ডিসেম্বর ০৩, ২০২০ ১৭:৪৭ Asia/Dhaka

গত কয়েক আসরে আমরা ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় খোররামশাহর পুনরুদ্ধার পরবর্তী ঘটনাবলী নিয়ে কথা বলেছি। খোররামশাহর পুনরুদ্ধারের পর ধরে নেয়া হয়েছিল, ইরানের এই বিশাল বিজয় এবং আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর পরাজয়ের মধ্যদিয়ে এবার যুদ্ধের অবসান হবে।

ইরান কখনোই অন্য কোনো দেশে আগ্রাসন চালানোর নীতিতে বিশ্বাসী ছিল না এবং আট বছরের ইরাক-ইরান যুদ্ধে তেহরান সব সময় আগ্রাসন প্রতিহত ও দখলীকৃত এলাকা মুক্ত করার কাজে ব্যস্ত ছিল। যে দেশটিতে সবেমাত্র একটি বিপ্লব হয়েছে এবং আড়াই হাজার বছরের রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে একটি নয়া প্রশাসন গঠিত হয়েছে সে দেশটি নিজের প্রশাসন ঢেলে সাজানোর কাজ বাদ দিয়ে প্রতিবেশী দেশের ওপর আগ্রাসন চালাবে- এমনটি সুস্থ বিবেকবান কোনো মানুষ কল্পনা করতে পারে না।

কিন্তু ইসলামি বিপ্লবের শত্রুরা বিশেষ করে আমেরিকা ইরানের নবগঠিত ইসলামি শাসনব্যবস্থাকে তার প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরে। ইরানি যোদ্ধারা খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করার পর আমেরিকার উদ্যোগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৫১৪ নম্বর প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। ওই প্রস্তাবে ইরান-ইরাক যুদ্ধকে বিশ্বশান্তির জন্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরে এমন একটি ভাব সৃষ্টি করা হয় যেন, ইরানই এ যুদ্ধ শুরু করেছে এবং তাকেই এটি বন্ধ করতে হবে। ইরাকের তৎকালীন শাসক সাদ্দাম ইরানের ওপর আগ্রাসন চালানোর মাধ্যমেই যে এ যুদ্ধ শুরু করেছিল সে সম্পর্কে কোনো ইঙ্গিত ওই প্রস্তাবে ছিল না। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে একটি টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী হলেও ৫১৪ নম্বর প্রস্তাবে শান্তি প্রতিষ্ঠার উপায় সম্পর্কে কোনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা ছিল না। এতে ইরানকে হাজার হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়ার কোনো কথা বলা হয়নি বরং শুধুমাত্র যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার ওপর জোর দেয়া হচ্ছিল।

এ কারণে ইরান আত্মরক্ষার স্বার্থে ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান এবং আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে শাস্তি দেয়ার অর্থাৎ দেশটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। অন্যদিকে ইরানের শত্রুরা সাদ্দামকে সব ধরনের সহযোগিতা চালিয়ে যায়। ইরান খোররামশাহর পুনরুদ্ধার করার আগ পর্যন্ত আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর যুদ্ধ করার তীব্র মনোবল ছিল যা পরবর্তীতে ভেঙে যায়। যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে ইরাকি বাহিনী হতাশ হয়ে পড়ে। তবে এবার সাদ্দাম বাহিনী যুদ্ধের কৌশল পরিবর্তন করে। ইরানি যোদ্ধারা ইরাকে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা চালালে ইরাকিরা ইরানের অর্থনৈতিক কেন্দ্র ও তেল স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। বিদেশি মদদে ইরাক সরকার তার প্রতিরক্ষা বাহিনীকে ঢেলে সাজায় এবং সামরিক শক্তি জোরদার করে। সাদ্দাম প্রশাসন ইরাকের সবগুলো মন্ত্রণালয় ও সরকারি  সংস্থাকে যুদ্ধের কাজে আত্মনিয়োগের নির্দেশ দেয়। প্রত্যেক ইরাকি মন্ত্রণালয়কে তার সামর্থ্য অনুযায়ী যুদ্ধের কাজে অংশ নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। উদাহরণস্বরূপ, ইরাকের কৃষি মন্ত্রণালয় ছোট ছোট খাল খনন করে ইরানি যোদ্ধাদের অগ্রাভিযানের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার দায়িত্ব পায়।

ইরাকি বাহিনী যখন ইরানি যোদ্ধাদের অগ্রাভিযান প্রতিহত করার লক্ষ্যে সমর সজ্জায় ব্যস্ত ছিল তখন আমেরিকা ও তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন তাদের গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে বাগদাদকে সহযোগিতা করে।  ইরানি যোদ্ধাদের সম্ভাব্য অগ্রাভিযান প্রতিহত করার লক্ষ্যে ইরাকিরা সেদেশের বসরা নগরীর পূর্বদিকে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়ে দেয়। ইরানি যোদ্ধারা ইরাকের ভেতর ঢুকে পড়লে তাদেরকে ছত্রভঙ্গ করে বিভিন্ন ছোট ছোট দলে বিভক্ত করে ফেলার পরিকল্পনা করা হয়।  ইরাকি সেনারা বসরা অঞ্চলে প্রবেশের পথে হাজার হাজার মাইন বসিয়ে নিজেদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করে।  ইরাকের কৃষ্টি মন্ত্রণালয় যেসব কৃত্রিম খাল খনন করে সেগুলো ইরাকি বাহিনীর সবচেয়ে বেশি কাজে লাগে। ইরানি যোদ্ধাদের পক্ষে ওই কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতে বেশে বেগ পেতে হয়।     

বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানে পরাজিত হয়ে ইরাকি বাহিনী উপলব্ধি করে তাকে নিজের সেনাবাহিনীর আকার ও গুণগত মানে পরিবর্তন আনতে হবে। এ কারণে সাদ্দাম সরকার ‘জেইশ আশ-শাবি’ নামের একটি গণবাহিনী গঠন করে এবং এই বাহিনীর সদস্যদেরকে সীমান্তের ফ্রন্টে পাঠিয়ে দেয়। পাশাপাশি নিজের সেনাবাহিনীর প্রশিক্ষিত সৈন্যদেরকে ফ্রন্ট থেকে অনেক দূরে সরিয়ে রাখে। ইরানি যোদ্ধারা যদি গণবাহিনীর বাধা অতিক্রম করে ইরাকের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়তে পারে তাহলে তাদেরকে প্রতিহত করার জন্য এভাবে মূল সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত রাখা হয়।

এদিকে বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযানে ইরাকি বাহিনীকে পরাজিত করে দেশের প্রায় সব এলাকা পুনরুদ্ধার করার পর ইরানি যোদ্ধাদের মনোবল তখন তুঙ্গে। তাদের শীর্ষস্থানীয় কমান্ডাররা ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালানোর যে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তা বাস্তবায়ন করতে তারা পূর্ণ প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।

ইরাকের অভ্যন্তরে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই দেশটির দক্ষিণাঞ্চলীয় বসরা নগরী প্রাধান্য পায়। যদিও ইরাকি বাহিনীকে পুরোপুরি বিধ্বস্ত করে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটানোর জন্য রাজধানী বাগদাদ দখল করার কথাও ভাবা হয়। কিন্তু বাগদাদ ছিল ইরানি সেনাবাহিনীর সামরিক শক্তির নাগালের বাইরে। শহরটি ইরানের সীমান্ত থেকে তুলনামূলক দূরে অবস্থিত। এ ছাড়া, ইরানকে পদাতিক বাহিনীর ওপর বেশি নির্ভর করতে হচ্ছিল বলে এত বড় ও বিপজ্জনক অভিযানে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত ছিল না। কাজেই ইরান সীমান্তের নিকটবর্তী বসরা নগরীকে লক্ষ্যবস্তু হিসেবে নির্ধারণ করা হয়।

অবশেষে বায়তুল মুকাদ্দাস অভিযান শেষ হওয়ার ৩৮ দিন পর ইরান ইরাকের বসরা অভিমুখে ‘রমজান’ নামক অভিযান শুরু করে। কিন্তু দুঃখজনকভাবে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী এই অভিযান তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয় এবং ইরানি যোদ্ধারা ভয়াবহ পরাজয়ের সম্মুখীন হয়ে পিছু হটতে বাধ্য হন।

এই পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল, ইরানি যোদ্ধারা এতদিন তাদের দেশের মাটিতে ইরাকি সেনাদের যে ধরনের সমরসজ্জা ও রণকৌশল দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন তার সঙ্গে ইরাকিদের এবারের রণকৌশলের আকাশ-পাতাল পার্থক্য ছিল। ইরানের পদাতিক বাহিনী এবার ইরাকি বাহিনীর মুহূর্মুহূ গোলাবর্ষণ ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মুখে পড়ে। ইরানি যোদ্ধারা বারবার তাদের অবস্থান ও রণকৌশল পরিবর্তন করেও ইরাকি সেনাদের হামলা থেকে বাঁচতে পারেননি।

প্রকৃতপক্ষে ইরাকি সেনাবাহিনীর এবারের রণকৌশল তাদের নিজস্ব চিন্তার ফসল ছিল না বরং তৎকালীন বিশ্বের দুই পরাশক্তি আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন এই রণকৌশল ঠিক করে দিয়েছিল। সেইসঙ্গে তারা সব ধরনের গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সাদ্দাম বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল। ইরানের কত যোদ্ধা, কি পরিমাণ সমরাস্ত্র নিয়ে কোন পথে অগ্রসর হচ্ছে তার সব তথ্য আগাম চলে যাচ্ছিল বাগদাদের কাছে। রমজান অভিযানে ইরানি যোদ্ধাদের ব্যর্থতার ফলে তেহরান যুদ্ধ বন্ধের যে দুটি প্রধান দাবি জানিয়েছিল তা মেনে না নিতে সাদ্দামের আন্তর্জাতিক সহযোগীরা দৃঢ়সংকল্প হয়।  ইরানের ওই দুই প্রধান দাবি ছিল সাদ্দামকে আগ্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা এবং বাগদাদের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ০৩

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।