ডিসেম্বর ০৬, ২০২০ ২০:৩৬ Asia/Dhaka

ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী ফাখরিজাদেকে হত্যার ঘটনা-ডেফিনেটলি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস। নির্দ্বিধায় এতে ইসরাইলের হাত ছিল। ইরান নিশ্চয়ই এর পাল্টা প্রতিশোধ নেবে। রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান।

ইরানের বিশিষ্ট পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদে

বিশিষ্ট এ বিশ্লেষক বলেন, বর্বর নেতানিয়াহু একজন আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল। ফাখরিজাদেকে হত্যার পাল্টা ব্যবস্থা নেয়াকে আমি নিবারক হিসেবে দেখি। বড় বড় মুসলিম দেশগুলোর উচিত ইসরাইলের বিরুদ্ধে একত্রিত হয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়া।

তিনি, নাম না করে একটি আরব দেশের নিন্দা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ঐ আরব দেশটি ইসরাইলকে স্বীকৃতি না দিয়েও তার চেয়ে বড় কিছু করছে যা মুসলিম বিশ্বের জন্য নিন্দনীয়।

ফাখরিজাদেকে হত্যার ঘটনাকে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই মনে করে এরফলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস আরও বেশি জটিল আকার ধারন করবে।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ

রেডিও তেহরান: জনাব, অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের শীর্ষ পর্যায়ের একজন পরমাণু বিজ্ঞানীকে সন্ত্রাসী কায়দায় হত্যা করা হয়েছে। এটিকে প্রায় সারা বিশ্ব থেকে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বলে নিন্দা জানানো হয়েছে। বর্বর এ হত্যাকাণ্ডকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

শহীদ পরমাণু বিজ্ঞানী ফাখরিজাদে

অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান: আমিও একইভাবে দেখছি। ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী ফাখরিজাদেকে হত্যার ঘটনা অত্যন্ত নিন্দনীয়, গর্হিত এবং আন্তর্জাতিক আইনের চরম বরখেলাপ হিসেবে দেখছি। যদিও কারা এর পেছনে ছিল তা সুস্পষ্টভাবে আইডেনটিফাই করা হয় নি। তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যেতে পারে এখানে ইসরাইলের সরাসরি ভূমিকা ছিল। একথা শোনো গেছে যে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অবগত করে তার সম্মতি নিয়েই ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে। এটিকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস হিসেবে ডেফিনেটলি চিহ্নিত করা যায়। আর ইসরাইল যে সন্ত্রাসী পথ বেছে নিয়েছে-ইরান সেটি মেনে নেবে এমনটি আমি সমর্থন করব না। আমার বিশ্বাস- ইরানের যে সামর্থ্য, প্রযুক্তি, সভ্যতার যে উৎকর্ষতা সবকিছু মিলিয়ে সে তার জবাব দেবে। ফাখরিজাদেকে হত্যার  ঘটনার পর এখন পর্যন্ত ইরান যে  উচ্চমানের ধৈর্য দেখিয়েছে এটাকে অবশ্যই প্রশংসা করব। তবে আমার ধারণা অত্যন্ত শান্তভাবে কোনো না কোনো একসময় ইরান এক্সাক্টলি একইধরনের পাল্টা প্রতিশোধ নেবে।

রেডিও তেহরান: জ্বি অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান-ফাখরিজাদে হত্যার ব্যাপারে ইরসাইলের জড়িত থাকার বিষয়টি আপনি আনছিলেন। ইরানের এ বিজ্ঞানী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ইহুদিবাদী ইসরাইল জড়িত বলে অভিযোগ করেছে তেহরান। ইরান বলছে, এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে ইসরাইলের। আপনার পর্যবেক্ষণ কি?

কথা আছে-ট্রাম্পকে জানিয়ে ইসরাইল ফাখরিজাদেকে হত্যা করে

অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান: জ্বি অবশ্যই। আমিও এ ব্যাপারে নিশ্চিত যে পরমাণু বিজ্ঞানী ফাখরিজাদেকে হত্যার ঘটনা ইসরাইল ছাড়া আর কেউ ঘটায় নি। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু বর্বর একজন আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল তাতে কোনো সন্দেহ নেই। অন্যদিকে ইরানের উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে যে অন্যায় আচরণ করে আসছে সে ব্যাপারে ইরান স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন কয়েক মাস আগে ইরানের অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় সামরিক জিনিয়াস জেনারেল সোলায়মানিকে হত্যা করে। ঐ ঘটনায় সারা মুসলিম বিশ্বই শুধু নয় সারা বিবেকবান বিশ্ব ক্ষুব্ধ হয়। এমনকি আমি নিজে পশ্চিমা গণমাধ্যম বিবিসিতে দেখেছি- জেনারেল সোলায়মানিকে নিয়ে একটি দীর্ঘ অনুষ্ঠান করা হয়। সেই অনুষ্ঠানে তারা জেনারেল সোলায়মানিকে যে শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তাতে মনে হচ্ছিল যে একজন ব্রিটিশ সামরিক কর্তাকেই তারা সম্মান জানাচ্ছেন।

আর সম্প্রতি ইরানের বিশিষ্ট একজন গবেষক, পরমাণু বিজ্ঞানী একজন স্কলার- তাকে সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত অবস্থায় এবং বিনা কারণে হত্যা করে  যে উসকানিমূলক আচরণ করা হলো-সেটাকে একটা দেশকে আক্রমণ ছাড়া আর কি বলা যায় ! ঐ ঘটনা একটি দেশকে আক্রমণ করার মতোই গর্হিত কাজ।

তবে আমি এখনও বিশ্বাস করি কোনো না কোনো স্টেজে গিয়ে ইরান যদি পাল্টা প্রতিশোধ না নেয় তাহলে ইসরাইল এইধরনের হঠকারীমূলক আচরণ ভবিষ্যতে আবারও করবে। তাদের বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়াটাকে আমি একটি নিবারক হিসেবে দেখছি।

রেডিও তেহরান:  অধ্যাাপক এম শাহীদুজ্জামান আপনি- আন্তর্জাতিক সমাজের কথা বলছিলেন। তো ইরানের এই বিজ্ঞানী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় আন্তর্জাতিক অঙ্গন থেকে নিন্দা ও সমবেদনা জানানো হয়েছে তবে এটাই কি যথেষ্ট বলে আপনার মনে হয়? এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সমাজের প্রকৃত দায়িত্ব কি?

জো বাইডেন

অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান: ঐ গর্হিত কাজের অবশ্যই আন্তর্জাতিকভাবে নিন্দা জানানো উচিত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রেসিডেন্ট, নতুন প্রশাসন ক্ষমতা গ্রহণ করবে। অন্যদিকে ইরানের যে নীতি এবং পলিসি তাতে বোঝা যাচ্ছে তারা ট্রাম্পের শেষ লগ্নে ট্রাম্পকে এমন কোনো কিছু করার সুযোগ দিতে চায় না যাতে ট্রাম্প গর্হিত কোনো কাজ করতে পারবে। তবে আমরা আশা করব জো বাইডেন প্রশাসন ক্ষমতায় আসার পর  বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হয়ে জাতিসংঘের মাধ্যমে-নিরাপত্তা পরিষদে এই আচরণকে যেন নিন্দা জানানো হয়। আর তাতে যেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভেটো প্রয়োগ না করে।

এছাড়াও এখন যে কোনো কোনো আরব দেশের পক্ষ থেকে ইসরাইলকে ঘটা করে স্বীকৃতি দেয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে তা অবিলম্বে বন্ধ হওয়া উচিত। ইসরাইলকে যারা স্বীকৃতি দিয়েছে তাদের তা প্রত্যাহার করে নেয়া উচিত। এখানে আমি নির্দিষ্টভাবে নাম না করে একটি আরব দেশের কথা বলতে চাই, যে দেশটি ন্যাক্কারজনক ভূমিকা রাখছে ইসরাইলকে স্বীকৃতি না দিয়েও। ঐ দেশটি ন্যাক্কারজনকভাবে ইরানের বিপক্ষে বারবার অবস্থান নিচ্ছে। ঐ দেশটি ইসলামি বিশ্বের জন্য যে একটা লজ্জাজনক দৃষ্টান্ত রাখছে এটা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই।

তুরস্ক, মালেশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, বাংলাদেশসহ বড় বড় মুসলিম দেশগুলোর উচিত হবে সবাই একত্রিত হয়ে ইসরাইলের বিরুদ্ধে এমন কিছু ব্যবস্থা নেয়া যাতে ভবিষ্যতে ইসরাইল-ফিলিস্তিন বিষয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে। শুধু তাই নয়; ইসরাইলকে ইরানের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে এমন একটি প্রক্রিয়া সৃষ্টি করতে হবে। আমার মনে হয় এটা অত্যাবশ্যকীয়। আমার বিশ্বাস নেতানিয়াহুর দিন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।

তাছাড়া ইসরাইলি হঠকারিতার তীব্র প্রতিবাদ করা উচিত। তারা গোলান হাইড দখল করে নিয়েছে। ভূমির উপর আগ্রাসন চালিয়ে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে বাধাগ্রস্ত করছে। এসব কিছুর বিপক্ষে ইরানের খুব দৃঢ় ও সুস্পষ্ট অবস্থান রয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই পার্সিয়ান সভ্যতা যখন তুঙ্গে ছিল জুডাইজম বা ইহুদি জাতিসত্তা প্রায় ধ্বংসের মুখোমুখি হতে যাচ্ছিল। তারা পলায়নরত ছিল। প্রায় কয়েকশ বছর জিউসরা ব্যাবিলনে আশ্রয় নিয়েছিল। তখন একজন পারস্য রাজাই কিন্তু জিউসদেরকে আশ্রয় দিয়েছিল বলেই ইহুদি ধর্ম ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল। বর্তমান ইসরাইলিরা একথাটা স্বীকার করতে চায় না। তাদের নিজেদের ধর্মের প্রতি যদি সত্যিকারার্থে সামান্যতম আস্থা থাকত তাহলে ধর্মকে রক্ষা করার জন্য নতজানু হয়ে ইরানের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া উচিত ছিল। প্রায় ৪ শ'বছর পারস্যের রাজারা ইহুদি ধর্মকে আশ্রয় দিয়েছিল।তা নাহলে আজকে পৃথিবীতে ইহুদি ধর্ম বলতে কোনো কিছু থাকত কিনা আমার প্রচুর সন্দেহ রয়েছে।

রেডিও তেহরান: এম শাহীদুজ্জামান, আপনি জাতিসংঘের কথা বলছিলেন। তো বিশ্বে সন্ত্রাসবাদ এবং নিরাপত্তাহীনতা দূর করার অঙ্গীকার ছিল জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি ইরানের বহু সামরিক-বেসামরিক ও  বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাকে হত্যা করা হলেও নিরাপত্তা পরিষদের পক্ষ থেকে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। কি বলবেন আপনি এ সম্পর্কে?

জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ

অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান: দেখুন, এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ও দুঃখজনক। নিরাপত্তা পরিষদের যে ডাবল স্টান্ডার্ড সেটাকেই এক্সপোজ করে। এসব ঘটনা আজকে ইরানে না ঘটে যদি পশ্চিমা বিশ্বে অথবা পশ্চিমা বিশ্বের মিত্র কোনো দেশে এরকম একটা ঘটনা ঘটত তাহলে হয়তো দেখা যেতো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে উত্তাপিত হতো। কিন্তু আমি খুব অবাক হয়ে যাচ্ছি- একারণে যে এ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে তুলবেই না কিন্তু পাশাপাশি জাতিসংঘের অন্য যেসব স্থায়ী সদস্য রয়েছে তারাও কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করে নি। এমনকি রাশিয়া ও চীনও কিন্তু এখনও সেভাবে এগিয়ে আসে নি।

এর কারণ হতে পারে যে এখন একটি ক্রান্তিলগ্ন; আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা হস্তান্তরের দিকেই সবাই তাকিয়ে আছে। যতক্ষণ না আমেরিকার ক্ষমতা পরিবর্তনের বিষয়টি ঠিক না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ কিছু করতে চাইছে না। যদি এমন যুক্তিও কেউ দেখায় সেটি হবে খোঁড়া যুক্তি।

আমি অবশ্যই মনে করি এটি নিরাপত্তা পরিষদের ব্যর্থতা। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই মনে করে এরফলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস আরও বেশি জটিল আকার ধারন করবে। ফলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তার পদচারণা আরও মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে। এক্ষেত্রে একটা বিষয় পয়েন্ট আউট করে যে, ইসরাইল এমন এমন কার্যকলাপ করছে যে ভবিষ্যতে ইহুদি জাতির অস্তিত্ব নিয়ে আমরা অতীতের যেসব বাস্তবতা পড়ে এসেছি বাইবেলে কিংবা অন্যান্য ধর্মগ্রন্থে যেভাবে পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে যে ইহুদি জাতির ধ্বংস তারা নিজেরাই কিভাবে টেনে নিয়ে এসেছে তারই দুঃখজনক দৃষ্টান্ত হচ্ছে বর্তমান নেতানিয়াহু সরকারের আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের আচরণ। আর তাদের এই আচরণ অতীতের সেই দৃষ্টান্তকে আরও বেশি তুলে ধরছে। একটা অবৈধ রাষ্ট্র হিসাবে ইসরাইল কি করছে তা আমরা সবাই জানি! আর সেজন্য ইসরাইলের একটা যৌক্তিক পরিণতি হওয়া উচিত।

রেডিও তেহরান: তো অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান। ইরানের পরমাণু বিজ্ঞানী ফাখরিজাদেকে হত্যা প্রসঙ্গে রেডিও তেহরানকে এক্সক্লুসিভ সাক্ষাৎকার দেয়ার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান: আমি উপস্থাপককে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং রেডিও তেহরানকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/০৬

  • বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ