অক্টোবর ২০, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

বলেছিলাম যে, বিশাল একটি দেশ ইরান। এ দেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে ইতিহাস-ঐতিহ্য,পুরাতত্ত্ব আর সংস্কৃতির বিচিত্র সমৃদ্ধ উপাদান।

গত আসরে আমরা ইরানের ঐতিহাসিক প্রদেশ ইয়াযদের দিকে গিয়েছিলাম। ইয়াযদের মূল শহরের নামও ইয়াযদ। ওই শহরটিকে আমরা দূর থেকে এক নজর দেখেছি। আমরা দেখেছি বিশেষ ধরণের ঘর-বাড়ীতে সুসজ্জিত ইয়াযদ শহর। যেহেতু মরুর আবহাওয়া উষ্ণ, সেহেতু গরম বাতাসের উষ্ণতা হ্রাসের স্থানীয় ব্যবস্থায় এবং প্রক্রিয়ায় ঘরগুলো নির্মিত।

ঘরের ছাদে বাতাসের বিপরীতে মুখ করে বায়ু সঞ্চালনের চমৎকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাটির তৈরী এ ঘরগুলো দেখতে খুবই সুন্দর। নব নির্মিত প্রশস্ত সড়কগুলোর পাশে বর্তমানেও ছোট এবং সঙ্কীর্ণ গলি দেখা যায়। গলির ধারে ঘরগুলো পরস্পর লাগোয়া। বলেছিলাম যে ইয়াযদকে বলা হয় ইরানের মরুরত্ন বা মরুমণি। এই মরুমণির বিখ্যাত কিছু দর্শনীয় নিদর্শন দেখার চেষ্টা করবো আজ।

ইয়াযদের বড়ীঘর নির্মানের এই সহজ এবং চমৎকার পদ্ধতি কিন্তু হঠাৎ করে অর্জিত নয় বরং এর পেছনে আছে যুগ-যুগান্তরের অভিজ্ঞতা। যুগ যুগ ধরে প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা মোকাবেলা করে করে ইয়াযদের জনগণ শিখেছে টিকে থাকার উপায়। শিখেছে ঘর বাঁধার উপযুক্ত কৌশল। সেই যুগ-যুগান্তরের সঞ্চিত অভিজ্ঞতায় নির্মিত বড়ীঘরের সর্বশেষ ও আধুনিক সংস্করণই বর্তমান ইয়াযদে লক্ষ্য করা যায়। ইয়াযদের স্থাপত্যগুলো দেখার মত। প্রতিটি মসজিদ, দরজা, সদর দরজা, মাদ্রাসা-ময়দান বাড়ী-ঘর প্রভৃতিতে শিল্পের যে চমৎকার নিদর্শন লক্ষ্য করা যায়, তাতে ইয়াযদ শহরটিকে কেবল একটি পর্যটন কেন্দ্র বলাই যথেষ্ট নয়, একে বরং ইরানের শিল্প-সংস্কৃতির মেরুদণ্ডই বলা ভালো। বহু প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই ইয়াযদ।

ইয়াযদ জামে মসজিদ উল্লেখযোগ্য একটি ঐতিহাসিক স্থাপনা। শ্রেষ্ঠ ইসলামী শিল্পকলার এক ঐতিহাসিক নিদর্শন এই মসজিদ। মসজিদটি বেশ পুরানো। হিজরী অষ্টম শতাব্দীর প্রথমার্ধে মসজিদটি নির্মান করা হয়েছে। যথেষ্ট কারুকার্য করা হয়েছে মসজিদটিতে। আকাশচুম্বী মিনার আর বিস্তৃত উঠোন যেমন আছে মসজিদটির তেমনি আছে বিশ্রামের জন্যে নির্মিত ছাদ বিশিষ্ট প্রশস্ত আঙ্গিনা। মসজিদ জুড়ে উজ্জ্বল টাইলস আর চকের প্রলেপ সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েকগুন। বিশালত্ব, চমৎকারিত্ব, শিল্প সুষমা প্রভৃতি বৈশিষ্ট্যের জন্যে ইয়াযদের ইতিহাসে মসজিদটি স্মরণীয় হয়ে আছে। ইয়াযদের জামে মসজিদটির আয়তন প্রায় সাত হাজার বর্গমিটার। মসজিদের খোলা আঙ্গিনাও বেশ প্রশস্ত। গম্বুজের উচচতা প্রায় ৩০ মিটার। ভেতর থেকে গম্বুজের স্তর বা ছাদ লক্ষ্য করা যাবে। একটি ছাদ থেকে আরেকটি ছাদের দূরত্ব ১১ মিটার। গম্বুজের নীচে দাড়িয়ে উপরের দিকে তাকালে মনে হবে যেন এর চূড়া আকাশে গিয়ে ঠেকেছে।

ইয়াযদ জামে মসজিদ নিয়ে বলছিলাম আমরা। এই মসজিদের যে মেহরাব অর্থাৎ যেখানে দাঁড়িয়ে ইমাম বক্তৃতা দেন, সে জায়গাটি ভীষণ সুন্দর করে বানানো হয়েছে। মেহরাবের মাঝামাঝি জায়গায় লম্বালম্বি ভাবে সুন্দর করে রাসূল(সাঃ)এর আহলে বাইতের নাম লেখা হয়েছে। মেহরাবের ভেতরের অংশে নকশা করা লেখা বা ক্যালিগ্রাফির কারুকাজ করা হয়েছে। দুটি ফন্টে ক্যালিগ্রাফিগুলো করা হয়েছে। একটি হলো নাসখ লিপি অপরটি কুফি লিপি। এই নাসখ এবং কুফি লিপিতে লেখা হয়েছে “ক্বালাল্লাহু আয্যা ও জাল্লা আকেমিস সালাত'। অর্থাৎ আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন, নামায কায়েম কর।

ইরানের মসজিদগুলোর একটা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, মসজিদের বিশাল একটা গম্বুজ থাকবে, মিনার থাকবে। গম্বুজের ভেতরে এবং বাইরে ব্যাপক কারুকাজ থাকবে। বাইরে সাধারণত টাইলসের কাজ করা হয়। পুরো গম্বুজেই এই কাজ করা হয়। দূর থেকে টাইলসের কারুকাজকে মনে হবে মিনিয়েচার। ইয়াযদ জামে মসজিদের গম্বুজেও আছে এ ধরণের কারুকাজ। বিশেষ করে গম্বুজের ভেতরের অংশে শিলালিপির কারুকাজ যে কোন মানুষকে বিমুগ্ধ করে। সেখানে এই কাজগুলো যে করেছে, সেই শিল্পী বা রাজমিস্ত্রীর নামও খোদাই করে লেখা আছে। তা ছাড়া লেখা হয়েছে মসজিদ তৈরীর সন। সন হলো হিজরী ৭৭৭ অর্থাৎ ইংরেজী ১৩৫৬ । আর শিল্পীর নাম হলো আব্দুস সাইদ মোঃ কাদুক। ইয়াযদেরই রাজমিস্ত্রী ছিলেন তিনি।

আমরা ইয়াযদ জামে মসজিদ নিয়ে কথা বলছিলাম। মসজিদ হলো নামায পড়ার ঘর, জামে মানে হলো যেখানে জুমার নামাযও পড়া হয়। ইয়াযদ জামে মসজিদটি নির্মাণের পর থেকে কয়েক শতাব্দী পেরিয়ে গেল। এখনও সেখানে প্রতিদিন আযান হয়। মুসল্লীরা নিয়মিত সেখানে জামাতের সাথে নামাজ আদায় করেন। প্রাত্যহিক নামাজের পাশাপাশি জুমা এবং দুই ঈদের নামাজও এই মসজিদে অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া ইসলামের ধর্মীয় বিশেষ বিশেষ দিবসে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। এ সব আনুষ্ঠানিকতার প্রয়োজনে মসজিদ কেন্দ্রিক আরো কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেমন একটি আধুনিক লাইব্রেরী বা পাঠাগার গড়ে উঠেছে এই মসজিদকে ঘিরে। এই লাইব্রেরীতে আছে মূল্যবান সব বই-পুস্তক এবং পাণ্ডুলিপির সংগ্রহ। ধর্মীয় কিতাবপত্র ছাড়াও এখানে আছে বিখ্যাত মনীষীদের লেখা গুরুত্বপূর্ণ বই পুস্তক। জ্ঞানপিপাসু পাঠক কিংবা মুসল্লীরা এখান থেকে বই নিয়ে পড়েন।

ইয়াযদ জামে মসজিদের প্রবেশদ্বারটি বেশ আকর্ষণীয়। দুপাশে দুটি মিনার। এই মিনার দুটি ইরানের মসজিদের মিনারের মধ্যে সর্বোচচ। দুই মিনারের মাঝখানে আছে চমৎকার একটি গম্বুজ। মসজিদের এই প্রবেশদ্বারের বাইরের দিকটায় নীচ থেকে উপর পর্যন্ত উজ্জ্বল টাইলসের কাজ করা। টাইলসগুলো কিছুটা নীলাভ রঙের। ভেতরের দিকটায় দোকানসজ্জ্বিত খোলা আঙ্গিনা। আঙ্গিনার এক পাশে রয়েছে একটি কক্ষ। পবিত্রতা আর কারুকার্যে কক্ষটি হয়ে উঠেছে অনিন্দ্যসুন্দর। সব মিলিয়ে ইয়াযদ জামে মসজিদটির পুরো কমপ্লেক্স সব ধরণের পর্যটকদের কাছে দর্শনীয় স্থান হিসাবে বিবেচিত হয়ে আসছে।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ২২

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ