ডিসেম্বর ১০, ২০২০ ২৩:২৩ Asia/Dhaka

বাংলাদেশের নোয়াখালী ও সিলেটের এমসি কলেজে বর্বরোচিত দুটি ধর্ষণ কাণ্ডের পর দেশে ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হলেও এখনও ধর্ষণ কমেছে সে-কথা বলা যাবে না। যদিও সরকার ধর্ষণের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের আইন পাস করেছে।

তো ধর্ষণের কারণ ও প্রতিকার নিয়ে রেডিও তেহরানকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. মো: তাজুল ইসলাম বলেছেন, ধর্ষণের জন্য সামাজিক কাঠামো, মূল্যবোধ, রীতি-নীতি, প্রশাসন, বিচার-ব্যবস্থা,পরিবার অনেক কিছুরই দায় রয়েছে। সবকিছুকেই দায়িত্ব পালন করতে হবে। প্রতিরোধে সবাইকেই সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষত পরিবারের ভূমিকা অনেক।

সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।

সিলেটের এমসি কলেজের ধর্ষকরা

রেডিও তেহরান: জনাব, ডা.তাজুল ইসলাম, বাংলাদেশের সিলেট এবং নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে দুটি বর্বরোচিত ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল কয়েকমাস আগে। ঐ দুটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ উত্তাল হয়ে উঠেছিল। ব্যাপক প্রতিবাদ বিক্ষোভ হয়েছিল। এ ঘটনায় সারাদেশে ব্যাপক নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় বয়ে গেছে। কিন্তু অবাক করার বিষয় হচ্ছে বিষয়টি নিয়ে যে দেশে তোলপাড় হলো তারপরও একের পর এক ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। সেটি কমেছে সেকথা বলা যাবে না। তো এর প্রধান কারণ কি বলে আপনার মনে হয়?

ডা. তাজুল ইসলাম: ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করেছেন। বাংলাদেশে আসলে সামাজিক নৈরাজ্য বলতে আমরা যা বুঝি সেটি একটা চরম পর্যায়ে চলে গেছে। একটি দেশের সামাজিক কাঠামো, সামাজিক মূল্যবোধ, সামাজিক রীতি-নীতি, আইনের শাসন- এসবে যখন ধস নামে; যখন অকার্যকর হয়ে পড়ে তখন মানুষের ভেতরের পাশবিক  কামনা-বাসনা কিংবা লালসা নিয়ন্ত্রণের সুযোগ থাকে না। 

এসব নিয়ন্ত্রণ করতে হলে তো নিজের বিবেক নিয়ন্ত্রণ করে অথবা সামাজিক অনুশাসন নিয়ন্ত্রণ করে, পরিবার নিয়ন্ত্রণ করে অথবা আইন-আদালত নিয়ন্ত্রণ করে। তো নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাগুলো যদি অকার্যকর থাকে তাহলে রিপুর তাড়না,কামনা-বাসনা তুঙ্গে উঠে যায়। অর্থাৎ ভোগবাদি সমাজ ব্যবস্থাকে থামিয়ে বা দমিয়ে রাখার যে সিস্টেম –সেই সিস্টেমকে আমরা ব্যর্থ করেছি। সিলেটের এমসি কলেজ কিংবা নোয়াখালীর ঘটনা ঘটার পর, এত প্রতিবাদ বিক্ষোভ ও প্রচার হওয়ার পরও কিন্তু প্রতিদিনই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। এটি কমছে না বরং বাড়ছে।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ

এ প্রসঙ্গে যদি আমি এককথায় বলতে চাই তাহলে বলব, ব্যক্তি মানুষকে পারিবারিকভাবে লালন-পালন করে একজন সুমানব কিংবা সুনাগরিক তৈরি করার যে প্রক্রিয়া সেটি হচ্ছে পারিবারিক কাঠামো এবং সামাজিক ন্যায়বিচার। অর্থাৎ এ দুটো বিষয় ভালোকে ভালো বলা অন্যায়ের প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করতে শেখায়। অথচ সমাজের সেই শক্তি নষ্ট হয়ে গেছে। এখন অপশক্তিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। মুষ্টিমেয় কিছু গোষ্ঠী ক্ষমতার দাপটে নিজেদের একটা বলয় তৈরি করে নিয়ে কেবলমাত্র ধর্ষণ নয় সব ধরনের অপরাধ তারা করছে। তারাই সমাজ চালাচ্ছে। অর্থাৎ নষ্ট মানুষের হাতে সমাজ থাকলে সেই সমাজে নিয়ম-শৃঙ্খলা, মূল্যবোধ এসব তো থাকার কথা না। আপনি যদি তারও উপরে যান-পুলিশ প্রশাসন কিংবা বিচার ব্যবস্থার কাছে গিয়েও তাৎক্ষণিকভাবে তো আমরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছি না। বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা কিছুটা হলেও মদদ পাচ্ছে বা রক্ষা পেয়ে যাচ্ছে। সার্বিকভাবে এসবকিছুই ইঙ্গিত করে ধর্ষণ থেকে শুরু করে অন্য যে-কোনো ধরনের অপরাধ কমানোর ব্যবস্থা এখানে নেই। সবধরনের ব্যবস্থা কিন্তু ভেঙ্গে পড়েছে। ধ্বংস হয়ে গেছে আর সেজন্যই তো এসব বাড়ছে।

রেডিও তেহরান: অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম, আপনি জানেন যে, সিলেট ও নোয়াখালীর ঐ দুটো ঘটনার পর প্রতিবাদ বিক্ষোভের মুখে সরকার ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়ার নতুন আইন করেছে। প্রশ্ন হচ্ছে শাস্তি কঠোর করা হলে কি দেশে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে?

শ্লীলতাহানির প্রতীকী ছবি

ডা. তাজুল ইসলাম: দেখুন, আমি এটা মোটেও মনে করি না। এটা সম্ভবও না। প্রথম কথা হচ্ছে- দেশে আইনের শাসনই তো হচ্ছে না। যতটুকু শাস্তি এখানে দেয়ার কথা সেই শাস্তি কী প্রয়োগ হচ্ছে? আমরা তো সেই শাস্তি তাৎক্ষণিকভাবে বা দৃশ্যমানভাবে দেখতে পাচ্ছি না। আমরা পত্রপত্রিকায় দেখেছি ধর্ষণের ক্ষেত্রে মাত্র শতকরা ২/৩ ভাগ অপরাধীর শাস্তি হচ্ছে। বাকি শতকরা ৯৭/৯৮ ভাগ কিন্তু খালাস হয়ে যাচ্ছে। এই খালাস হয়ে যাওয়ার ফলে বোঝা যাচ্ছে বিচার কার্যকর হচ্ছে না। শাস্তির প্রয়োগ হচ্ছে না। শাস্তি যদি তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান না থাকে অর্থাৎ কবে সেটা আদালতে উঠবে, কবে তার বিচার হবে, কবে তার মৃত্যুদণ্ড হবে সেই খবর কি দেশের প্রতিটি কোণায় কোণায় পৌঁছে যায়, মানুষ কি তার খবর রাখে? এর বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন করতে হবে। গ্রামে-গঞ্জে প্রতিটি এলাকায় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। আমাদের তো প্রতিরোধের জায়গাগুলো নেই। আমরা তো সেখানে লড়াই করতে পারছি না। বরং চুপ হয়ে যাচ্ছি এবং এসব ঘটনা ঘটলে তা লুকিয়ে রাখছি।

রেডিও তেহরান: ডা. তাজুল ইসলাম, অনেকে অভিযোগ করছেন যে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই অনাচার বেড়ে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ। আপনারও কী তাই মনে হয়?

বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম

ডা. তাজুল ইসলাম: বিচারহীনতা একটি কারণ হতে পারে। শুধু বিচারহীনতাকেই দোষ দিয়ে লাভ হবে না। বিচার তো হবে আদালতে। সেখানে সমস্যা আছে। কিন্তু আমি বলতে চেয়েছি, স্থানীয়ভাবে সমাজটাই তো নষ্ট হয়ে গেছে। আগে যেভাবে সমাজে ভালো মন্দ মিলিয়ে চলতো এখন তো সমাজ চালাচ্ছে কিছু দুষ্টু প্রকৃতির এবং অপরাধপ্রবণ লোকেরা। যারা শুধুই অর্থের কারণে ক্ষমতা দিয়ে পুরো সমাজকে নিয়ন্ত্রণ করে, প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণ করে। তার উপরে গিয়ে বিচার ব্যবস্থা। সেখানেই তো যেতেই পারছে না মানুষ। যদি সমাজ এবং প্রশাসনিক কাঠামোকে সবল করে প্রতিরোধের ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে অপরাধ ঘটতেই থাকবে। সেখান থেকে হয়তো কিছু বিচারালয়ে যাবে এবং তার থেকে হয়তো দুই একটার শাস্তি হবে।

রেডিও তেহরান: অন্যান্য কারণগুলো কি আপনি বলবেন?

ডা. তাজুল ইসলাম: আমি মনে করি সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে আমাদের প্রশাসনিক কাঠামো এবং সামাজিক কাঠামোর মধ্যে অবক্ষয়।

রেডিও তেহরান: জনাব ডা. তাজুল ইসলাম, সাম্প্রতিক বিক্ষোভের সময় দেখা গেছে যে, বিক্ষোভকারীরা সরকারের পদত্যাগও দাবি করেছেন। তো এসব ধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে সরকারের পদত্যাগের প্রশ্ন কেন জড়িত করা হচ্ছে?

ডা. তাজুল ইসলাম: দেখুন, এটি আমার জন্য একটি সেনসিটিভ প্রশ্ন। বাংলাদেশে এ ব্যাপারে কথা বলা ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়। যারা এসব কথা বলছে তারা হয়তো সাহস করে বলছে। তবে বিষয়টি হচ্ছে-তারা হয়তো এমনটি মনে করছে যে রাজনীতি যদি ঠিক না হয়, সরকার যদি ঠিক না হয়-তাহলে প্রশাসন কিভাবে ঠিক হবে এবং সমাজের কর্তৃত্ব যারা করছে তাদেরকে কিভাবে ঠিক করা যাবে! তারা হয়ত মনে করছে মূল যে গোড়া অর্থাৎ সরকার, সেখানে যদি পরিবর্তন হয় তাহলে হয়তো একটি পরিবর্তন দেখা যাবে। একদিক থেকে তাদের এ দাবি অনায্য সেকথা বলা যাবে না। 

ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড

তবে বিষয়টি হচ্ছে বিচ্ছিন্নভাবে যদি ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় কিন্তু সার্বিকভাবে সামাজিক কাঠামো এবং প্রশাসনিক কাঠামো সংস্কার করা না হয় তাহলে ওপর দিয়ে মলম দিয়ে মূল সমস্যার খুব বেশি সমাধান করা যাবে না। যারা দাবি করছেন তাদের বক্তব্যের পেছনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দিক আছে। তবে মূল জায়গায় কিছু না কিছু সংস্কার করতেই হবে। হয় সরকার বদল করতে হবে অথবা এই সরকারকেই তা করতে হবে।

রেডিও তেহরান: জনাব অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম। আমরা সাক্ষাৎকারের শেষ দিকে চলে এসেছি। সবশেষে আপনার কাছে যে বিষয়টি জানতে চাইব তা হচ্ছে, আসলে দেশে এই অসভ্য অনাচার বন্ধ করতে হলে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায় থেকে কি কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। আপনি যদি সুনির্দিষ্ট করে বলেন?

ডা. তাজুল ইসলাম: প্রথমে আমি বলব, প্রতিটি সমাজের সক্রিয় কিছু অংশ থাকে। যেমন ধরুন- সুশীল সমাজ, সংবাদপত্র, বিচারালয়, মানবাধিকার কমিশন-এসব যদি সত্যিকারার্থে নিরপেক্ষভাবে এবং জনবান্ধব হয়ে শক্তিশালীভাবে কাজ করত তাহলে অনেক অনাচার বন্ধ হয়ে যেত।

Image Caption

দ্বিতীয়ত: প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে-(আমি প্রশাসন বলতে সাধারণ প্রশাসন এবং পুলিশ প্রশাসন সবকিছুকে বোঝাতে চেয়েছি) দলীয়করণ থেকে শুরু করে একটি গোষ্ঠীতন্ত্র তৈরি হয়ে গেছে। যাঁরা শুধুই কেবল নিজের স্বার্থ কিংবা টাকা টাকা ছাড়া আর কিছু চায় না। তারা একটা বলয় তৈরি করে ফেলেছে। এই সিস্টেমটাকে ভাঙতে হবে। কিভাবে ভাঙা যাবে সে দায়িত্ব সরকারের। সর্বোচ্চ মহলের দায়িত্ব।

তৃতীয়ত: সমাজের সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্ব। পরিবারের মা-বাবা, আত্মীয় স্বজন, স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাসহ আমাদের সাধারণ মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য। আমাদেরকে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। ধর্ষণরোধে আমাদেরও অনেক দায়িত্ব আছে। আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যে আমরা কোন সমাজে এবং কিভাবে বসবাস করছি। এমনভাবে একটি সামাজিক কাঠামো তৈরি করতে হবে যাতে সমাজে যদি কোনো অন্যায় হয় তাহলে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিকভাবে সমাজের সবাই যেন সোচ্চার হয়ে ওঠে।

সন্তানের প্রতি পরিবারের দায়িত্ব

যারা এসব অপরাধ করছে-তারা তো আমাদেরই ছেলে সন্তান, তারা আমাদেরই পরিবারের লোক। অতএব সামাজিকভাবে কিংবা পারিবারিকভাবে আমার সন্তানের দায়-দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে।

কোনো অন্যায় কাজ করলে-সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রকে কেন আসতে হবে? একটা পরিবার কেন একটি রাষ্ট্র হিসেবে কাজ করবে না? পরিবারের দায়িত্ব হচ্ছে তাদের সন্তানদের তত্ত্বাবধান করা। তারা কি করে না করে, তারা কি ভালো মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠছে নাকি তারা একেক জন দুর্বৃত্ত হয়ে বেড়ে উঠছে-সেগুলো দেখার দায়িত্ব কি আমাদের ! অর্থাৎ সবকিছুকে এক করে যদি সামষ্টিকভাবে আমরা কাজ করতে পারি তাহলে এই অনাচার থেকে আমরা মুক্তি পেতে পারব।

রেডিও তেহরান: তো জনাব অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ধর্ষণ এবং এর প্রতিকার নিয়ে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

ডা. তাজুল ইসলাম: আপনাদেরওকে ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা।#

পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১০

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ