অক্টোবর ১৩, ২০২০ ২১:৩০ Asia/Dhaka

আজ আমরা হিজরি দশম ও একাদশ শতকের তথা খ্রিস্টিয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কাওয়ামী শিরাজী ওরফে মোল্লা সাদরার জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

সাদরুল মুতাআল্লেহীন ও  মোল্লা সাদরা নামে প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক  মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কাওয়ামী শিরাজী ৯৭৯ হিজরীতে ইরানের শিরাজে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০৫০ হিজরীতে হজ্ব হতে ফেরার পথে বসরায় ইন্তেকাল করেন। মোল্লা সাদরার বাবার নাম খাজা ইব্রাহীম ক্বাওয়ামি। তিনি ছিলেন একজন জ্ঞানী রাজনীতিবিদ ও ধার্মিক ব্যক্তিত্ব। সাফাভি শাসনামলে শিরাজ প্রদেশ যখন ছিল স্বশাসিত অঙ্গরাজ্যের মত তখন মোল্লা সাদরার বাবা ছিলেন এই রাজ্যের একজন মন্ত্রী। অনেক বছর পর্যন্ত নিঃসন্তান থাকার পর খাজা ইব্রাহীম ক্বাওয়ামি হিজরি ৯৭৯ বা মতান্তরে ৯৮০ সনে তথা ১৫৭১ খ্রিস্টাব্দে একটি পুত্র সন্তানের অধিকারী হন। তিনি এই ছেলের নাম রাখেন সাদরুদ্দিন মোহাম্মাদ। তবে তিনি বেশিরভাগ সময়ই তাকে সাদরা বলে উল্লেখ করতেন। আর এ কারণেই পরবর্তীকালে সাদরা মোল্লা সাদরা নামেই বেশি পরিচিত হন। একটি অভিজাত পরিবারের সদস্য হিসেবে তিনি প্রচলিত নানা বিদ্যায় জ্ঞান অর্জন শুরু করেন গৃহ-শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে। আরবি, ফার্সি ও ক্যালিগ্রাফি ছাড়াও তিনি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা বিদ্যায়ও দক্ষতা অর্জন করেন। এ ছাড়াও তিনি বাল্যকালেই অশ্বারোহন ও অশ্বচালনা, শিকার ও যুদ্ধ-বিদ্যায়ও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন বলে মনে করা হয়।     

মোল্লা সাদরা কিশোর বয়সেই ইসলামী আইন, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন শাস্ত্রেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তবে অন্য সব শাস্ত্রের চেয়ে দর্শন ও ইরফান শাস্ত্রের প্রতি তার আগ্রহ ছিল বেশি। আত্তার, এরাক্বী, ইবনে আরাবি ও রুমির মরমি সাহিত্য যৌবনের প্রারম্ভেই তাকে গভীরভাবে আকৃষ্ট করেছিল। এইসব শাস্ত্রের কিছু অংশ তিনি শিরাজে ও কিছু অংশ ক্বাজভিনে আয়ত্ত্ব করেছিলেন। ক্বাজভিন ছিল সে যুগে সাফাভী সম্রাটদের রাজধানী।  ৯৮৫ হিজরি বা ১৫৭৭ সনে মোল্লা সাদরার বাবা সপরিবারে ক্বাজভিনে আসেন নতুন সম্রাটের উপদেষ্টা ও মন্ত্রী হিসেবে।  এ সময় সাদরার বয়স ছিল মাত্র ৬ বছর। খুব অল্প সময়েই তীক্ষ্ম মেধাবী সাদরা বড় বড় শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে নানা শাস্ত্রের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষা শেষ করে উচ্চ পর্যায়ের পড়াশুনা শুরু করেন। ক্বাজভিনে শেখ বাহাউদ্দিন আমেলি তথা শেখ বাহাই ও মীর মোহাম্মাদ বাকের তথা মীরদমাদ ছিলেন সাদরার অন্যতম শিক্ষক। কয়েক শতক ধরে আলোক বিকিরণ করে আসা এ দুই জগত-বিখ্যাত আলেমের ছাত্রদের মধ্যে সাদরা খুব শিগগিরই শীর্ষ পর্যায়ের মেধাবী ছাত্র হয়ে ওঠেন।

মোল্লা সাদরার শিক্ষক শেখ বাহাই কেবল ইসলামী শাস্ত্রগুলোতেই সুদক্ষ পণ্ডিত ছিলেন না, তিনি গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, প্রকৌশল, স্থাপত্য  ও চিকিৎসাবিদ্যায় এবং কোনো কোনো আধ্যাত্মিক বিদ্যায়ও বড় ধরনের বিশেষজ্ঞ ছিলেন। সুফিবাদী চিন্তাধারার কারণে তিনি দর্শন ও কালাম শাস্ত্রের ক্লাস নিতেন না।

মোল্লা সাদরার আরেকজন বড় শিক্ষক দর্শনের প্রসিদ্ধ ব্যক্তিত্ব মীর দমাদ নিজেকে ‘দর্শনের তৃতীয় শিক্ষক’ নামে অভিহিত করতেন। মুসলিম দার্শনিকরা অ্যারিস্টোটলকে ‘দর্শনের প্রথম শিক্ষক’ এবং আবু নাসের ফারাবীকে ‘দর্শনের দ্বিতীয় শিক্ষক’ বলে অভিহিত করেন। তিনি দর্শনশাস্ত্র ছাড়াও গণিত, চিকিৎসা এবং ধর্মীয় বিষয়, যেমন তাফসীর, হাদীসশাস্ত্র, রিজাল, উসূল ও ফিকাহ্শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি ‘ইশরাক’ নামে একটি কবিতা গ্রন্থও রচনা করেন। সাদরুল মুতাআল্লেহীন মোল্লা সাদরা তাঁকে নবী ও রাসূলদের জ্ঞানের উত্তরাধিকারী হিসাবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন।  সাদরা মীর দমাদের কাছ থেকেই দর্শন ও ইরফান বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান অর্জন করেছেন। তিনি মীরদমাদকে নিজের প্রকৃত ওস্তাদ ও দিক-নির্দেশক মুর্শিদ বলে উল্লেখ করতেন। 

মোল্লা সাদরার জীবনীকে তিনটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়: শিক্ষা জীবন, নির্জন ইবাদতের জীবন ও রচনা বা লেখালেখির জীবন।

মোল্লা সাদরার কোনো কোনো ইরফানি চিন্তাধারাকে সে যুগের কোনো কোনো অগভীর-দৃষ্টিবাদী আলেম বুঝতে পারেননি। অংশত তাদের চাপের মুখে ও নিজেরও মনের টানে তিনি ইস্ফাহান ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাধনা ও গবেষণার প্রয়োজনে সাদরা এ সময় কোমের কাছাকাছি কাহাক গ্রামে চলে আসেন। এখানে তিনি সাত বা ১৫ বছর বসবাস করেন। কাহাকে তিনি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অনেক রহস্য আত্মিকভাবে উপলব্ধি করেন যা বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তি দিয়ে অর্জন করা সম্ভব হত না। এরপর তার জ্ঞানের খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে ফার্স প্রদেশের শাসক আল্লাহওয়ার্দি খান শিরাজে তার প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করতে সাদরাকে আমন্ত্রণ জানান। সাদরা এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। শিরাজে খান মাদ্রাসা নামে পরিচিত এই মাদ্রাসা সাদরার উপস্থিতিতে হয়ে ওঠে ইরানের সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র। #  

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।