ডিসেম্বর ১৫, ২০২০ ২০:২০ Asia/Dhaka

গত পর্বে আমরা কেরমানের ঐতিহাসিক গ্রাম মেইমান্দে'র দিকে গিয়েছিলাম। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যেরে এমন মনোমুগ্ধকর গ্রামটিতে কিছুটা সময় কাটিয়েছিলাম আমরা। পর্বতবাসী মানুষের জীবনযাপন প্রণালী খুব নিবিড়ভাবে লক্ষ্য করেছি ওই মেইমান্দ গ্রামে।

আশা করি ওই গ্রামের অনন্য সাধারণ ঘরবাড়িগুলো ভালো লেগেছে আপনাদের। মেইমান্দ গ্রামের মায়া ছেড়ে আমরা আজ যাবো কেরমান প্রদেশেরই আরেকটি শহর জিরোফতের দিকে। আমরা জিরোফত নামের সুন্দর এবং পুরাতন শহরটি পরিদর্শন করে দেখবো ইনশাআল্লাহ। কারমান প্রদেশে এই জিরোফত শহরটি ইরানের বৃহত্তম প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান। এই ঐতিহাসিক স্থানটি ঘুরে দেখতে কার না ভালো লাগবে বলুন।  আপনি যদি ইতিহাস এবং প্রত্নতত্ত্বের প্রতি আগ্রহী হয়ে থাকেন তাহলে আপনার অবশ্যই জিরোফত শহরটি ভ্রমণ করা উচিত। এখানে রয়েছে একদিকে যেমন পর্যটকদের আকর্ষণ করার মতো  বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন তেমনি রয়েছে ইরানের যথারীতি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলা বৈচিত্রময় পাহাড়।

জিরোফত ইরানের আরেকটি ঐতিহাসিক এবং সুন্দর শহর যা কেরমান থেকে দুই শ ত্রিশ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এই শহরটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে যেমন ভরপুর তেমনি অনেক ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় নিদর্শনেও পরিপূর্ণ। সভ্যতার লালনভূমি ইরানের সমৃদ্ধ এবং প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয় এই জিরোফত। জিরোফতের কয়েক হাজার বছরের পুরনো সভ্যতা আজও এক অজানা বিস্ময়। রহস্যময়তায় ঢাকা এই মানব সভ্যতার প্রতি যে-কোনো প্রত্নতাত্বিকও আকৃষ্ট হবেন তাতে আর সন্দেহ কী। জিরোফত সভ্যতা প্রাচীন প্রাচ্যের প্রাচীনতম সভ্যতা। কৌশলগত ভৌগলিক অবস্থান এবং প্রাচীন প্রাচ্যের মহান সংস্কৃতি ও সভ্যতার যোগাযোগের পথে এর অবস্থান। এই বৈশিষ্ট্যের কারণে খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরু থেকেই জিরোফত হয়ে উঠেছিল শিল্প, সংস্কৃতিসহ কৃষি পণ্য এবং এ সংক্রান্ত কার্যক্রমের একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সমৃদ্ধ অঞ্চল।

তবে প্রত্নতাত্ত্বিক খননকাজসহ ঐতিহাসিক ও পুরাতাত্ত্বিক দিক থেকে সমৃদ্ধ এই অঞ্চলটি সম্পর্কে বিস্তৃত গবেষণা এখনও একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। নিঃসন্দেহে জিরোফতের সংস্কৃতি এবং সভ্যতার এই সমৃদ্ধির সাথে পরিচিতি মেসোপটেমিয়া থেকে এই অঞ্চলে বিশ্ব গবেষকদের দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে পারে। জ্ঞান ও সংস্কৃতি বিকাশে ইরানের ভৌগোলিক অবস্থান এবং এই ভূখণ্ডের মানুষের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ও অবদানের বিষয়টি আবারও সবার সামনে তুলে ধরতে পারে।

জিরোফতে রয়েছে কুলুকুলু ধ্বনিময় অনেক নদী এবং রয়েছে প্রাকৃতিক সেন্দৈর্যের বিচিত্র আধার। রয়েছে সবুজ শ্যামল পাহাড়, সুন্দর সুন্দর উপত্যকা। কেরমান প্রদেশের তথা দক্ষিণ-পূর্ব ইরানের হালিল নদী এখানকার সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থায়ী নদী। এই নদীর অস্তিত্ব জিরফতের উর্বর সমভূমিকে করে তুলেছে সবুজ শ্যামল। বিচিত্র ফুলের সমারোহে দৃষ্টিনন্দন হয়ে উঠেছে এখানকার পুরো পরিবেশ। যারা বন-বাদাড় অঅর পাহাড় পর্বত ঘুরে দেখতে ভালোবাসেন তাদের জন্য জিরোফতের রঙ এবং সৌন্দর্য যে চোখে মায়াবি আবেগ বুলিয়ে দেবে তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

জিরোফতে হাজার হাজার হেক্টর জমিতে রয়েছে শাকসব্জি আর ফলের বাগান। জিরোফত শহরটি এমনিতেও লম্বা এবং সুন্দর সুন্দর খেজুর গাছে পূর্ণ। উপযুক্ত জলবায়ু এবং মাটি ইরানের এই অংশটিকে একটি শক্তিশালী কৃষি কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলেছে এবং এর অনেকগুলি কৃষি পণ্য ইরানের বাইরেও রফতানি করা হয়। আমরা বলেছিলাম যে জিরোফতে থাকার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আকর্ষণ হল এর প্রাচীন স্থান। জিরোফতের গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন স্থানগুলির মধ্যে আমরা "দাকিয়ানুস শহর" এবং "কুনার স্যান্দাল" এর পাহাড়গুলির কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ইরানের মালভূমি অঞ্চলে আর্যদের আগমনের আগে সভ্যতার যেসব নিদর্শন অবশিষ্ট ছিল সেগুলোর উপস্থিতি আজও পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়ও বটে।

জিরোফতের পুরানো শহরটি "দাকিয়ানুস শহর" নামে পরিচিত। এই শহরটি জিরোফত শহরের কাছেই। শহরটিতে শক্তিশালী টাওয়ার ও দুর্গ ছিল এবং এখনও এর প্রাচীন অবকাঠামো নিয়ে ভাবলে সহজেই অনুমান করা যায় যে এটি খুব বিশাল একটি শহর ছিল। শহরটির চারদিকে সুবিস্তৃত প্রাচীর থেকে এ বিষয়টি অনুমান করা যায়। বিশেষ করে এই শহরের পূর্ব দিকের অংশেই প্রাচীরটি লক্ষ্য করা যায়। এই অঞ্চলের ঘরগুলিও কাদামাটি এবং কাদা দিয়ে তৈরি। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষকগণ ব্যাপক চেষ্টা প্রচেষ্টা ও গবেষণা চালিয়ে এখানকার দেয়ালটির কিছু অংশ মাটির নীচ থেকে বের করে আনতে সক্ষম হয়েছেন।  

প্রাচীন জিরোফত শহরটি আট শ বছর আগে অর্থাৎ সেলজুক শাসন আমলে গড়ে উঠেছিল। এই শহরের লোকেরা মুসলমান ছিল এবং তাদের ইবাদাতের জন্য একটি মসজিদও ছিল। পুরানো শহরের মসজিদটির বয়স এক হাজার বছরেরও পুরোণো বলে মনে করা হয়। এই মসজিদটি ইরানের প্রথম মসজিদ এবং ইসলামী বিশ্বের প্রাচীনতম মসজিদগুলির মধ্যে একটি। এই মসজিদটি দেখার জন্য পর্যটকদের মাঝে ব্যাপক আগ্রহ  লক্ষ্য করা যায়। দর্শনার্থীরাও এই মসজিদের প্রাঙ্গনে হাঁটতে হাঁটতে অন্যরকম একটা অনুভূতির মাঝে হারিয়ে যান।

কেরমান ইরানের সবচেয়ে বড় প্রদেশ। সুতরাং দর্শনীয় নিদর্শনও যে বেশি বেশি থাকবে তাতে আর অবাক হবার কী আছে। তবু আমরা চেষ্টা করবো পরবর্তী আসরেও কেরমানের আরও কিছু নিদর্শনের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিয়ে অন্য কোনো প্রদেশে যেতে। #

পার্সটুডে/নাসির মাহমুদ/মো.আবুসাঈদ/ ১৫

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।

ট্যাগ