধেকের ধারণা মানুষ আগের চেয়ে বেশি একঘরে হয়ে পড়েছে এবং একে অপরের মধ্যে দূরত্ব বেড়েছে। এটা সব বয়সীদের ক্ষেত্রেই ঘটছে।

একাকীত্বের নানা নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। জনমত জরিপ সংস্থা 'গ্যালোপ' জানিয়েছে, ২০১৮ সালে আমেরিকার অর্ধেকের বেশি মানুষ চরম উদ্বেগ ও হতাশায় ভুগছে। এই জরিপটি একবছর ধরে বিশ্বের ১৪০টি দেশের এক লাখ ৫১ হাজার মানুষের মধ্যে চালানো হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৫৫ শতাংশ মানুষ জানিয়েছে, তারা সব সময় ধ্বংসাত্মক মানসিক চাপ ও উদ্বেগের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। গত এক দশকে তাদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। মানুষের উদ্বেগ ও হতাশার একটি বড় কারণ হলো মানসিক চাপ ও অস্থিরতা। মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা এসবই মানুষের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার ওপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আর এ ধরণের সমস্যার পেছনে রয়েছে ক্রমবর্ধমান সামাজিক সমস্যা। কিছু দিন আগেই ব্রিটিশ দৈনিক ইন্ডিপেন্ডেন্ট লিখেছে, ব্রিটেনের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে মানসিক সমস্যা বিশেষকরে চরম টেনশনের মতো সমস্যা নিয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেছে। গত এক দশকে এ ধরণের সমস্যার সম্মুখীন মানুষের সংখ্যা বেড়েছে ২৮ শতাংশ।

বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে পেশাজীবী রোগীদের ৪৪ শতাংশের রোগের পেছনে কাজ করেছে মানসিক চাপ এবং উদ্বেগ-উত্তেজনা। ১০ বছর আগেও এ সংখ্যা ছিল ৩৫ শতাংশ। ব্রিটেনের পূর্ণ বয়স্ক মানুষদের ৫০ শতাংশই মনে করেন, বর্তমান আধুনিক জীবন ব্যবস্থার যে বাড়তি চাপ তা মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। দীর্ঘ সময় ধরে কম্পিউটারের সামনে বসে থেকে একটানা কাজ করা, শারীরিক তৎপরতা হ্রাস এবং ফাস্টফুডের মতো খাবারের প্রতি ঝোকপ্রবণতার কারণে মানুষের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের মতো রোগ বেড়ে গেছে এবং টাইপ টু ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়ছে। বিশ্বের সাড়ে ১৪ কোটি ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ বাস করেন শহরে। এছাড়া পাশ্চাত্যের শহর ভিত্তিক জীবন ব্যবস্থার কারণে নানা ধরণের নতুন রোগ দেখা দিচ্ছে। 

ইরানের স্নায়ুরোগ বিশষজ্ঞ ডা. সাইয়্যেদ মাসুদ নাবাবি'র মতে, মাল্টিপল স্কলেরোসিস বা এমএস রোগ হচ্ছে শহুরে রোগ। এটি বর্তমান আধুনিক সমাজের জীবনাচারের ফসল। এর কারণ হলো, মানুষের জীবনপ্রণালী যত বেশি আধুনিকতার দিকে ধাবিত হবে এবং শিল্প ও প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে মানসিক চাপ, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা তত বাড়বে। মানুষের মানসিক ক্লান্তি বাড়তে থাকবে। মানসিক দিক থেকে আরও বেশি জটিল অবস্থার সম্মুখীন হবে।  বিষণ্ণতা হচ্ছে বর্তমান আধুনিক বিশ্বের সবচেয়ে সাধারণ একটি মানসিক সমস্যা।  এ কারণে ২০১৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা 'ডাব্লিউএইচও'  বিষণ্ণতা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়। ওই বছর তাদের স্লোগান ছিল- 'বিষণ্ণতা মোকাবেলায় আসুন আমরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলি'। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বা ডাব্লিউএইচও'র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ৩০ কোটি মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে। এসব রোগীর বেশিরভাগই বাস করেন পাশ্চাত্যে। ২০০৫ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে এ ধরণের রোগীর সংখ্যা বেড়েছে ১৮ শতাংশ। এই সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী প্রতি বছর বিষণ্ণতার কারণে ক্ষতি হচ্ছে এক ট্রিলিয়ন ডলার।

আগামী কয়েক দশকের মধ্যে মানসিক সমস্যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রধান সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। এর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে যুদ্ধ-বিগ্রহ, অর্থনৈতিক সমস্যা ও সামাজিক বৈষম্যের কারণে মানুষের মধ্যে বিষণ্ণতা বাড়ছে। আর উন্নত দেশগুলোতে বাড়ছে তাদের লাইফ স্টাইলের কারণে। শিল্পোন্নত দেশগুলোতে শহুরে মানুষের সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে। আর যেকোনো শহরের একটি বৈশিষ্ট্য হলো ছোট্ট স্থানে বেশি মানুষের বাস। মানুষের এই ভিড় বিষণ্ণতার একটা বড় কারণ। এছাড়া রয়েছে মদের ব্যবহার। পাশ্চাত্যের জীবন ব্যবস্থায় মদপানের প্রবণতা বাড়ছে। এছাড়া সামাজিক সম্পর্ক দুর্বল হয়ে পড়ছে শহুরে জীবনে। এই সমস্যা গোটা মানব সমাজেরই ক্ষতিসাধন করছে। সামাজিক যোগাযোগ হ্রাসের প্রবণতা পাশ্চাত্যে এতটাই বাড়ছে যে, এটাকে তারা এখন স্বাভাবিক বিষয় হিসেবে নিচ্ছে। 

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, পাশ্চাত্যে একই অ্যাপার্টমেন্টে বাস করেও অনেকেই তার পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দার নামটা পর্যন্ত জানে না। পাবলিক যানবাহনে চলার সময় মানুষ পাশাপাশি বসলেও তাদের মধ্যে কোনো ধরণের যোগাযোগ স্থাপিত হয় না, সালাম বিনিময় হয় না। কেউ কাউকে অভিবাদন জানায় না। যে যার মোবাইল বা ইলেকট্রনিক ডিভাইস নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সেখানে এরিমধ্যে মানুষের আচার-আচরণে যন্ত্রের প্রভাব ব্যাপকভাবে লক্ষণীয়। সবাই যেন রোবটের মতো হয়ে যাচ্ছে। এটা ঠিক যে নতুন প্রযুক্তি মানুষের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগের সুযোগ সহজ করেছে, একে অপরকে খুব সহজেই বার্তা দিতে পারছে। কিন্তু এসব বার্তাও যেন যন্ত্রের মতোই আবেগ-অনুভূতিহীন। আসলে আবেগ ও ভালোবাসা-মাখা সম্পর্ক এবং যোগাযোগ কেবল তখনি সম্ভব যখন মানুষ সামনাসামনি বসে কথা বলেন, ভাব বিনিময় করেন।

মানুষ এখন তার প্রতিদিনের একটা বড় অংশই কারাখানা, কোম্পানি বা অফিসে কাটাচ্ছেন এবং প্রতিদিন একই ধরণের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। একঘেয়ে কাজ করে যখন একজন ব্যক্তি ঘরে ফেরেন তখন তিনি থাকেন ক্লান্ত, আর কিছুই তখন তার ভালো লাগে না। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আবেগ-ভালোবাসার সম্পর্ক সুদৃঢ় করার ধৈর্য্য তিনি হারিয়ে ফেলেন। ফলে পারিবারের সদস্যদের মধ্যে মনের দূরত্ব কমে না বরং বাড়তেই থাকে। পাশ্চাত্যে এ সমস্যা ক্রমেই মারাত্মক আকার ধারণ করছে।#

পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ