‘স্বৈরাচারী কায়দায় ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছিল ট্রাম্প'
জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেবেন ২০ জানুয়ারি। গোটা আমেরিকা জুড়ে সশস্ত্র হামলার আশঙ্কায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। এর আগে কংগ্রেসে ট্রাম্পপন্থিদের হামলা এবং প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্প ইম্পিচড হয়েছেন। তারপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আমরা কথা বলেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. আকমল হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেছেন কংগ্রেসে হামলার ঘটনা কলঙ্কজনক। ঐ ঘটনায় আমেরিকার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়েছে।
বিশিষ্ট এই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বৈরতান্ত্রিকভাবে জোর করে ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। তিনি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক নন এবং রাজনীতিবিদও নন।
অধ্যাপক আকমল হোসেন আরও বলেন, যদি সিনেটে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইম্পিচড নাও হন তারপরও তাঁর নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরাজয় হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থি রক্ষণশীলতার প্রভাব অনেক বেড়ে গেছে। সেখানকার বর্তমান রক্ষণশীলতা মার্কিন রাজনীতিতে কালো দাগ রেখে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। এই অধ্যাপক বলেন, দুই শ'বছরের বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও আমেরিকা কালো মানুষদের প্রতি কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ করে না।
সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ ও উপস্থাপনা করেছেন গাজী আবদুর রশীদ।
রেডিও তেহরান: জনাব,অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের পর সম্ভবত আমেরিকার ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে কংগ্রেসে হামলা হয়েছে এবং এই হামলা করেছে ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্টের উগ্রবাদী সমর্থকরা। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনাকে অনেকেই মার্কিন গণতন্ত্রের পরাজয় বলে মন্তব্য করেছেন। আপনি কি বলবেন?

অধ্যাপক আকমল: নিঃসন্দেহে কংগ্রেসে হামলা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কলঙ্কজনক ঘটনা। আমেরিকানদের একটি ভাবমূর্তি আছে আর সেটি হচ্ছে- আমেরিকা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সেখানে নিয়মিতভাবে ৪ বছর অন্তর অন্তর প্রেসিডেন্ট ভোট হয় এবং যিনি নির্বাচিত হন তিনি ক্ষমতা গ্রহণ করেন।

তাছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন- গণমাধ্যম, জনমত, রাজনৈতিক দল তারা খুব সংগঠিত এবং সংহত। তো তাদের এই ভাবমূর্তির উল্টো দিকে ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে যে হামলার ঘটনা ঘটেছে সেটি অবশ্যই তাদের গণতেন্ত্রর ভঙ্কুরতা প্রমাণ করে। অর্থাৎ এখানে যে বিষয়টি বলা দরকার সেটি হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণপন্থি রক্ষণশীলতার প্রভাব অনেক বেড়ে গেছে। সেখানকার বর্তমান রক্ষণশীলতা মার্কিন রাজনীতিতে কালো দাগ রেখে যাচ্ছে। সমাজকে তারা বিভক্ত করে ফেলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচনে হেরে গেলেও তারপক্ষে ৭ কোটির ওপরে ভোট পড়েছে। আর তিনি যখন বলছেন নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে তখন তার বিশাল সংখ্যক সমর্থক ট্রাম্পের বক্তব্যকে বিশ্বাস করে। আর সেই বিশ্বাস থেকে এবং ট্রাম্পের প্রতি অন্ধ আনুগত্য পোষণের কারণেই ৬ জানুযারিতে কংগ্রেসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে অনুমোদন করার প্রচেষ্টাকে ভণ্ডুল করতে চেয়েছিল।
রেডিও তেহরান: জ্বি আপনি বলছিলেন যে, ট্রাম্পের প্রতি অন্ধ আনুগত্যপোষনকারী ডানপন্থিরা সেখানে একটা অস্থিশীলতা সৃষ্টির চেস্টা চালাচ্ছে, আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন ক্যাপিটল হিলে হামলার পর হামলাকারীদেরকে দেশপ্রেমিক বলে অভিহিত করেছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এ ঘটনার পর তার বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়া চলছে। এরইমধ্যে প্রতিনিধি পরিষদে তাকে ইম্পিচড করা হয়েছে। আপনার কি মনে হয় সিনেটেও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইম্পিচড হতে পারেন?
অধ্যাপক আজমল হোসেন: দেখুন, প্রতিনিধি পরিষদে ট্রাম্পকে ইম্পিচড করা হয়েছে। কারণ প্রতিনিধি পরিষদ ডেমোক্রাটদের নিয়ন্ত্রিত। এরপর সিনেটের অনুমোদন দরকার হবে। এরইমধ্যে সিনেটে পাঠানো হয়েছে। আর সিনেটের অনুমোদন পেলেই পুরো ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হবে। তবে সিনেটে এখন দুই দলেরই সমান সমান আসন রয়েছে। ফলে ইম্পিচড হতে হলে যে সংখ্যক ভোট প্রয়োজন হবে তারজন্যে রিপাবলিকানদের ভোটের ওপরও নির্ভর করতে হবে ডেমোক্রাটদেরকে। আর সেই সংখ্যক ভোট রিপাবলিকানরা দেবেন কি না সেটা নিয়ে একটা সংশয় রয়েছে।

ফলে দুটো বিষয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। একটি হচ্ছে সিনেটে ইম্পিচমেন্টোর ট্রায়াল করা এবং অন্যটি হচ্ছে যে সময় হাতে আছে সে সময়ে সম্ভব হবে কি না। ১৯ জানুয়ারি সিনেট বসবে। ফলে এই সময়ের মধ্যে সেটি সম্ভব হবে না। আমার কাছে আসলে ইম্পিচমেন্টের বিষয়টি খুব পরিস্কার না। তবে আমি বলব ইম্পিচমেন্ট প্রক্রিয়া পূর্ণভাবে সম্পন্ন না হলেও ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এ নিয়ে দ্বিতীয়বার তার মেয়াদে উদ্যোগ নেয়া হলো। ফলে এটা তার জন্য নৈতিক পরাজয়। মার্কিন আইন প্রণেতাদের একটি বিশাল সংখ্যক সদস্য মনে করেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট হিসেবে অনুপোযুক্ত। অতএব এটি তার জন্য নৈতিক পরাজয়ের সাথে সাথে রাজনৈতিক পরাজয়ও বটে।
রেডিও তেহরান: অধ্যাপক আকমল হোসেন, আপনি বলছিলেন যে যদি ট্রাম্প ইমপিচড নাও হন তারপরও এটি তার নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরাজয়। তো এই ধরণের ন্যাক্কারজনক ঘটনার প্রতি প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প কেন সমর্থন দিচ্ছেন? এটা কি তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা বা দূরদর্শিতার অভাব? আপনার কি মনে হয়?
অধ্যাপক আকমল হোসেন: দেখুন, আমি কোনোভাবেই ডোনাল্ড ট্রাম্পকে রাজনৈতিক ব্যক্তি বলে মনে করি না। তিনি ২০১৬ তে যখন নির্বাচিত হয়েছিলেন তখনই খবরটি শুনে আমি বিস্মিত হয়েছিলাম। কারণ রাজনীতিতে একেবারে নবাগত একজন ব্যক্তি যার কোনো রাজনৈতিক প্রশিক্ষণও নেই তিনি কিভাবে প্রেসিডেন্ট হলেন!

এর আগে আমরা যাঁদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে দেখেছি তাঁরা তাদের পার্টিতে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প একজন ধনী ব্যক্তি। তিনি তার অর্থনৈতিক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে রিপাবলিকান প্রাইমারিগুলোতে পার হয়েছিলেন সেসময়। আরেকটা বিষয় হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে ডানপন্থিদের যে উত্থান সেটি ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো মানুষের প্রশ্রয়ে হয়েছে। আর তারা দাবি করে শ্বেতকায় আমেরিকানরা শ্রেষ্ঠ। তারা দাবি করে যে আমেরিকা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর আগের দুই মেয়াদে যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন বারাক ওবামা তিনি কালো মানুষ। তার আমলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমেরিকার অবস্থান দুর্বল হয়েছে। তাদের আরও দাবি যেসব বিদেশি আমেরিকায় বসবাস করে তারাই এখানে সংঘটিত সব অন্যায়ের জন্য দায়ী। বিশেষ করে কালো মানুষদেরকে তারা ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখে। দুই শ'বছরের বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও আমেরিকা কালো মানুষদের প্রতি কোনো গণতান্ত্রিক আচরণ করে না। এসব বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলব যে ডোনল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হয়েছিলেন ঠিকই তবে তিনি কোনো রাজনীতিবিদ নন। তিনি এবার জোর করে হলেও ক্ষমতা ধরে রাখতে চেয়েছিলেন। একজন স্বৈরাচারী ব্যক্তি স্বেচ্ছাচারীতার মাধ্যমে তার সমস্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছেন।
রেডিও তেহরান: জনাব অধ্যাপক আকমল হোসেন, আমরা এই প্রসঙ্গ ধরেই জানতে চাইব আমেরিকার সাম্প্রতিক এই হামলার ঘটনা প্রতিরোধ করার ক্ষেত্রে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা দেয়া হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে উঠেছিলেন কিনা?
অধ্যাপক আকমল হোসেন: অবশ্যই, পুরো চার বছরই তিনি স্বৈরতান্ত্রিক আচরণ করেছেন। তাঁর নীতির সাথে যখন যারাই দ্বিমত করেছেন তার প্রশাসনে, যাঁদেরকে তাঁর পছন্দ হয় নি তাঁদেরকে একে একে বাদ দিয়ে দিয়েছেন খুবই অমর্যাদাকর পদ্ধতিতে। তারমানে তিনি কোনো গণতান্ত্রিক চিন্তার লোক নন। ফলে কোনো চিন্তা ভাবনা না করেই তিনি যে কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতেন।
রেডিও তেহরান: জনাব অধ্যাপক আকমল হোসেন, সবশেষে আপনার কাছে জানতে চাইছ, বলা হচ্ছে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর আমেরিকার স্বার্থে যতটা কাজ করেছেন তার চেয়ে অনেক বেশি ইসরাইলের স্বার্থ দেখেছেন। তার মানে হচ্ছে যে, তার পেছনে ইসরাইলি লবি আইপ্যাকের বিশেষ সমর্থন ছিল। এবারের নির্বাচনে ট্রাম্পের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে কি আইপ্যাকের পরাজয় ঘটলো?

অধ্যাপক আকমল হোসেন: দেখুন, একটা জিনিষ সব সময় দেখা গেছে আমেরিকার নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইসরাইলি লবি খুব বড় একটা ভূমিকা পালন করে। অর্থাৎ মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে যারা ইহুদি তারা সব সময় তাঁদেরকেই ভোট দেয় যারা ইসরাইলের স্বার্থ রক্ষা করে থাকে। এবারও তারা নিশ্চয়ই সেটা করেছে। তারপরও ট্রাম্প হেরে গেছেন।
এখন বিষয়টি যা দাঁড়াচ্ছে সেটি হলো- ট্রাম্প ক্ষমতায় থাকাকালে ইসরাইলের প্রতি মার্কিন যে নীতি কিংবা অবস্থান গ্রহণ করা হয়েছিল এবং এর ফলে ইসরাইল যতখানি উপকার পেয়েছে তা এর আগে কোনো প্রেসিডেন্টের আমলে করা হয় নি। আরব জগতকে বিভক্ত করে একের পর এক আরব রাষ্ট্রের সম্পর্ক সৃষ্টির মধ্য দিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প ইসরাইলের প্রতি তার অন্ধ নীতি বাস্তবায়ন করেছে। কিন্তু নির্বাচনের ক্ষেত্রে ইহুদি লবির সমর্থন সত্বেও ট্রাম্প জিততে পারে নি। ফলে আমি বলব নিশ্চয়ই ইহুদি লবি কিছুটা দুর্বল হয়েছে। যে কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয় হয়েছে।
রেডিও তেহরান: তো জনাব অধ্যাপক ড. আকমল হোসেন মার্কিন কংগ্রেসে ট্রাম্পপন্থিদের ভয়াবহ হামলার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী সম্পর্কে রেডিও তেহরানের সাথে কথা বলার জন্য আপনাকে আবারও অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।
অধ্যাপক আকমল হোসেন: আপনাকেও ধন্যবাদ।#
পার্সটুডে/গাজী আবদুর রশীদ/১৮
- বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।