নভেম্বর ১৭, ২০২০ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের ঐতিহাসিক প্রদেশ ইয়াযদের দিকে গিয়েছিলাম। ইয়াযদের স্থানীয় কুলার সিস্টেম এবং খাবার পানির ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করেছি।

ইয়াযদের প্রাচীন পদ্ধতি কুলারের আধুনিক প্রক্রিয়া থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন। ইয়াযদে খাবার পানির ব্যবস্থাও একটু ভিন্ন ধরণের। যেহেতু মরুভূমি অঞ্চল, সেহেতু খাবার পনির সঙ্কট থাকাটাই স্বাভাবিক। এই সঙ্কট নিরসনের জন্য মাটির নীচের প্রাকৃতিক পানিই একমাত্র উপায় হিসাবে গৃহীত হয়েছে।

ইয়াযদ প্রদেশের হস্তশিল্প ও তাঁত শিল্পের সঙ্গেও আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। গত আসরে বলেছিলাম যে ইয়াযদ প্রদেশে জরথ্রুস্টদের একটি বিশাল গ্রুপ বসবাস করে। এ কারণে এই শহরের বেশ কিছু স্থাপনা ও নিদর্শনের সঙ্গে জরথ্রুস্টদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। ইয়াযদের ঐতিহাসিক অতাশকাদেহ বা অগ্নিমন্দির সেরকমই একটি নিদর্শন। শহরের বাইরেও জরথ্রুস্ট ধর্মাবলম্বিদের গোরস্তানের অস্তিত্ব লক্ষ্য করা যায় যা ভ্রমণকারীদের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় একটি স্থাপনা। আজ আমরা আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেবো ইয়াযদ প্রদেশের মেইবোদ শহরের ঐতিহাসিক কেল্লা নারিন-এর সঙ্গে।

ইয়াযদের ঐতিহাসিক মেইবোদ শহরের আকর্ষণীয় একটি নিদর্শন হলো নারিন কেল্লা বা কোহানদেজ। ফার্সিতে কোহান মানে হলো প্রাচীন আর দেজ মানে কেল্লা। ইয়াযদের কেন্দ্রিয় শহর থেকে এই কেল্লাটির দূরত্ব পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটারের মতো। মূল শহর থেকে উত্তর পশ্চিম দিকে গেলেই পড়বে এই মেইবোদ এলাকাটি। এলাকার নামেই শহরের নাম মেইবোদ। শুনলে আশ্চর্য হবারই কথা যে এই শহরটির বয়স সাত হাজার বছরেরও বেশি। রূপকথার মতো শোনাতে পারে বিষয়টা। আসলেই তাই। রূপকথার সঙ্গে কিছুটা গাঁটছড়া আছে এই শহরের। তাই ইরানের রূপকথার ইতিহাসের সঙ্গে এই শহরের ইতিহাস প্রাসঙ্গিক অনেকটাই। রূপকথার ওপর ভিত্তি করে কিউমার্সের সময় এই শহরটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

সাত হাজার বছর আগেকার এই মেইবোদ শহর ইরানের সুপ্রাচীন শহরগুলোর অন্যতম হিসেবে পরিগণিত। তারচেয়েও অবাক করা ব্যাপার হলো এখনও এই শহরের সেই প্রাচীনকালের অনেক নিদর্শনের অস্তিত্বের সঙ্গে পরিচিত হবার সুযোগ আছে। এখানে এখনও আছে প্রাচীন রাস্তা। রয়েছে বহু প্রাচীন ভবন এবং এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আরও অনেক নিদর্শন। এইসব নিদর্শনকে ছাপিয়ে গেছে যে নিদর্শন বা স্থাপনা তা হলো মেইবোদের ঐতিহাসিক কেল্লা নারিন। ইতিহাসের বিচিত্র তথ্যপঞ্জি থেকে জানা যায় এই কেল্লা নির্মাণের মধ্য দিয়েই শুরু হয়েছিল ইয়াযদ শহরের নির্মাণকাজ। এদিক থেকে বিচার করলে মেইবোদ শহরকে ঐতিহাসিক কারণেও গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা করা যেতে পারে।

এই নারিন কেল্লাটি আগেকার দিনের মানুষদের কাছে একটু ভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। তারা এই কেল্লাকে বলতো 'দেজদালান'। মেইবোদ শহরের একটি টিলার ওপর এই কেল্লাটি নির্মাণ করা হয়েছে। তিন হেক্টর জায়গার ওপরে গড়ে তোলা হয়েছে ঐতিহাসিক এই দূর্গ-নারিন দূর্গ। মজার ব্যাপার হলো এতো গুরুত্বপূর্ণ এবং বিখ্যাত কেল্লাটি নির্মাণ করা হয়েছে মাটি দিয়ে। ইতিহাসের বিভিন্ন কালপর্বে এই কেল্লাটিকে সামরিক দূর্গ হিসেবেও ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কখনও কখনও প্রশাসনিক কাজেও ব্যবহার করা হয়েছে কেল্লাটিকে। ইসলাম-পূর্বকালে এই কেল্লাটি সবচেয়ে বেশি মর্যাদার আসনে এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে গৃহীত হয়েছিল সাসানিদের শাসনামলে এবং তাদের পর আলে মোজাফফরদের শাসনামলে।

কেল্লার মূল অংশটি এবং বলা যেতে পারে সবচেয়ে প্রাচীন অংশটি কমপ্লেক্সের একেবারে উপরে অবস্থিত। ঐতিহাসিক তথ্যপঞ্জি থেকে জানা যায় কেল্লাটিকে বেশ কয়েকবার মেরামত করা হয়েছিল। তার মানে মনে করা যেতেই পারে যে নীচের অংশগুলো পরবর্তীকালে অর্থাৎ নয়া যুগে নির্মাণ করা হয়েছে। দূর্গটির মাঝখানের উঠোনে ইটের তৈরি নিদর্শনের অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া গেছে। আরও যেসব দেখা সম্ভব হয়েছে তা হলো এই কেল্লাটির ভেতরে বহু কক্ষ থৈরি করা হয়েছিল। এখনও সেইসব ছোট ছোট কামরার অস্তিত্ব দেখতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন কারণে অনাবিষ্কৃতও রয়ে গেছে বহু কিছু। কেল্লার নীচে দিয়ে বয়ে যাওয়া বহু ক্যানেলও রয়েছে। এগুলোকে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করার কাজটা বেশ জটিল বলে সতর্কতার সঙ্গে এগুচ্ছে প্রত্নতত্তবিদরা।  

বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের স্থাপত্যবিদদের অনেকেই মনে করেন ঐতিহাসিক এই বিশাল স্থাপনাটি পুরোণো একটি দূর্গ এবং এটি রোদে পোড়া ইটের তৈরি একটি স্থাপনা। সুতরাং বয়স বিচারে প্রাচীন ইরানেরই একটি স্থাপনার নিদর্শন এটি। তাছাড়া এই স্থাপনাটি নির্মাণ করার ক্ষেত্রে যে স্টাইল বা পদ্ধতির ব্যবহার করা হয়েছে সেই পদ্ধতিতে আজও ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। কেল্লাটির নির্মাণশৈলী যথেষ্ট জটিল এবং অনন্য সাধারণ। এতো জটিল যে শত্রুপক্ষ কোনোভাবেই এর ভেতরে ঢুকতে পারার কথা নয়। ঐতিহাসিক এই কেল্লাটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে এখন থেকে পঁয়তাল্লিশ বছর আগে।

ইয়াযদে এতো বেশি ঐতিহাসিক স্থাপনা ও নিদর্শন রয়েছে যে জাঁকজমকপূর্ণ এইসব স্থাপনা পর্যটকদের স্মৃতিতে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছে। বিদেশী পর্যটকরা যারা ইয়াযদ প্রদেশে বেড়াতে এসেছেন তাঁরা তাঁদের স্মৃতিকথায় এই শহরটিকে দর্শনীয় গন্তব্য হিসেবে উল্লেখ করেছেন এবং ইরান ভ্রমণে এসে ইয়াজদ ভ্রমণ না করাটা পুরো সফরটাই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বলে উল্লেখ করেছেন।#

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ