ডিসেম্বর ০৭, ২০২০ ১৭:০৭ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা বিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক ও কবি ভিক্টর হুগোর “La Légende des siècles” বা শতাব্দিগুলোর কিংবদন্তি শীর্ষক কবিতায় ইসলাম ও মহানবীর (সা) চিত্র সম্পর্কে কিছুটা জেনেছি।

আজ এ বিষয়ে আরও কিছু আলোকপাত করব। হুগো নির্বাসিত থাকার সময় ১৮৫৫ থেকে ১৮৭৬ সনের মধ্যে এই কবিতা বা কাব্যটি লিখেছিলেন। এ কাব্যের তৃতীয় অধ্যায়ের শিরোনাম হল হিজরতের নবম বছর। এ অধ্যায়ে তিনি মহানবীর জীবনের শেষের দিনগুলো তুলে ধরেছেন।

হুগো মহানবীর প্রশংসা করে এ কবিতায় লিখেছিলেন: হে আল্লাহর রাসুল! আপনি জনগণের কাছে দাওয়াত দেয়া মাত্রই বিশ্ব আপনার কথায় ঈমান এনেছিল। যেদিন আপনার জন্ম হয়েছিল একটি তারকা আকাশে দেখা দেয় এবং খসরুর প্রাসাদের তিনটি মিনার বা টাওয়ার ধসে পড়ে! (La Legende des Siecles, IX, Islam(

মহানবী (সা) আনুষ্ঠানিকভাবে নবুওত লাভের আগেও সব সময়ই গভীর চিন্তা করতেন। তিনি ভাবতেন মহান আল্লাহর নানা নিদর্শন নিয়ে। তিনি দীর্ঘকাল ধরে হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় বসে সৃষ্টি জগতের নানা রহস্য নিয়ে ভাবতেন। মহানবীর (সা) এ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ভিক্টর হুগো তার ওই কবিতায় লিখেছেন:

 মুহাম্মাদ (সা) যেন বেহেশত দেখেছেন এবং দেখেছেন প্রেম, ভবিষ্যৎ ও অতীত

বেশিরভাগ সময়ই নীরব থাকতেন ও শুনতেন

সবার পরে কথা বলতেন

সব সময় প্রার্থনায় মশগুল থাকতেন।

ভিক্টর হুগোর দৃষ্টিতে মহানবীর (সা) বিনম্রতা ও মহত্ত্বের কারণে কেউ তাঁকে তিরস্কার করত না। যখন তিনি মহল্লার অলি-গলি ও পথ অতিক্রম করতেন তখন সব দিক থেকে পথিকদের সালাম পেতেন তিনি এবং অত্যন্ত দয়াদ্রভাবে জবাব দিতেন মহানবী (সা)।

রাসুল (সা) কোনো কোনো সময় ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজের স্থলাভিষিক্ত তথা ভবিষ্যৎ প্রতিনিধি নিযুক্ত করতেন যাতে তাঁরা মহানবীর (সা.) আসমানি রেসালাতের  আমানতদার হতে পারেন এবং জনগণকে সৌভাগ্যের পথ দেখাতে পারেন। ভিক্টর হুগো তার কবিতার একাংশে মহানবীর পক্ষ থেকে হযরত আলীকে নিজের প্রতিনিধি বা স্থলাভিষিক্ত নিয়োগের দিকে ইশারা করে লিখেছেন:

তিনি ছিলেন শান্ত

কিন্তু তাঁর দৃষ্টি ছিল উচ্চ-আকাশের ঈগল পাখির মত যে বাধ্য হয়েছে আকাশ ছেড়ে নেমে আসতে।

প্রতিপালকের কাছ থেকে মানুষের জন্য আনা কুরআনের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পুনরাবৃত্তি করতেন।

এরপর ইসলামের পতাকা তিনি তাঁর পতাকাধারী আলীর কাছে ন্যস্ত করেন এবং বলেন এটাই আমার জীবনের শেষ প্রভাত/ এক ও অদ্বিতীয় আল্লাহ ছাড়া কোনো খোদা নেই, তাঁর পথে জিহাদ কর বা সচেষ্ট থাক! হুগো আরও লিখেছেন,

সেদিনও তিনি অন্য সব দিনের মতই নামাজের সময় মসজিদে এলেন। তিনি হযরত আলীর দেহের ওপর ভর করলেন বা হেলান দিলেন। বিশ্বাসীরা আসছিলেন তাঁর পেছেনে। বাতাস বইছিল পবিত্র পতাকাগুলোর মধ্য দিয়ে।

মহানবী (সা) ছিলেন সর্বশেষ রাসুল এবং পূর্ববর্তী নবী-রাসুলদের পথ অব্যাহত রাখার দায়িত্বে নিয়োজিত। তিনি এমন এক চেইন বা চক্রের পূর্ণতাদানকারী যে তাঁর নবুওত ও রেসালাত মানবজাতির ইতিহাসকে বদলে দিয়েছে। ভিক্টর হুগো তার কবিতায় এ প্রসঙ্গে মহানবীর হয়ে নিজ বক্তব্য তুলে ধরে বলছেন:

আমি তো আমার মহান আল্লাহর বাণীর একটি বাক্য

আমি ছাই, মানুষের রুটির মতন, আমি আগুন নবীদের মত আমি

উত্তাপ-সঞ্চারক ও আলোকদাতা/ ঈসা মাসিহ ছিলেন আমারই ভূমিকা বা পটভূমি

ভোরের আলোগুলোর মত যা কিনা সূর্যের সুসংবাদ বয়ে আনে

মরিয়মের পুত্র, ছিল প্রশান্ত ও খোশকালামের অধিকারী/ শিশুদের মত…

ভিক্টর হুগো ওই কবিতায় মহানবীর বক্তব্য তুলে ধরতে গিয়ে আরো লিখেছেন:

কিন্তু আমি ছিলাম এমন শক্তি যে ঈসার অপরিপূর্ণ নূরকে পরিপূর্ণ করেছিলাম 

... আমি সত্য ও ন্যায়ে বড় শেকড়ের অধিকারী ছিলাম

তাঁর সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য আমার আবির্ভাব

কিন্তু ক্ষোভ বা ক্রোধের মাধ্যমে নয়; দয়ার মাধ্যমে

একাকি ছিলাম ও এখনও একাই আছি/ নগ্ন ও ক্ষত-বিক্ষত

এবং এটাই বেশি ভালোবাসি

তাদেরকে অনুমতি দেয়া হত যে আমাকে দমন করার

অথচ আমার ডান হাতে ছিল সূর্য ও বাম হাতে চাঁদ

ওরা আমার ওপর কঠোর হামলা চালাল, কিন্তু অবশেষে হল পরাজিত

আর আমি এক পাও পিছু হটলাম না।

জীবনের শেষ দিনগুলোতে মহানবীর (সা) অসুস্থতা যখন বেড়ে গিয়েছিল তখন তিনি মসজিদে এসে বললেন:  আমার কাছে যারই কোনো কিছু পাওনা রয়েছে বা অধিকার রয়েছে সে তা এখন আদায় করুক! উম্মত কেঁদে উঠল ও বলল: ইয়া রাসুলুল্লাহ! আপনার ওপর আমাদের পাওনা বা অধিকার থাকতে পারে!? তিনি বললেন: আল্লাহর কাছে কলঙ্কিত হওয়া তোমাদের কাছে কলঙ্কিত হওয়ার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন! আমার কাছ থেকে তোমাদের কিছু পাওনা থাকলে তা এখনই আদায় করে নাও, তা যেন শেষ বিচারের দিন বা কিয়ামত পর্যন্ত না গড়ায়।

এক ব্যক্তি দাবি করলেন যে মহানবীর লাঠি একবার তার পেটে লেগেছিল এবং এখন সে প্রতিশোধ নিতে চায়! মহানবী তাঁর জামা উপরে তুলে ধরলেন! লোকজন এই লোকটির ব্যাপারে বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু লোকটি মহানবীর পায়ে পড়ল ও মহানবীর পেটে চুমো খেয়ে বলল: ইয়া রাসুলাল্লাহ!আপনার বদন ছুয়ে আমি নিজেকে দোযখের আগুন থেকে মুক্ত করছি! হুগো তার কবিতায় এ ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন।#

পার্সটুডে/আমির হুসাইন/আবু সাঈদ/ ০৭

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ