অক্টোবর ১৫, ২০২০ ১৫:৩০ Asia/Dhaka

গত পর্বের ধারাবাহিকতায় আজও আমরা হিজরি দশম ও একাদশ শতকের তথা খ্রিস্টিয় ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক মুহাম্মদ ইবনে ইবরাহীম কাওয়ামী শিরাজী ওরফে মোল্লা সাদরার জীবন ও অবদান নিয়ে কথা বলব।

প্রখ্যাত ইরানি দার্শনিক সাদরুদ্দিন মোহাম্মাদ শিরাজি ওরফে মোল্লা সাদরার জীবন ও অবদান সম্পর্কিত গত পর্বের আলোচনায় আমরা জেনেছি অভিজাত পরিবারের সদস্য মোল্লা সাদরা কিশোর বয়সেই প্রচলিত প্রায় সব জ্ঞান বিজ্ঞানে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি ইসলামী আইন, যুক্তিবিদ্যা ও দর্শন শাস্ত্রেও দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। শেখ বাহাউদ্দিন আমেলি তথা শেখ বাহাই ও মীর মোহাম্মাদ বাকের তথা মীরদমাদ ছিলেন মোল্লা সাদরার অন্যতম শিক্ষক। এ দুই জগত-বিখ্যাত আলেমের ছাত্রদের মধ্যে সাদরা খুব শিগগিরই শীর্ষ পর্যায়ের মেধাবী ছাত্র হয়ে ওঠেন।

সাদরুদ্দিন মোহাম্মাদ শিরাজি ওরফে মোল্লা সাদরার কোনো কোনো বক্তব্য ও চিন্তাধারা একদল সংকীর্ণমনা আলেমকে শত্রুতার দিকে ঠেলে দেয়। এ পরিস্থিতিতে মোল্লা সাদরা কোমের কাছে চলে এসে আধ্যাত্মিক ও জ্ঞান সাধনায় মশগুল হন। এরপর তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে তিনি শিরাজের একটি মাদ্রাসায় শিক্ষকতার প্রস্তাব পান। শিরাজে খান মাদ্রাসা নামে পরিচিত এই মাদ্রাসা মোল্লা সাদরার উপস্থিতিতে হয়ে ওঠে ইরানের সবচেয়ে বিখ্যাত ও প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র।

গত পর্বে আমরা আরও জেনেছি, সাদরুদ্দিন মোহাম্মাদ শিরাজি ওরফে মোল্লা সাদরা ৯৭৯ হিজরীতে ইরানের শিরাজে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১০৫০ হিজরীতে হজ্ব হতে ফেরার পথে বসরায় ইন্তেকাল করেন। মোল্লা সাদরার জীবনকে তিনটি পর্যায়ে ভাগ করা যায়: শিক্ষা জীবন, নির্জন ইবাদতের জীবন ও রচনা বা লেখালেখির জীবন।

শিক্ষাজীবনে মোল্লা সাদরা মাশ্শায়ী ও ইশরাকী ধারার দর্শন চর্চার পাশাপাশি কালামশাস্ত্র ও ইরফানী চিন্তার ওপরেও গবেষণা করেন। তিনি এ সম্পর্কে বলেছেন : “আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাই এ জন্য যে, জীবনের একটা অংশ দার্শনিক ও তার্কিকদের মত নিয়ে গবেষণা চালিয়েছি। আমি তাদেরকে দার্শনিক আলোচনার ক্ষেত্রে অসংযত ও অপরিপক্ব পেয়েছি। এক পর্যায়ে ঈমানের আলোয় বুঝতে পারলাম যে, তাদের যুক্তি বন্ধ্যা ও পথ বন্ধুর এবং আল্লাহ্ এ ক্ষেত্রে আমাকে সাহায্য করলেন।” 

 মোল্লা সাদরা তাঁর শিক্ষাজীবন ইসফাহানে কাটান। বলা হয় এ সময়েই তিনি ‘তারহুল কৌনাইন’ গ্রন্থটি লেখেন যাতে তিনি অস্তিত্বের ঐক্য  তথা ওয়াহ্দাতে উজূদ বিষয়ে মত ব্যক্ত করেন।

মোল্লা সাদরা একাকী ইবাদতে রত হওয়ার পর্যায়ে ১৫ বছর আত্মসংশোধনের লক্ষ্যে পবিত্র শহর কোমের কাছে ‘কাহাক’ গ্রামে আধ্যাত্মিক চর্চায় রত হন। সে সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে তিনি বলেছেন : “আমার কাছে এমন এক রহস্য উন্মোচিত হলো যা বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তির মাধ্যমে অর্জন সম্ভব ছিল না। যা কিছু দার্শনিক যুক্তির মাধ্যমে রপ্ত করেছিলাম তার প্রকৃত রূপ আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে আমার অন্তর্দৃষ্টিতে পূর্ণরূপে ধরা দিল।”

মোল্লা সাদরার জীবনের তৃতীয় অধ্যায় বা পর্যায় হল রচনার পর্যায়।  এ পর্যায়ে তিনি তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থ ‘আসফার’ লিখেছেন। যদিও তাঁর জীবনের দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষদিকে তিনি এ বই লেখার কাজে হাত দিয়েছিলেন। উল্লেখ্য, শিরাজে খান মাদ্রাসায় পবিত্র কুরআনের তাফসির ও হাদিস ছাড়াও দর্শন শাস্ত্র পড়াতেন মোল্লা সাদরা। এ সময় তিনি লেখালেখিও শুরু করেন। শিরাজে বসেই তিনি লিখেছিলেন 'সে আস্‌ল্‌' বা তিন মূলনীতি শীর্ষক বই। ফার্সি ভাষায় লেখা এ বইয়ের মাধ্যমে মোল্লা সাদরা তার বিরোধী তৎকালীন চিন্তাবিদ, দার্শনিক ও ইসলামী আইনবিদ বা ফকিহদের চিন্তাধারার ওপর তীব্র হামলা চালিয়ে নিজের চিন্তাধারা বা মতাদর্শকে ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন।

বলা হয় মোল্লা সাদরা সাত বার পায়ে হেঁটে পবিত্র হজব্রত পালন করেন। এখন থেকে প্রায় চারশ বছর আগে মরুপথে এইসব আধ্যাত্মিক সফর ছিল ব্যাপক কষ্ট ও খোদাপ্রেমের সাধনায় ভরপুর। হজের উদ্দেশ্যে সপ্তম সফরের সময় ১০৫০ হিজরীতে তথা খ্রিস্টিয় ১৬৪০ সনে বসরা শহরে ইন্তেকাল করেন মোল্লা সাদরা। এ সময় তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১।  এই মহান দার্শনিক ও আরেফকে পবিত্র নাজাফ শহরে হযরত আলী (আ)'র পবিত্র মাজারের বাম পাশের চত্ত্বরে দাফন করা হয়। মোল্লা সাদরার ছয় সন্তানের সবাই সে যুগের প্রখ্যাত আলেম ও চিন্তাবিদ হিসেবে সম্মান অর্জন করেছিলেন। এই ছয় সন্তানের মধ্যে চার জন ছিলেন কন্যা সন্তান। পুত্রদের নাম মোহাম্মাদ ইব্রাহিম আবু আলী  ও নিজামউদ্দিন আহমাদ। এ দুই জন ছিলেন মোল্লা সাদরার দ্বিতীয় ও চতুর্থ সন্তান। তার প্রথম ও তৃতীয় সন্তানের নাম যথাক্রমে উম্মে কুলসুম ও যোবাইদেহ খাতুন এবং মোল্লা সাদরার তৃতীয় কন্যার নাম যাইনাব ও  তার সর্বকনিষ্ঠ সন্তানও ছিলেন কন্যা যার নাম মাসুমা খাতুন।#

পার্সটুডে/মু.আমির হুসাইন/ মো: আবু সাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।