নভেম্বর ০১, ২০২০ ১৮:৫২ Asia/Dhaka

আমরা বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানের মাধ্যমে শত্রুসেনাদের হাত থেকে খোররামশাহর মুক্ত করার কথা বর্ণনা করেছি। আজকের আসরে আমরা এই অভিযানের সার্বিক অর্জন এবং এতে বিজয়ের পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতি শত্রুর দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পরিবর্তন আসে সে সম্পর্কে আলোচনা করব।

ইরানি যোদ্ধাদের মাধ্যমে খোররামশাহর পুনরুদ্ধার ছিল প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের তৎকালীন দুই পরাশক্তির সমর্থনপুষ্ট ইরাকের সাদ্দাম সরকারের বিরুদ্ধে ইরানের আট বছরের যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ। আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষকরা খোররামশাহর রক্ষার জন্য ইরাকি বাহিনী যে কঠিন প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করেছিল তা দেখে এটিকে ‘স্তালিনগ্রাদ’-এর সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। কিন্তু এমন কি ঘটনা ঘটল যে, মাত্র ২৪ ঘণ্টার ব্যবধানে সাদ্দামের সেই স্তালিনগ্রাদের পতন হয়ে গেল? অথচ এক সময় এটি ইরানি যোদ্ধাদের কাছ থেকে দখলে নিতে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে ৩৪ দিন যুদ্ধ করতে হয়েছিল।

 

ইরানি যোদ্ধাদের এই বিজয়ের একটি বড় কারণ ছিল অভিনব রণকৌশল। যুদ্ধ শুরুর প্রথম বছরে আগ্রাসী ইরাকি বাহিনী ইরানের বিশাল অঞ্চল দখল করে নিলেও দ্বিতীয় বছরে শুরু হয় সেসব অঞ্চল পুনরুদ্ধারের পালা।  সেনাবাহিনী ও ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর পাশাপাশি গণমানুষের অংশগ্রহণে ইরানের একের পর এক বিজয় অর্জিত হতে থাকে। ফাতহুল মোবিন নামক তৃতীয় অভিযানে সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে যে সাফল্য অর্জিত হয় তাতে ইরানের মোকাবিলায় ইরাকি বাহিনীর দুর্বলতাগুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এদিকে যুদ্ধের ময়দানের এ বিজয়ের পাশাপাশি ইরানের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা ইসলামি বিপ্লব বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর ওপর বড় ধরনের আঘাত হানা হয়। বহিঃশক্তির মদদপুষ্ট এসব গোষ্ঠী অপূরণীয় ক্ষতির শিকার হয়ে চরম দুর্বল হয়ে পড়ে।

সামরিক ও রাজনৈতিক অঙ্গনের এই বিজয় শক্তির ভারসাম্যকে ইরানের অনুকূলে নিয়ে আসে।  এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা ইরানের পরিস্থিতি সম্পর্কে যে বিশ্লেষণ তুলে ধরেন তা হচ্ছে: “ইরান দেশের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সংকট সাফল্যের সঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো অচিরেই এই অঞ্চলের ওপর এই সাফল্যের প্রভাব দেখতে পাবে। ” বিশ্লেষকদের এই হুঁশিয়ারি ছিল মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থ বিপন্ন হয়ে পড়ার সতর্ক সংকেত।  ফলে পশ্চিমা দেশগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষার লক্ষ্যে কুচক্রি পরিকল্পনা আঁটে এবং ইহুদিবাদী ইসরাইল নড়েচড়ে বসে। আসলে এই সময়েই লেবাননের ওপর ইসরাইলি আগ্রাসনের বীজ বপন করা হয়। এদিকে ইরাক যাতে আর ইরানের বিরুদ্ধে কোনো অভিযানে পরাজিত না হয় সে লক্ষ্যে আমেরিকাসহ মধ্যপ্রাচ্যে তার তাবেদার সরকার বাগদাদের প্রতি সামরিক সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বাড়িয়ে দেয়।

এদিকে ফাতহুল মোবিন অভিযানে সাফল্যের ফলে ইরানি যোদ্ধাদের গোয়েন্দা সক্ষমতা শক্তিশালী হয় এবং নতুন নতুন অভিযানের পরিকল্পনা ও তা বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে তেহরান অনেকটা এগিয়ে যায়। সার্বিক পরিস্থিতি ইরানের অনুকূলে চলে আসার কারণেই এদেশের যোদ্ধাদের পক্ষে বায়তুল মুকাদ্দাসের মতো বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করা সম্ভব হয়। এই অভিযানের সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল খোররামশাহরের মতো কৌশলগত একটি বড় শহর পুনরুদ্ধার করা। ইরাকি বাহিনীর দখলে থাকা এলাকাগুলোর মধ্যে এই শহর তেহরানের কাছে ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  সামরিক ও রাজনৈতিক সাফল্য-ব্যর্থতার পাশাপাশি এই অভিযানের জন্য আরো কিছু রণকৌশলগত লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল এবং এগুলোর গুরুত্বও কোনো অংশে কম ছিল না।

 

ইরাকি সেনাদের মতো বহু আন্তর্জাতিক সামরিক বিশ্লেষক ও গণমাধ্যম কর্মী খোররামশাহর মুক্ত করার অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের ক্ষিপ্র গতি ও চৌকস কর্মতৎপরতায় হতবাক হয়ে যায়। তাদের কেউই বিশ্বাস করেনি যে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত ইরাকি বাহিনীর হাত থেকে খোররামশাহরকে মুক্ত করার সামর্থ্য ইরানের রয়েছে। এ কারণে বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযান শুরু করার পর ইরানি যোদ্ধারা বিভিন্ন ফ্রন্টে যখন একের পর এক সাফল্য পাচ্ছিল তখন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে সেসব সাফল্যের খবর ‘অবিশ্বাস্য’ হিসেবে তুলে ধরা হয়। ‘মন্টে কারলো’ রেডিও বলেছিল: ইরাকি বাহিনী খোররামশাহরের প্রতিরক্ষায় এত শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে যে, ইরানি সৈন্যদের পক্ষে এই শহর পুনরুদ্ধার করা অসম্ভব।

বিবিসি রেডিও প্রায় একই রকম বিশ্লেষণ তুলে ধরে জানায়: “ইরানিরা খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করলে সেটা হবে তাদের জন্য চরম পরাজয়ের একটি কারণ। ” ইরান বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযান শুরু করার পর ফিনান্সিয়াল টাইমস এক নিবন্ধে জানায়: “খোররামশাহর হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের চাবিকাঠি। এই শহর হচ্ছে ইরাকের বিজয়ের প্রকৃত নিদর্শন এবং ইরানের প্রাণপণ প্রতিরোধের বহিঃপ্রকাশের স্থল।” আলজেরিয়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক আশ-শাআব অবশ্য ইরানি যোদ্ধাদের একের পর এক সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করে জানায়: এই অভিযান ইরাক সরকারের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে দেবে। জার্মানি থেকে প্রকাশিত দৈনিক ডয়েচে সাইটোনিক খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের পর এক বিশ্লেষণে জানায়: ইরাকি বাহিনীর এ পরাজয়ের ফলে মধ্যপ্রাচ্যের আরব সরকারগুলো ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে এবং এ অবস্থায় এ অঞ্চলে পরাশক্তিগুলোর হস্তক্ষেপের আশঙ্কা বেড়ে গেছে।

খোররামশাহর মুক্ত হওয়ার পর ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রতি আন্তর্জাতিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গে পাল্টে যায়। আমেরিকা ইরানের নব্য প্রতিষ্ঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে উৎখাত করার লক্ষ্যে এই যুদ্ধে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছিল। এর আগে ইসলামি সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে মার্কিন সরকার তার পক্ষে করণীয় সম্ভাব্য সবকিছু করে। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, অভ্যুত্থান সৃষ্টির চেষ্টা, সামরিক হস্তক্ষেপ এবং ইরানের অভ্যন্তরে গোত্রীয় ও বিচ্ছিন্নতাবাদী সংঘাতকে উসকে দেয়া ছিল আমেরিকার কিছু পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। মার্কিন সমর্থনপুষ্ট সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো ইরানের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের হত্যা করে। সন্ত্রাসীদের হামলায় বাদ পড়ে নি ইরানের বেসামরিক নাগরিকও। আমেরিকা মনে করে, নানাভাবে বিপর্যস্ত ইরানে যদি এখন সাদ্দামকে দিয়ে হামলা চালানো যায় তাহলে দুর্বল হয়ে পড়া ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার পক্ষে আর দাঁড়িয়ে থাকা সম্ভব হবে না।

ইরানি যোদ্ধাদের হাতে খোররামশাহরের পতনের ফলে বহিঃশক্তিগুলোর এসব ভ্রান্ত ধারনা দূর হয়ে যায়। সাদ্দাম ইরানে আগ্রাসন চালায় ঠিকই কিন্তু এর ফল হয় আমেরিকার ধারনার বিপরীত। ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থার পতন দূরে থাক এটি আরো শক্তিশালী হয় এবং ইমাম খোমেনীর নেতৃত্বে ইরানি জনগণের মধ্যে ঐক্য ও সংহতি দৃঢ়তা লাভ করে।

খোররামশাহর মুক্ত হওয়ার পর ইরানি জনগণ যে আনন্দ করেছিল তা এদেশের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সেদিন এমন কোনো ইরানি নাগরিক ছিল না যে খোররামশাহরের মুক্তিতে আনন্দ করেনি। মানুষ যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী মিষ্টি, চকলেট, ফুল ইত্যাদি কিনে তা জনগণের মধ্যে বিতরণ করে। জনগণের এই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ প্রমাণ করে ইরানের ইসলামি শাসনব্যবস্থা জনগণের কতটা মন জয় করতে এবং তাদের মধ্যে কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিল।

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।