প্রাচ্যবিদদের চোখে মহানবী (সা) পর্ব-২৮
আজ আমরা পবিত্র ইসলাম ধর্ম ও মহানবী (সা) সম্পর্কে আরও একজন পশ্চিমা প্রাচ্যবিদের বক্তব্য ও মন্তব্য শুনব।
পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা প্রাচ্য, ইসলাম ও মহানবী (সা) নিয়ে যুগে যুগে গবেষণা করেছেন উপনিবেশবাদের বিস্তারসহ প্রচারণাগত, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা উদ্দেশ্য ও স্বার্থকে সামনে রেখে। যেমন, খ্রিস্টিয় অষ্টম বা দশম শতকে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের বেশিরভাগই ছিলেন খ্রিস্ট ধর্মের পুরোহিত। ক্রুসেডিয় পরিবেশে ইসলাম-বিদ্বেষ ছিল তাদের মধ্যে মজ্জাগত। তাই তাদের অনেকেই মহানবীর জীবন ও ইসলাম সম্পর্কে হাতে লেখা প্রাচীন বইগুলো পড়তে গিয়ে ইতিবাচক বা প্রশংসাসূচক কোনো বক্তব্য দেখলে ক্রোধে উন্মাদ হয়ে সেইসব বই পুড়িয়ে ফেলতেন! মধ্যযুগে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের কেউ কেউ ইসলাম ও মহানবীর (সা) প্রশংসা করে লেখালেখি করেছেন। তবে তাদের বেশিরভাগই তা লিখেছেন গোপনে। আরও পরে পাশ্চাত্যে বুদ্ধিবৃত্তি ও যুক্তির ওপর প্রাধান্য দেয়ার যুগ শুরু হলে পশ্চিমা অনেক মনীষী (সা) ইসলামের শ্রেষ্ঠত্ব ও মহানবীর শ্রেষ্ঠত্বকে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়েছেন। তবে বস্তুবাদী দৃষ্টিকোন থেকে ইসলাম ও মহানবীকে বিশ্লেষণ থেমে যায়নি পাশ্চাত্যে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি শতকে থেকে পশ্চিমা প্রাচ্যবিদদের মধ্যে প্রচলিত ইসলাম ও মহানবী (সা) সম্পর্কিত গবেষণায় আরও ব্যাপক পরিবর্তন দেখা গেছে ।
২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের রহস্যময় ঘটনার পর মহানবীর (সা) জীবনী শীর্ষক একটি বই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বছরের সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বই হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে। এ বইয়ের লেখিকা কারেন আর্মস্ট্রং ছিলেন গির্জার কর্মী। মাত্র ১৭ বছর বয়সে গির্জায় যোগ দিয়েছিলেন এই ব্রিটিশ নাগরিক। কিন্তু গির্জায় মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি ২৪ বছর বয়সে গির্জা ত্যাগ করেন। এরপর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য বিষয়ে পড়াশুনা করেন। এই পড়াশুনার পাশাপাশি ধর্ম ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা করে কারেন আর্মস্ট্রং অনেক বই লিখেছেন। স্রস্টার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস শীর্ষক তার লেখা বিখ্যাত বইটি ত্রিশটিরও বেশি ভাষায় হয়েছে অনূদিত। ‘সরু বা চিকন গলির পথিকদের মধ্য থেকে’ শীর্ষক তার জীবনী সংক্রান্ত বইটিও বেশ বিখ্যাত। মহানবীর (সা) জীবনী শীর্ষক কারেন-এর বইটি ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার এক মাস পর প্রকাশ হয়। বইটি লেখা তিনি প্রথমবার শেষ করেন ১৯৯১ সনে। এরপর ২০০৬ সালে আবারও একই বিষয়ে তার বই বের হয়। অবশ্য এবার বইয়ের শিরোনাম ছিল ‘আমাদের যুগের জন্য একজন নবী’।
মহানবীর জীবনী সংক্রান্ত কারেন-এর বইটির ভূমিকায় তিনি আফসোস করে বলেছেন, ‘পাশ্চাত্যের জনগণের কাছে মুহাম্মাদ (সা) বলতে যে ছবি ভেসে ওঠে তা হচ্ছে সালমান রুশদির আঁকা ছবি অথবা এমন এক ছবি যা ক্রুসেডের যুদ্ধের যুগ থেকে খ্রিস্টানদের মধ্যে রয়ে গেছে। ১১ সেপ্টেম্বরে (রহস্যময় বিস্ফোরণে নিউইয়র্কে অবস্থিত বিশ্ব বাণিজ্য কেন্দ্রের অফিস তথা) টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনার পর বিশ্বের দৃষ্টি আবারও ইসলাম ও মুসলমানদের ওপর নিবদ্ধ হয়। পশ্চিমাদের ধারণা এই বিস্ফোরণের ঘটনা ইসলামের উগ্রতাকেই তুলে ধরছে এবং এ ঘটনা প্রমাণ করছে যে ইসলাম ধর্ম সন্ত্রাস, হত্যাযজ্ঞ ও ত্রাস সৃষ্টির বা নৃশংসতার ধর্ম।!কিন্তু বাস্তবতা বা সত্য এমন নয়।
কারেন আর্মস্ট্রং যুক্তি দেখান যে পশ্চিমারা এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এড়িয়ে যান যে অন্য ধর্মগ্রন্থগুলোতেও সহিংসতার নির্দেশনা সংক্রান্ত বাক্য রয়েছে। ইহুদিদের ধর্মগ্রন্থ তাওরাতে অন্য জাতিগুলোর ধর্মীয় স্থাপনা ধ্বংস করার, তাদেরকে পবিত্র ভূমি থেকে তাড়িয়ে দেয়ার ও তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তি স্বাক্ষর না করার নির্দেশ বার বার এসেছে! উগ্র ইহুদিরা ফিলিস্তিনিদেরকে ফিলিস্তিনি জাতির স্বদেশভূমি থেকে বিতাড়নের কাজে এইসব বাক্যকেই ব্যবহার করেছে। খ্রিস্ট ধর্ম সম্পর্কেও একই ধারণা পোষণ করেন আর্মস্ট্রং।
কারেন আর্মস্ট্রং মনে করেন যে প্রায় সবাইই এটা জানে যে ধর্মগ্রন্থের এ জাতীয় বাক্যের ব্যবহার ও সেসবকে এমন ধরনের অর্থে ব্যবহার করা অনৈতিক। হযরত ঈসা নবী (আ) বা যিশু খ্রিস্টকে প্রায় সব সময়ই শান্তিকামী হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু বাইবেলে এমন কিছু বাক্য রয়েছে যেসবে আক্রমণ করার ও যুদ্ধের ব্যাপারে উৎসাহ দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেউই সার্বিয়ার খ্রিস্টানদের হাতে বসনিয়ার ৮ হাজার মুসলমান নিহত হওয়ার বিষয়টিকে বাইবেলের এইসব বাক্যের সঙ্গে সম্পর্কিত করেননি! তাই কারেন আর্মস্ট্রংয়ের দৃষ্টিতে একদল উগ্র মুসলমানের কাজকে ইসলামের নবীর নীতির সঙ্গে জড়ানোটা ও এ ধর্মকে সন্ত্রাস, যুদ্ধ ও ত্রাসের ধর্ম বলাটা ন্যায়বিচার নয়। একইসঙ্গে কারেন ১১ সেপ্টেম্বরের বিপর্যয়ের ঘটকদের দাবির বিষয়ে গভীর দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি বলেছেন যে এই ঘটনাকে ইসলামের সঙ্গে জড়ানোটা অজ্ঞতা এবং মুর্খতা মাত্র।
কারেন আর্মস্ট্রং-এর মতে স্রস্টার বিষয়ে একত্ববাদী ধর্মগুলো, নবী-রাসুল ও প্রজ্ঞার অধিকারী ব্যক্তিদের দৃষ্টিভঙ্গী খুবই কাছাকাছি এবং তা হল স্রস্টা এক উচ্চতর অস্তিত্ব ও তিনিই চূড়ান্ত বাস্তবতা। তিনি লিখেছেন: আমি নিজের জন্য এটা জরুরি মনে করেছি যে পশ্চিমা পাঠকদের কাছে এমন এক ব্যক্তি সম্পর্কে স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গী তুলে ধরব যিনি একজন নবীও ছিলেন এবং যিনি মানবজাতির ইতিহাসের গতিপথকে বদলে দিয়েছেন ও আজও যিনি মানব সমাজের এক বিশাল অংশকে প্রেরণা দিয়ে থাকেন। এই ব্যক্তি সম্পর্কে পশ্চিমাদের কাছে সব সময়ই সত্যকে গোপন রাখা হয়েছে এবং এ সম্পর্কে কেবল সামান্য কিছু আলোকচ্ছটা- তাও আবার অস্পষ্টতা ও হাল্কা চালের সাধারণ কথাবার্তার মিশ্রণই তুলে ধরা হয়েছে পশ্চিমাদের কাছে!
আর্মস্ট্রং-এর মতে মুহাম্মাদ (সা) কেবল মুসলমানদের জন্যই নানা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষার আদর্শ নন, একইসঙ্গে তিনি পশ্চিমাদের জন্যও আদর্শ। তিনি ছিলেন যুদ্ধ ও বিবাদে অতিষ্ট হয়ে পড়া আরব ভূখণ্ডে ঠিক যেন শান্তির এক সুশীতল সমীরণ বা হাওয়ার মত। আর বর্তমানে আমাদের এমনই একজন নেতা দরকার যিনি এমন শান্তির ভূমিকা রাখার জন্যই প্রস্তুত। লোভ-লালসা, অবিচার ও আধিপত্যকামিতা বা দাম্ভিকতার বিরুদ্ধে তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন অক্লান্তভাবে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে আরব উপদ্বীপ এক চরম ক্রান্তিলগ্নে পৌঁছে গেছে এবং প্রচলিত চিন্তায় আর কাজ হবে না... মুহাম্মাদ জনগণের ওপর নিজের ধর্ম চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেননি, বরং তিনি জনগণের মনমানসিকতা ও চরিত্র বদলে দেয়ার আশা করতেন।#
পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ১৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।