ডিসেম্বর ০৫, ২০২০ ১৭:৩৩ Asia/Dhaka

প্রখ্যাত ইংরেজ মনীষী জন ডেভেনপোর্ট মহানবী (সা) ও ইসলাম সম্পর্কে যেসব স্মরণীয় বক্তব্য রেখেছেন সে বিষয়ে আমরা আলোচনা শুনেছি গত পর্বে। আজকের পর্বের প্রথম দিকেও একই বিষয়ে তার আরও কিছু বক্তব্য শুনব।

জন ডেভেনপোর্ট লিখেছেন, মহানবী (সা) এমন একজন ব্যক্তি যার বিষয়ে চুপ থাকা যায় না ও শ্রদ্ধা না জানানো অসম্ভব। তিনি বলেছেন, যখনই মুহাম্মাদের আবির্ভাবের আগের ও পরের আরবদের অবস্থার দিকে দৃষ্টি দেবেন এবং  এ দুয়ের মধ্যে তুলনা করবেন ও একইসঙ্গে তাঁর কোটি কোটি অনুসারীর হৃদয়ের মধ্যে মুহাম্মাদের (সা) প্রতি ভালবাসা আর অনুরাগের যে শিখা জ্বলতে দেখা যায় ও যা আজও সেভাবেই জ্বলছে- সে বিষয়েও দৃষ্টি দেই তাহলে আমরা খুব ভালোভাবেই অনুভব করতে পারব যে এমন মহামানব ও অসাধারণ মানব সম্পর্কে আমরা যদি শ্রদ্ধা না জানাই ও প্রশংসা না করি তাহলে তা হবে নির্লজ্জতা ও অবিচার! তাঁর আবির্ভাবকে যদি কেবলই একটি ঘটনাক্রমিক বিষয় বলে মনে করি তাহলে তা হবে যেন মহান আল্লাহর সর্বশক্তিমান বা সবচেয়ে বড় শক্তিমান ও ক্ষমতাধর হওয়ার বিষয়েই সন্দেহ করা !

জন ডেভেনপোর্ট মুহাম্মাদ ও কুরআনের সমীপে ত্রুটির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা শীর্ষক বইয়ে মহানবীর নজিরবিহীন মু’জিজা পবিত্র কুরআনকে পরিপূর্ণতম বিধান ও খোদায়ি নিদর্শন হিসেবে অভিহিত করে লিখেছেন:   মুহাম্মাদ (সা)’র বিশ্বাস ও ঈমান-আকিদা সন্দেহ-প্রবণতা, অস্পষ্টতা ও দ্বিধা থেকে মুক্ত ছিল এবং কুরআন মহান আল্লাহর একত্বের স্পষ্ট ও বড় এক সাক্ষ্য। কুরআন এতই ত্রুটিমুক্ত ও নিখুঁত যে তাতে খুব ছোটখাটো সম্পাদনা ও সংশোধনেরও দরকার নেই। পবিত্র কুরআন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ে গেলেও কোনো মানুষ সামান্যতম ক্লান্তিও অনুভব করবে না। আর সবাই এটা স্বীকার করেন যে কুরআনের ভাষা সবচেয়ে বেশি আদর্শস্থানীয় বা সুরুচিসম্পন্ন ও কার্যকর এবং তা কুরাইশদের ভাষা-রীতি অনুসারে নাজিল হয়েছে। কুরাইশদের আরবি ভাষা সবচেয়ে বিশুদ্ধ ও আভিজাত্যপূর্ণ বলে ধরা হয় এবং কুরআন সবচেয়ে সুদৃঢ় তুলনা বা উপমা ও উজ্জ্বলতম নানা আঙ্গিকে পরিপূর্ণ।  

ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ জন ডেভেনপোর্ট-এর মতে ইসলামের নীতি এই যৌক্তিক ও বিবেক-প্রসূত বিধি-বিধানের আলোকে গড়ে উঠেছে যে যার জন্ম আছে তার মৃত্যুও অনিবার্য ও যার উত্থান ঘটে তার পতনও রয়েছে এবং যা পচনশীল তা এক সময় ধ্বংস হয়ে যাবে। ইসলাম মূর্তি-পূজা, ব্যক্তি-পূজা ও তারকা-পূজার বিরোধী।  মহানবীর যুক্তির মধ্যে রয়েছে আকর্ষণ ও উদ্দীপনা। আর এ যুক্তির আলোকে ইসলাম এমন অস্তিত্বের উপাসনার কথা বলে যা কোনো সীমিত সত্তা নয় ও অস্থায়ী কোনো সত্ত্বাও নয় এবং যার কোনো আকার-আকৃতি নেই ও যা স্থানের মধ্যে সীমিত নয় বা স্থানের মুখাপেক্ষী নয়। ইসলামের খোদার কোনো সন্তান নেই এবং তাঁর কোনো তুলনা ও সমকক্ষ নেই। আর তিনি দূরতম ও রহস্যময়তম দিক থেকে ও অদৃশ্য থেকেই আমাদের চিন্তাধারায় উপস্থিত রয়েছেন।

ব্রিটিশ প্রাচ্যবিদ জন ডেভেনপোর্ট আরও লিখেছেন, নিঃসন্দেহে মুহাম্মাদকে যদি বিশ্ব-ইতিহাসের আজ পর্যন্ত সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে বিরল ব্যক্তিত্ব ও পবিত্রতম প্রতিভা হিসেবে উল্লেখ না-ও করি অবশ্যই তাঁকে সেরা মহামানবদের একজন বলতেই হবে। এশিয়া মহাদেশ এমন একজন অনন্য সন্তানের জন্য গর্ব অনুভব করতেই পারে।

আলোচনার এ পর্যায়ে আমরা ইসলাম ও মহানবী সম্পর্কে প্রখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ভিক্টর হুগোর বক্তব্য তুলে ধরব। ফরাসি সাহিত্যের অন্যতম সেরা কবি ও গল্প লেখক এবং সাহিত্যে রোমান্টিসিজম ধারার পথিকৃৎ ভিক্টর হুগো বেশ কয়েকটি উপন্যাস বা বড় গল্পের জন্য খ্যাতিমান হয়ে আছেন বিশ্ব সাহিত্য অঙ্গনে। এসবের মধ্যে রয়েছে: লেস মিজারেবল বা নিঃস্বরা ও   Notre-Dame de Paris  বা কুঁজো পিঠের নটরডেম (The Hunchback of Notre-Dame) এবং The Man Who Laughs বা যে ব্যক্তি হাসতো ইত্যাদি।  হুগো অনেক কবিতা ও কয়েকটি নাটকও লিখেছেন। বাস্তবতা ও সমাজের অনুভবযোগ্য বাস্তবতা এবং সত্যকে জানার জন্য চিন্তাভাবনার গুরুত্ব তার কবিতা ও গল্পের প্রধান কয়েকটি বিষয়।

'প্রাচ্যতার কবিতা' নামে হুগোর একটি কাব্য সংকলনও রয়েছে। এ বইয়ের ভূমিকায় তিনি প্রাচ্য সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব তুলে ধরে লিখেছেন: ‘চতুর্দশ লুইয়ের সময় সবাই ছিল গ্রিস-বিশেষজ্ঞ। বর্তমানে প্রাচ্য-বিশেষজ্ঞ হওয়া উচিত এবং এশিয়ার জনগণের সংস্কৃতি ও সাহিত্য থেকে হতে হবে উপকৃত।  অতীতে আর কখনও এত বেশি চিন্তাবিদ এশিয়ার সুবিশাল অঞ্চল সম্পর্কে গবেষণায় মেতে উঠতে সাহসী হননি। আর তাই প্রাচ্যের রঙগুলো আমার সমস্ত ভাবনা-চিন্তা ও কল্পনাকে ছেয়ে ফেলেছে।...

ভিক্টর হুগোর আরেকটি কবিতার বইয়ের নাম ‘ শতকগুলোর কিংবদন্তি’। বইটি তিনি লিখেছিলেন নির্বাসিত থাকার সময়। বইটির তৃতীয় অধ্যায়ে একটি দীর্ঘ কবিতা বা কাব্যের নাম হল ‘হিজরতের নবম বছর’।  এতে মহানবীর (সা) জীবনের শেষের দিকের কিছু ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। হুগো কবিতাগুলো এমনভাবে লিখেছেন যে তাতে বোঝা যায় মহানবীর (সা) জীবন সম্পর্কে তিনি খুবই যথাযথ পড়াশুনা বা গবেষণা ও বিচার-বিশ্লেষণের যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। মহানবীর (সা) জীবনের  শেষ দিনগুলো তুলে ধরার পাশাপাশি হুগো মহানবী (সা) সম্পর্কে প্রশংসাসূচক কথা বলেছেন এবং বেশ শ্রদ্ধাভরে মহানবীর (সা) নানা গুণ আর বৈশিষ্ট্যও তুলে ধরেছেন তার ওই কবিতায়।

অন্য কথায় এটা স্পষ্ট যে হুগো মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা)'র ব্যক্তিত্ব ও তাঁর রিসালাতের প্রতি ছিলেন খুব গভীর শ্রদ্ধাশীল। হিজরতের নবম বছর কবিতাটি শুরু হয়েছে হযরত নুহ নবীর সঙ্গে মহানবীর (সা) তুলনার মধ্য দিয়ে। কবিতাটি পড়লে মনে হবে যেন হুগো মহানবী (সা)'র আধ্যাত্মিক ও আসমানি প্রকৃতি সম্পর্কে অজ্ঞ ও বিদ্বেষী পশ্চিমা প্রাচ্যবিদরা যুগে যুগে যে অসত্য চিত্র তুলে ধরেছেন সেসব দূর করে এ মহামানবের পবিত্র বৈশিষ্ট্যগুলোই তুলে ধরতে চেয়েছেন তিনি। ভিক্টর হুগো লিখেছেন:

মনে হয় যেন তিনি ছিলেন নুহ নবী ও জানতেন মহাপ্লাবন সৃষ্টিকারী বৃষ্টি সম্পর্কে

তিনি ছিলেন সহিষ্ণু বিচারক যখন মানুষেরা

তাদের বিবাদগুলো মেটাতে আসত তাঁর কাছে 

তখন তিনি একজনকে তার বিচারকে মান্য করার ও অন্যজনকে

রায় অস্বীকার করার ও উপহাসের জন্য ওঠার সুযোগ দিতেন

তার খাবার ছিল খুব সামান্য এবং কখনও ক্ষুধার কষ্টে পেটে বেঁধেছেন পাথর

নিজেই দোহন করতেন নিজ ভেড়ার দুধ

বিনম্র মানুষের মত মাটির ওপর বসতেন ও নিজেই নিজ পোশাকে তালি লাগাতেন

যদিও তিনি তখন আর যুবক ছিলেন না তবুও বেশিরভাগ দিনেই রোজা রাখতেন

রমজান মাসে যেমনটি রোজাদার ছিলেন।#

 

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ০৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ