ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২১ ২০:৫৪ Asia/Dhaka

পবিত্র কুরআনের তাফসির বিষয়ক অনুষ্ঠানের 'কুরআনের আলো'র এ পর্বে সূরা আয-যুমারের ৫১ ও ৫৩ নম্বর আয়াতের অনুবাদ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরা হবে। এই সূরার ৫১ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

فَأَصَابَهُمْ سَيِّئَاتُ مَا كَسَبُوا وَالَّذِينَ ظَلَمُوا مِنْ هَؤُلَاءِ سَيُصِيبُهُمْ سَيِّئَاتُ مَا كَسَبُوا وَمَا هُمْ بِمُعْجِزِينَ (51)

“তাদের দুষ্কর্মের (পরিণতি) তাদেরকে বিপদে ফেলেছে, এদের মধ্যেও যারা পাপী, তাদেরকেও অতি সত্ত্বর তাদের দুষ্কর্ম বিপদে ফেলবে। তারা তা প্রতিহত করতে সক্ষম হবে না।” (৩৯:৫১)

গত আসরে সেসব অকৃতজ্ঞ মানুষের কথা বলা হয়েছিল যারা বিপদে পড়লে আল্লাহকে ডাকে কিন্তু সুখের সময় তাঁকে ভুলে যায় এবং যারা তাদের জন্য আল্লাহর দেয়া নেয়ামতকে নিজেদের অর্জন বলে মনে করে। সেই আলোচনার ধারাবাহিকতায় এই আয়াতে বলা হচ্ছে: তারা যে বিপদ ও কষ্টে পড়েছিল তা ছিল তাদেরই কৃতকর্মের ফল। এমনকি তারা গতকাল ও আজ যেসব পাপকাজ করছে তার পরিণতি হিসেবেও তাদেরকে অনেক বিপদের মুখে পড়তে হবে। আর মূল শাস্তি তো কিয়ামতের দিন অপেক্ষা করছে। তারা যেন একথা না ভাবে যে, তারা দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের পাপকাজের পরিণতি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- প্রকৃতিতে যেমন প্রতিটি কর্মের সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে তেমনি মানুষের জীবনেও মহান আল্লাহর একইর রকম নিয়ম বিদ্যমান। আজ হোক অথবা কাল প্রতিটি মানুষকে তার ভালো ও মন্দ কর্মের ফল ভোগ করতে হবে।

২- আমরা যেসব নেয়ামত ভোগ করি তা আল্লাহ দয়াপরবশ হয়ে আমাদেরকে দান করেন। পক্ষান্তরে আমরা যেসব বিপদ-আপদ ও দুঃখ-কষ্টে পড়ি সেসব আমাদের মন্দ কথা, চিন্তা ও কর্মের ফসল।

সূরা যুমারের ৫২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

أَوَلَمْ يَعْلَمُوا أَنَّ اللَّهَ يَبْسُطُ الرِّزْقَ لِمَنْ يَشَاءُ وَيَقْدِرُ إِنَّ فِي ذَلِكَ لَآَيَاتٍ لِقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ (52)

“তারা কি (এখনো) জানেনি যে, আল্লাহ যার জন্য ইচ্ছা রিযিক বৃদ্ধি করেন এবং সংকীর্ণ করে দেন। নিশ্চয় এতে বিশ্বাসী সম্প্রদায়ের জন্যে নিদর্শনাবলী রয়েছে।” (৩৯:৫২)

গত আসরের একটি আয়াতে বলা হয়েছিল, কোনো কোনো মানুষ তার প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত নেয়ামতগুলোকে নিজের অর্জন বলে মনে করে। সেই ভ্রান্ত ধারণা প্রত্যাখ্যান করে এই আয়াতে বলা হচ্ছে, মানুষের রিজিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালার হাতে রয়েছে। কাজেই বিষয়টি এমন নয় যে, কারো মেধা ভালো হলেই সে নিজের চেষ্টায় রিজিক অর্জন করতে পারবে। অবশ্য এর অর্থ এটাও নয় যে, মানুষ আল্লাহর ওপর ভরসা করে রুজির জন্য হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকবে। বরং মানুষকে তার সাধ্য অনুযায়ী মেধা ও শ্রম কাজে লাগাতে হবে। এরপর আল্লাহ তাকে যতটুকু রিজিক দেন তা নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

কখনো একথা মনে করা যাবে না, যা কিছু পেলাম তার সবই আমার নিজের প্রচেষ্টা ও সাধনায় অর্জন করেছি। মানুষের জীবনে চলার জন্য যা কিছুর প্রয়োজন হয় এবং তার হাতে যা কিছু আসে তার সবই রিজিক। পার্থিব জীবনের নানারকমের কার্যকারণের মাধ্যমে সেই রিজিক আমাদের হাতে আসলেও তার পরিমাণ ও গুণগত মান আল্লাহ তায়ালা আসমানেই নির্ধারণ করে দেন।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- আমাদের দায়িত্ব হালাল রিজিক অর্জনের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা ও সাধনা করা। কিন্তু আমাদের হাতে কতটুকু রুজি আসবে তা আল্লাহ তায়ালার বিবেচনার ওপর নির্ভর করে।

২- মহান আল্লাহ রিজিক বন্টনের ক্ষেত্রেও ন্যায়বিচার করেন। তবে সে ন্যায়বিচারের অর্থ এই নয় যে, সবার কাছে সমান রুজি আসবে। তিনি বরং এই পার্থিব জগতের জন্য যে বাহ্যিক বিধান চালু করে দিয়েছেন তারই ভিত্তিতে তিনি ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির জন্য আলাদা আলাদা রিজিক নির্ধারণ করেন। এরপর যাকে যতটুকু রিজিক দিয়েছেন সেটুকু সে কিভাবে খরচ করল কিয়ামতের দিন তার পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব নেবেন।

সূরা যুমারের ৫৩ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন:

قُلْ يَا عِبَادِيَ الَّذِينَ أَسْرَفُوا عَلَى أَنْفُسِهِمْ لَا تَقْنَطُوا مِنْ رَحْمَةِ اللَّهِ إِنَّ اللَّهَ يَغْفِرُ الذُّنُوبَ جَمِيعًا إِنَّهُ هُوَ الْغَفُورُ الرَّحِيمُ (53)

“(হে নবী আপনি) বলুন, হে আমার বান্দাগণ যারা নিজেদের নফসের উপর যুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয় আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। কারণ, তিনি মহা ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (৩৯:৫৩)

এটি হচ্ছে মানুষের জন্য মহাগ্রন্থ আল-কুরআনের সবচেয়ে আশা জাগানো আয়াতগুলোর একটি। এখানে আল্লাহ তায়ালা তাঁর সমস্ত দয়া ও ক্ষমার ভাণ্ডার ঢেলে দিয়ে সবাইকে এই সুসংবাদ দিচ্ছেন যে, তিনি যেকোনো মানুষের যেকোনো ধরনের গোনাহ ক্ষমা করে দিতে পারেন। এই আয়াতে সব গোনাহগার বান্দা বিশেষ করে যারা নিজের প্রতি জুলুম করেছে এবং নিজের জীবন, সম্পদ ও মেধাকে ভ্রান্ত ও অনর্থক কাজে ব্যয় করেছে তাদেরকে উদ্দেশ করে বলা হচ্ছে: আল্লাহর দিকে ফিরে আসার রাস্তা সব সময় খোলা রয়েছে। তাঁর  দয়া ও রহমত এতটাই অসীম যে, কেউ যেন কখনোই সে দয়া ও ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারে নিরাশ হয়ে না যায়। সে যেন একথা না ভাবে যে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করবেন না।

নিশ্চিতভাবে আল্লাহর ক্ষমা ও দয়ার দরজা সব সময় তাঁর সব বান্দার জন্য খোলা রয়েছে। তবে এখানে শর্ত হচ্ছে, বান্দার মধ্যে গভীরভাবে এই উপলব্ধি আসতে হবে যে, সে ভুল করেছে এবং গোনাহ করে ফেলেছে। এই অনুশোচনার অনুভূতিটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।  অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে কায়মনোবাক্যে ক্ষমা চাইতে হবে এবং এই সংকল্প করতে হবে যে, এসব গোনাহর কাজের আর পুনরাবৃত্তি হবে না। এরকম অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা তার বান্দাকে ক্ষমা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।

কিন্তু কারো মধ্যে যদি এই উপলব্ধিই না আসে যে, সে গোনাহে লিপ্ত রয়েছে তাহলে তার পক্ষে অনুতপ্ত হওয়ারও যেমন সুযোগ নেই তেমনি আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ারও কোনো আশা নেই। কোনটি গোনাহ আর কোনটি গোনাহ নয় সেজন্য ইসলামের মৌলিক দিকনির্দেশনা জানতে হবে। দ্বীনি শিক্ষা সম্পর্কে অজ্ঞ থাকলে গোনাহে লিপ্ত থাকা অবস্থায়ও মনে হবে আমি তো ভালোই আছি। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, মৃত্যু আসার আগেই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করতে হবে। মৃত্যু বা কিয়ামতের আলামত দেখা যাওয়ার পর আল্লাহর ক্ষমা চাইলে তিনি তা ক্ষমা করবেন না।

এই আয়াতের শিক্ষণীয় দিকগুলো হলো:

১- আল্লাহর দয়া ও ক্ষমার কোনো সীমা নেই। এই আয়াতে শুধু মুমিনদের কথা বলা হয়নি বরং আল্লাহর সব বান্দার কথা বলা হচ্ছে।

২- আল্লাহর ক্ষমা পাওয়ার ব্যাপারে সব সময় আশাবাদী থাকতে হবে এবং কখনো নিরাশ হওয়া যাবে না।

৩- যেকোনো গোনাহের মাধ্যমে মানুষ নিজের ক্ষতি করে এবং যে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করার নির্দেশ আল্লাহ দিয়েছেন তা থেকে দূরে সরে যায়।#

পার্সটুডে/এমএমআই/এআর/৯

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।