সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা-মাকে হতে হবে খুব সতর্ক
আদর্শ মানুষ গড়ার কৌশল (পর্ব-২)
গত পর্বের আলোচনায় আমরা শিশু ও কিশোরদের আদর্শ মানুষ ও মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার পূর্ব শর্ত হিসেবে বিয়ের জন্য উপযুক্ত ও ধার্মিক বর-কনে নির্বাচনের গুরুত্ব সম্পর্কে কথা বলেছি। আজ আমরা সংশ্লিষ্ট আরও কিছু দিক ও বিষয় নিয়ে কথা বলব।
ইসলামের দৃষ্টিতে মানব প্রজন্ম অব্যাহত রাখা বিয়ের অন্যতম লক্ষ্য। বিয়ে করা তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। মহানবী (সা) বলেছেন, সৎ ও নেককার সন্তান হচ্ছে বেহেশতের অন্যতম ফুল।
মহানবীর (সা) এই বাণী থেকেই স্পষ্ট যে একটি সুন্দর ফুলের জন্ম ও বিকাশের জন্য জরুরি হচ্ছে ভালো বীজ সংগ্রহ করা ও তা উপযুক্ত ক্ষেত্রে রোপণ ও সংরক্ষণ করা। এ ক্ষেত্রে কোনো ধরনের ভুল, অযত্নও উদাসীনতা ফুলের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হতে পারে।
অন্য কথায় বিয়ের জন্য যোগ্য বর-কনে বাছাই করা খুবই জরুরি। ইসলাম এক্ষেত্রে যেসব পরামর্শ দেয় সেসব বাস্তবায়ন করা উচিত। যোগ্য বর ও কনের যেসব বৈশিষ্ট্য বা যোগ্যতা থাকা উচিত সেসবের কোনো কোনোটি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে বিয়ের পরেও কেউ যদি সেসবের গুরুত্ব বুঝতে পেরে এটা দেখে যে হবু বর বা কনের মধ্যে সেইসব বৈশিষ্ট্য নেই বা সেইসব যোগ্যতা অর্জন তাদের পক্ষে সম্ভব নয় তাহলে ওই বিয়ের চুক্তি বাতিল করা বা বিয়ে ভেঙ্গেও দেয়া যেতে পারে।
বিয়ের পরে সৎ, সুস্থ ও যোগ্য সন্তান অর্জনের জন্য মানসিক ও শারীরিক প্রস্তুতিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। মাতৃগর্ভে সন্তানের প্রাথমিক অবস্থা কৃষিক্ষেত্রে উদ্ভিদের বীজ বপনের সময়ের মতই গুরুত্বপূর্ণ। এ সময়ে বাবা ও মায়ের মন যে কোনো ধরনের টেনশন বা অস্থিরতা, হতাশা ও দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকা উচিত। বরং নেক সন্তান অর্জনের জন্য বার বার মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করা ও আল্লাহর ওপর ভরসা করা উচিত। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে যাতে সন্তান হয় সুপথ-প্রাপ্ত ও সেই সন্তান ভবিষ্যতে অন্যদের জন্যও হয় হেদায়াতের আলো।
সন্তান গ্রহণের বা ধারণের প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বাবা মাকে হতে হবে খুব সতর্ক। কারণ এ সময়ে যে কোনো ধরনের ভুল পদক্ষেপ বা আচরণ ভবিষ্যৎ সন্তানের মন-মানসিকতায় ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। কেউ যদি জমিনে বীজ বপনের সময় যেসব প্রস্তুতি রাখা দরকার ও যেসব যত্ন নেয়া দরকার তা যথাযথভাবে না করেন তাহলে দেখা যাবে যে চারা জন্ম নিয়েছে তা কিছু দিনের মধ্যেই নির্জীব হয়ে পড়েছে এবং ওই গাছে কখনও ভালো ফল ধরবে না। আর মানব শিশু জন্ম দেয়ার প্রাথমিক কাজ একটি উদ্ভিদের চারা জন্মানোর চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
সন্তানের বাবা-মা হওয়ার প্রাথমিক পর্যায়ের কার্যক্রম, যেমন এ সংক্রান্ত কার্যক্রমের সময়, স্থান ও সে সময়ে বাবা-মায়ের মানসিক অবস্থা ইত্যাদি বিষয় সন্তানের ওপর ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বিষয়টি সন্তানের অধিকারের সঙ্গেও সম্পর্কিত। তাই ইসলামী শিক্ষায় এ বিষয়ে যত্নশীল ও সতর্ক থাকতে ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
মহানবী (সা) ও উম্মুল মুমিনিন হযরত খাদিজা (সালামুল্লাহি আলাইহা) যখন আদর্শ নারী হযরত ফাতিমার জনক-জননী হতে চাইলেন তখন এর প্রাথমিক প্রস্তুতি হিসেবে মহান আল্লাহর নির্দেশে রাসুলে পাক চল্লিশ দিন স্ত্রী হযরত খাদিজা থেকে দূরে থাকেন বলে বর্ণনা রয়েছে। মহান আল্লাহর এ নির্দেশ পালন করা মহানবীর জন্য খুব কঠিন হলেও তিনি তা পালন করেন এবং এ সময় তিনি রাতের বেলায় ব্যাপক ইবাদাত-বন্দেগি করতেন ও দিনের বেলায় রোজা রাখতেন। এ সময় তিনি হযরত খাদিজার কাছেও এ বার্তা পাঠান যে এই দূরে থাকার বিষয়টির কারণ তাঁর প্রতি কোনো ধরনের বিরক্তি বা বিরূপ মনোভাব নয়, বরং মহান আল্লাহর নির্দেশই এর কারণ ও নিশ্চয়ই এর মধ্যে কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু নেই। কারণ মহান আল্লাহ প্রতিদিন খাদিজার বিষয়ে বিশিষ্ট ফেরেশতাদের কাছে গর্ব প্রকাশ করেন।
মহীয়সী নারী হযরত খাদিজা থেকে চল্লিশ দিন দূরত্ব বজায় রাখার কার্যক্রম শেষ হলে মহান ফেরেশতা জিবরাঈল মহান আল্লাহর নির্দেশে বেহেশতের একটি আপেল বা একটি খেজুর মহানবীর কাছে নিয়ে আসেন। এই খেজুর খেয়ে মহানবী (সা) হযরত খাদিজার ঘরে যান। হযরত খাদিজা বিছানা থেকে উঠেই নিজের মধ্যে হযরত ফাতিমার নুর অনুভব করছিলেন। হযরত ফাতিমা (সালামুল্লাহি আলাইহা) শৈশব থেকেই ছিলেন বাবার সহায়তাকারী ও বাবার প্রতি যত্নশীল। তাই তাঁকে বলা হয় উম্মে আবিহা বা পিতার মাতা। জগত-বিখ্যাত ইমাম হযরত হাসান ও হযরত হুসাইনের (আ) মা কেবল ইতিহাস নির্মাতা এ দুই মহান ইমাম তথা বেহেশতী যুবকদের সর্দারের মা-ই নন তিনি নিজেও বেহেশতি নারীদের নেত্রী তথা সর্বকালের সেরা নারী হিসেবে খ্যাত।
ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী সন্তান গ্রহণের উদ্দেশ্যে মিলনের আগে মুসলিম স্বামী-স্ত্রীকে দুই রাকাত নামাজ পড়তে হয়। এরপর মহান আল্লাহর প্রশংসা ও মহানবী (সা) এবং তাঁর পবিত্র আহলে বাইতের শানে দরুদ পাঠের পর একটি বিশেষ দোয়া পড়তে বলা হয়েছে। স্বামী এ দোয়ায় বলবেন: হে আল্লাহ! এই নারীর ভালবাসা ও সন্তুষ্টি আমাকে দান করুন এবং তার মাধ্যমে আমাকে সুখী করুন। আমাদের মধ্যে সর্বোত্তম রূপের ও সবচেয়ে প্রিয় অনুরাগ জমিয়ে দিন। কারণ আপনি হালাল বা বৈধ বিষয়গুলো পছন্দ করেন এবং হারাম বা নিষিদ্ধ বিষয়গুলো অপছন্দ করেন। নারীও নামাজ শেষে একইভাবে হামদ ও দরুদ পাঠের পর একই ধরনের দোয়া পড়বেন।
ইসলামী বর্ণনা অনুযায়ী এ সময় তথা মিলনের আগে এটাও মুস্তাহাব যে স্বামী তার দুই হাত স্ত্রীর কপালের দুই পাশে রেখে এই দোয়া পড়বেন: হে আল্লাহ! তোমার কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী এই নারীকে বিয়ে করেছি এবং তোমার আমানত, বা গ্যারান্টি বা নিরাপত্তায় তাকে গ্রহণ করেছি এবং তোমার বাক্যগুলোর মাধ্যম তাকে নিজের জন্য বৈধ করেছি। তাই আমার ভাগ্যে যদি সন্তান রাখ তাহলে তাকে সুস্থ ও সৎ মুসলমান করুন এবং শয়তানকে তার থেকে দূরে রাখুন।
সুস্থ সন্তান লাভের জন্য মদপানসহ সব ধরনের পাপ থেকে দূরে থাকতে হবে বাবা মাকে। মদ্যপায়ী ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দিতে নিষেধ করেছেন মহানবী (সা)।#
পার্সটুডে/এমএএইচ/এআর/২৫