নভেম্বর ১৯, ২০২০ ১৭:৩০ Asia/Dhaka

ইয়াযদের ঐতিহাসিক মেইবোদ শহরের আকর্ষণীয় একটি নিদর্শন হলো নারিন কেল্লা বা কোহানদেজ। ফার্সিতে কোহান মানে হলো প্রাচীন আর দেজ মানে কেল্লা।

ইয়াযদের কেন্দ্রিয় শহর থেকে এই কেল্লাটির দূরত্ব পঁয়তাল্লিশ কিলোমিটারের মতো। মূল শহর থেকে উত্তর পশ্চিম দিকে গেলেই পড়বে এই মেইবোদ এলাকাটি। এলাকার নামেই শহরের নাম মেইবোদ। শুনলে আশ্চর্য হবারই কথা যে এই শহরটির বয়স সাত হাজার বছরেরও বেশি। রূপকথার মতো শোনাতে পারে বিষয়টা। আসলেই তাই। রূপকথার সঙ্গে কিছুটা গাঁটছড়া আছে এই শহরের। তাই ইরানের রূপকথার ইতিহাসের সঙ্গে এই শহরের ইতিহাস প্রাসঙ্গিক অনেকটাই। রূপকথার ওপর ভিত্তি করে কিউমার্সের সময় এই শহরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। যাই হোক আজকের আসরে আমরা আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো ইয়াযদ প্রদেশের অন্যতম হস্তশিল্প যিলু'সহ আরও কিছু হস্তশিল্পের সঙ্গে। যিলু-নামটা একটু ব্যতিক্রমধর্মী। চলুন এই ব্যতিক্রমের সঙ্গেই গাঁটছড়া বাঁধা যাক সবার আগে।

মেইবোদ শহরের অলিগলি কিংবা রাস্তাঘাট ধরে হাঁটাহাটি করলে বুঝতে পারা যাবে যে এখানে যিলু তৈরি, মৃৎপাত্র তৈরি এবং সিরামিক তৈরির প্রচলন মোটামুটি বলা চলে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী। মেইবোদের বহু মানুষ এই পেশার সঙ্গে জড়িত। আপনারা জেনে অবাক হবেন যে এই মেইবোদ শহর বিশ্ব যিলু তৈরির শহরের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে অনেক আগেই। বিশ্ব হস্তশিল্প পরিষদের পক্ষ থেকে দেওয়া এই সম্মান ও মর্যাদা এই শহরটির সৌন্দর্য ও গুরুত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। যিলু বুণনের কাজ প্রমাণ করে উষ্ণ এই মরু অঞ্চলের গ্রামীণ জনগোষ্ঠি খুব সাদাসিধে জীবনযাপন করে। আর ওই সাদামাটা জীবন পদ্ধতিই যেন এই প্রান্তিক জনগণের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

আমাদের এতো সময়ের আলোচনা থেকে নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন যে যিলু এক ধরনের হাতে বোণা হস্তশিল্প। এটা দেখতে অনেকটা সতরঞ্জি বা মাদুর টাইপের বস্তু। ইরানের বহু অঞ্চলে এই যিলু বোণা হয় তবে মেইবোদের যিলুর ব্যাপারই আলাদা। রঙে কিংবা বুণনের দিক থেকে তো বটেই ডিজাইনের দিক থেকেও রয়েছে মেইবোদের যিলুর অনন্য বৈশিষ্ট্য। মেইবোদের যিলুর ডিজাইন কিন্তু জটিল নয় একেবারেই সাদামাটা। যেন এ অঞ্চলের সহজ সরল মানুষের সাদাসিধে জীবন মানের সঙ্গে যিলুর ডিজাইনের কোথাও যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বলা বাহুল্য এই সাদাসিধে ব্যাপারটাই মেইবোদের যিলুকে স্বাতন্ত্র্য এনে দিয়েছে। সেজন্যই লক্ষ্য করা যাবে মসজিদসহ অন্যান্য ধর্মীয় স্থাপনাগুলোতে এই মেইবোদের যিলুর ব্যাপক ব্যবহার রয়েছে। সতরঞ্জি হিসেবেও ব্যবহৃত হয় মেইবোদের হাতে বোণা যিলু।

যিলু প্রাচীনকাল থেকেই মেইবোদের অধিবাসীরা ব্যবহার করে এসেছে। এর একটা কারণ ছিল এরকম যে যিলু ওই এলাকার জনগণের নিজেদের হাতে তৈরি জিনিস। অপরদিকে যিলু মেইবোদ এলাকার পরিবেশ বান্ধব একটি বস্তু। যিলু ঠিক কার্পেট নয় তবে কার্পেটেরই কাজ করে বলে এটাকে 'ফার্শে সালামত' নামেও অভিহিত করা হয়। 'ফার্শে সালামত' এর মানে হলো স্বাস্থ্য সম্মত কার্পেট। এই যিলু বুণনের মূল উপাদান হলো তুলা। আর তুলা হলো সবচেয়ে নিরাপদ একটি উপাদান যা ব্যবহারে বুণন শিল্পী এবং ব্যবহারকারী উভয়েরই সুস্থতা নিশ্চিত হয়, অন্তত কোনোরকম রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত হবার আশঙ্কা থাকে না। এখানে কিন্তু যিলু প্রদর্শনী ও সংরক্ষণের জন্য একটি মিউজিয়াম বা যাদুঘর গড়ে তোলা হয়েছে। যাদুঘরটির নাম হলো মেইবোদ 'যিলু ও প্লাস' যাদুঘর। এই যাদুঘরটির ঘুরেফিরে দেখলে যিলু সম্পর্কে সুস্পষ্ট একটা ধারণা পাওয়া যাবে। সমগ্র ইরানের মধ্যে একমাত্র যিলু যাদুঘর এটি।

মেইবোদের ঐতিহাসিক সরাইখানার সাংস্কৃতিক বিভাগটি সরাইখানার পূর্বদিকের স্যালুনে অবস্থিত। ওই স্যালুনের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রেই গড়ে উঠেছে মেইবোদ যিলু ও প্লাস মিউজিয়াম। ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকায় বহু আগেই স্থান করে নিয়েছে এই যাদুঘরটি। বছর বিশেক আগে মেইবোদ যিলু ও প্লাস মিউজিয়ামটি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংস্থার কাঠামোর আলোকে পরিচিতি ও প্রশিক্ষণ বিভাগের আওতাধীন একটি বিশেষ যাদুঘর হিসেবে উদ্বোধন করা হয়েছে। বলাবাহুল্য এই সুপরিকল্পিত এই যাদুঘর তৈরি করার ফলে ইরানিদের মাঝে তো বটেই এমনকি বিশ্ববাসীর কাছেও যিলু হস্তশিল্পটি পরিচিতি লাভ করে।

যিলু মিউজিয়াম নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। এই স্থাপনাটি গড়ে ওঠার ফলে মেইবোদের শিল্পীদের সমবেত হবার মতো একটু চমৎকার মিলনকেন্দ্রের চাহিদা পূরণ হয়ে গেল। সব ধরনের শিল্পীরাই মোটামুটি এখানে এসে জড়ো হতে শুরু করলো। আর শিল্পীদের জন্য এখানে প্রদর্শিত হতে লাগলো বিচিত্র আঙ্গিকের যিলু। সেই নবম হিজরি থেকে আজ পর্যন্ত এই ধারা অব্যাহত রয়েছে নীল, সাদা, সবুজ এবং লাল যিলুর আলাদা আলাদা গ্যালারিতে। এই বিশেষ যাদুঘরে সংরক্ষিত যিলুগুলোকে প্রধান দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। একটি প্রাচীন বিভাগ অপরটি নতুন বিভাগ। প্রাচীন যিলুর সংখ্যাও নেহায়েৎ কম নয়-অন্তত পঞ্চাশটি তো হবেই। এই প্রাচীন যিলুর মধ্যে একটি যিলুর বুণনকাল হলো আট শ আট হিজরি। আলি বিদ ইবনে হাজি মেইবোদির ডিজাইনে নীল, সাদা ও লাল রঙের সমন্বয়ে ওই যিলুটি বুনেছেন। ডিজাইন ও বুণনের দিক থেকে অপরাপর যিলু থেকে এটি একেবারেই আলাদা রকমের।

মেইবোদের সবচেয়ে সুন্দর এবং চিত্তাকর্ষক যিলুটি দ্বাদশ হিজরিতে বোণা হয়েছে। ওই যিলুটির ডিজাইন এমনভাবে করা হয়েছে যে এর ওপর চব্বিশ জন মুসল্লি নামাজ পড়তে পারবে। এই যিলুটির প্রান্তে ওয়াকফকারীর নাম এবং তারিখও বোণা হয়েছে। তারিখ লেখা হয়েছে এক হাজার এক শ আঠারো হিজরি। যিলু বোণার কারখানা এই মিউজিয়ামটির অন্যতম আকর্ষণ। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ