ডিসেম্বর ০৫, ২০২০ ১৭:০২ Asia/Dhaka

গত আসরে আমরা ইরানের ঐতিহাসিক প্রদেশ কেরমান সফর করেছি। আশা করি আপনাদের মন্দ লাগে নি। আগেই বলেছি ইরান একটি রূপবৈচিত্রময় প্রকৃতির দেশ। এর একেকটি প্রদেশ একেক রকম বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত।

যুগে যুগে এদেশে বিভিন্ন রাজা-বাদশা শাসন করেছেন। তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হয়ে আছে ইরানের মাটি। তাদের সেইসব কীর্তি আর প্রকৃতির স্বাভাবিক দান এখন ইরানের গর্ব।

গত পর্বে আমরা কেরমানের তামা শিল্পের বিচিত্র দিক নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। শেষদিকে কেরমানের আরেকটি প্রসিদ্ধ ও দর্শনীয় স্থানের কথা বলেছিলাম। এই স্থানটি হলো  বাম নগরী। আপনারা জানেন নিশ্চয়ই যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মানে ভয়াবহ ভূমিকম্প এই ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় এলাকাটিকে ধবংসস্তুপে পরিণত করেছে। এই বাম নগরী ইতিহাসের বহু চড়াই-উৎরাই বুকে লালন করে সমতল মাটির লালিমায় পুনরায় নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। কেননা ইরান সরকার ঐতিহাসিক এই নগরীকে পুনরায় আগের ডিজাইনে নির্মাণ করছে। নগরটির কাজ দ্রুতই এগিয়ে যাচ্ছে। অনেকটা কাজ হয়ে গেছে তবে এখনও বাকি আছে। আশা করা হচ্ছে অচিরেই আবারও মুখরিত হয়ে উঠবে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের পদচারণায়। আজকের আসরে আমরা কেরমানে জরথ্রুস্টদের বসবাস এবং তাদের কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শনের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কেরমান প্রদেশটি ইরানের বৃহত্তম প্রদেশ। এ কারণে তুর্কি, লোরি, লাক ও বালুচদের বিভিন্ন গোত্রের লোকজন বিশাল বিস্তৃত এই প্রদেশে অভিবাসী হয়ে আসে। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বিচিত্র সংস্কৃতি ও সভ্যতার লোকজনের বসবাসের কারণে এখানে স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছে সাংস্কৃতিক বৈচিত্রসহ ভাষাগত বিভিন্নতাও। তাই কেরমান প্রদেশের একেক এলাকায় দেখা যাবে একেক রকমের ভাষাভঙ্গি। বিচিত্র গোত্র ছাড়াও কেরমান প্রদেশে রয়েছে হাজার হাজার জরথ্রুস্ট ধর্মাবলম্বী এবং ইহুদি সংখ্যালঘুদের বসবাস। এসব সম্প্রদায়ের লোকজন এখানে স্বাধীনভাবে তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করে। ধর্মীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠান-উৎসবাদিও উদযাপন করে থাকে।

জরথ্রুস্টদের বৃহৎ উৎসব প্রতি বছরই বাহমান মাসে এই কেরমানে অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবের নাম হলো 'সাদে'। ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে এই সাদে উৎসব ইরানের জাতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে কেরমানে জরথ্রুস্টদের উপাসনালয় কিংবা অতাশকাদেহর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছে। অতাশকাদেহ'কে বাংলায় অগ্নিমন্দিরও বলা হয়। এই অগ্নিমন্দির স্থাপনাটি ইটের তৈরি। মন্দিরের প্রধান ফটকে তিনটি শব্দ ডিজাইন করে লেখা রয়েছে। শব্দ তিনটি হলো: হোম্‌ত, হুক্‌ত এবং হুরাশ্‌ত। শব্দগুলোর অর্থ যথাক্রমে: সৎচিন্তা, সৎকথা ও সৎ কর্ম। এই অগ্নিমন্দিরটি শুরুতে চার হাজার বর্গমিটার আয়তনের ওপর গড়ে উঠেছে এবং পরবর্তীকালে এর আয়তন বেড়ে হয়েছিল আট হাজার বর্গমিটার।

কেরমানের জরথ্রুস্টদের উপাসনালয় কিংবা অতাশকাদেহর বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলছিলাম আমরা। বর্তমানে এই অগ্নিমন্দিরের ভেতরে সামাজিক কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যাপক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। রয়েছে সম্মেলন কেন্দ্র, ফুড কর্নার, লাইব্রেরি, কম্পিউটার সেন্টার, সংস্থার সাইট সাপোর্ট সেন্টার, ইরানের জরথ্রুস্টদের নৃতাত্ত্বিক মিউজিয়াম, সংস্থার কার্যালয়, পরিচালক পরিষদের কনফারেন্স হল এবং ধর্মীয় শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য ক্লাসরুম সম্বলিক আলাদা প্রশিক্ষণ ভবন ইত্যাদি। কেরমানের জরথ্রুস্ট সংস্থার মাধ্যমে সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়। এই অগ্নিমন্দিরে বিদ্যমান আগুন জরথ্রুস্ট্রিয়ান পুরোহিতদের মতে কয়েক হাজার বছর আগে ভারত থেকে যে আগুন এই অগ্নি মন্দিরে স্থানান্তরিত হয়েছিল সেই আগুনই।

অগ্নিমন্দিরের পর এবার মিউজিয়াম নিয়ে কথা বলা যাক। কেরমানের জরথ্রুস্ট মিউজিয়াম বিশ্বে জরথ্রুস্টিয়ানদের প্রথম নৃতাত্ত্বিক মিউজিয়াম। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দের দিকে এই মিউজিয়ামের কাজ শুরু হয়েছিল এবং শেষ হয়েছিল দুই হাজার এক সালের দিকে। ২০০৫ সালে এই মিউজিয়ামের কার্যক্রম আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। কেরমানের জরথ্রুস্টিয়ান যাদুঘরের একটি বিভাগ রয়েছে প্রদীপ, তেল-জ্বালানির বাতি, চর্বি জ্বালানির চেরাগ, এবং টিউলিপ ল্যাম্প সংরক্ষণের জন্য। এই যাদুঘরে রয়েছে দুই শ বছর আগের হাতে লেখা প্রাচীন এক খণ্ড বই। এই বইতে তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৮২৮। আরও আছে ৫০ বছর থেকে দেড় শ বছরের পুরোনো প্রাচীন নারী পোশাক। হাখামানেশিয় যুগের পোশাক থেকে সাসানীয় যুগের পোশাক পর্যন্ত জরথ্রুস্ট নারীদের পোশাক এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। ১৯০১ সালে এই মিউজিয়ামটি ইরানের জাতীয় ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে।

এবারে আমরা কেরমান শহরের অন্য একটি যাদুঘরের সঙ্গে পরিচিত হবার চেষ্টা করবো। এই যাদুঘরটি হলো কেরমান শিল্প যাদুঘর। নাম শুনে বুঝতে পারা যায় যে এই যাদুঘরে শুধু ইরানি শিল্পীদের শিল্পকর্মই স্থান পেয়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা নয়। ইরানি শিল্পীদের শিল্পকর্মের পাশাপাশি বাইরের বহু দেশের বিখ্যাত শিল্পীদেরও শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে এই যাদুঘরে। যাদুঘরটি নামকরণ করা হয়েছে ওস্তাদ আলি আকবার সানআতি'র নামে। প্রকৃতপক্ষে এই যাদুঘরে সংরক্ষিত এবং প্রদর্শিত শিল্পকর্মের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি শিল্পকর্ম ওস্তাদ আলি আকবার সানআতি'র। তিরাশিটির মতো শিল্পকর্ম রয়েছে আগেকার এবং সমকালীন ইরানি শিল্পীদের। ষোলোটি শিল্পকর্ম বিদেশি শিল্পীদের। যাঁর নামে এই যাদুঘর সেই ওস্তাদ আলি আকবার সানআতি ছিলেন একজন বিখ্যাত ভাস্কর। কেরমান শিল্প গবেষণা কেন্দ্রটিও তাঁরই অবদান।

প্রখ্যাত এই শিল্পী ও মনীষী ওস্তাদ আলি আকবার সানআতি অবশেষে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে পার্থিব এই দুনিয়ার মায়া ত্যাগ করে চলে যান পরকালের অনন্ত যাত্রায়। তাঁর তিরোধানের পর তাঁরই উত্তরসূরি আরও কয়েকজন শিল্পী আধুনিক শিল্প যাদুঘরটি গড়ে তোলেন। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ