পাশ্চাত্যে জীবন ব্যবস্থা (পর্ব-১৫)
গগত আসরে আমরা বলেছি নারীরা আগে পরিবার ব্যবস্থাপনায় যে ভূমিকা রাখতো এখন আর সে দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারছে না।
অতীতে পরিবার ব্যবস্থায় নারীরা সন্তান লালন-পালন এবং পরিবারের সব সদস্যের জন্য একটি নিরাপদ ও শান্তিময় পরিবেশ নিশ্চিত করার গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতো। কিন্তু এখন তারাও পুরুষদের মতো অর্থ উপার্জনের পেছনে সময় দেওয়ায় সন্তানদের দেখাশোনা সঠিকভাবে করতে পারেন না। ঘরের বাইরে কাজ শেষে পুরুষের মতো একজন নারীও ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফেরেন। এর ফলে স্বামী ও সন্তানদের মমতা ও ভালোবাসার চাহিদা পরিপূর্ণভাবে পূরণ করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। এসব কারণে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষ লেগেই থাকে। শান্তির সোনালী নীড় অশান্তির উৎস হয়ে ওঠে। আজও আমরা এসব বিষয়ে আরও আলোচনা করব। আশাকরি শেষ পর্যন্ত আমাদের সঙ্গেই আছেন।
পাশ্চাত্য সমাজে ফ্যামিনিজম বা নারীবাদের প্রভাব এবং এর ব্যাপক প্রচার পারিবারিক সহিংসতার আরেকটি বড় কারণ বলে অনেকেই মনে করেন। নারীবাদীদের দৃষ্টিতে, পারিবারিক ব্যবস্থায় অভিভাবক হিসেবে পুরুষের যে কর্তৃত্ব বা অবস্থান তা পুরোপুরি ভেঙে দিতে হবে। তাদের মতে, ঘরোয়া বা পারিবারিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের সবচেয়ে বড় উপায় হলো অভিভাবক হিসেবে পুরুষের যে কর্তৃত্ব বা অবস্থান তা প্রত্যাখ্যান করা, এর পাশাপাশি সহনশীলতার মনোভাব গড়ে তুলতে হবে এবং ব্যক্তি স্বাতন্ত্রের সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ফ্যামিনিজম বা নারীবাদের পক্ষের লোকজন সব সময় এমন এক কাংখিত পরিবারের চিত্র উপস্থাপন করেন যার সদস্যরা তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল এবং কারো নেতৃত্ব বা অভিভাবকত্বের অস্তিত্ব সেখানে নেই। অ্যান্ড্রে মিশেল নামের পরিবার বিশেষজ্ঞ ইউরোপে পরিবার ব্যবস্থার যে চিত্র তুলে ধরেছেন তাতে এই বিষয়টিই স্পষ্ট হয়েছে যে, "ব্যক্তি স্বাতন্ত্র এবং আনন্দ-ফুর্তি এখন সব কিছুর ওপর কর্তৃত্ব করছে। ইউরোপীয়রা এখন চায় না তাদের ব্যক্তিগত জীবন বা পারিবারিক নৈতিকতা সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণিত হোক।" এ কারণে ফ্যামিনিজমও পাশ্চাত্যে পারিবারিক সহিংসতার একটি বড় কারণ।
এ ক্ষেত্রে তারা পরবর্তী প্রজন্মের নীতি-নৈতিকতা বিকশিত করা সংক্রান্ত বিষয়গুলোকেও উপেক্ষা করছে। ঐক্য-সংহতি, পারস্পরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতা, ধৈর্য, সহনশীলতা এবং মানসিক প্রশান্তির মতো বিষয়গুলো যে একটি পরিবারের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা যেন তারা ভুলেই গেছে। বর্তমান প্রজন্মই যে পৃথিবীতে মানুষের শেষ প্রজন্ম নয় তা উপলব্ধি করতে তাদের কষ্ট হচ্ছে। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে নীতি-নৈতিকতার শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার কোনো দায়-দায়িত্বই যেন তাদের নেই। পরিবারগুলোতে নতুন প্রজন্মকেও ব্যক্তি স্বাতন্ত্র ও ভোগবাদের শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। পারিবারিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে এই শিক্ষা পদ্ধতিটির বড় বিপদ হচ্ছে, এ ধরণের শিক্ষায় শিক্ষিতরা কেবল তাদের নিজেদের সুখের কথাই ভাবেন, এর চর্চা করেন। এর সর্বনিম্ন প্রভাব হচ্ছে নারীদের বিরুদ্ধে পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধি। কারণ তাদের মধ্যে কেউই সমষ্টিগত কল্যাণের কথা ভাবতে পারে না, কেবল নিজের স্বার্থ বা কল্যাণই সব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে গণ্য হয়। এর ফলে প্রয়োজনের সময় বা বিপদ-আপদে আনন্দ-ফুর্তির ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটার মতো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতির জন্য তাদের কোনো প্রস্তুতি থাকছে না।
পশ্চিমা পরিবারগুলোতে পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির জন্য আরেকটি কারণ হলো কেবল আইনের মাধ্যমে পারিবারিক সমস্যা সমাধানের চেষ্টা। সাধারণভাবে মনে হতে পারে আইনের শাসনের কারণে পাশ্চাত্যের মহিলাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ঝুঁকি কমেছে। কিন্তু পাশ্চাত্যের সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের গবেষণামূলক প্রতিবেদন ও পরিসংখ্যানের দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝা যায় যে, বাস্তবতা ঠিক এর উল্টো। সেখানকার নারীরা ঘরের পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রেও সহিংসতার শিকার। যৌন হয়রানির মতো অনাকাংঙ্খিত ঘটনাগুলো সেখানে ক্রমেই বেড়ে চলেছে। মহিলাদের পক্ষে পাস হওয়া আইনগুলোর অকার্যকারিতা থেকে প্রমাণিত হয়, এই আইনগুলো পরোক্ষভাবে লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের বিপরীত ফল দিচ্ছে। পরিস্থিতির গভীরে গেলে দেখা যাবে, নারীদের সুরক্ষার জন্য যেসব আইন করা হয়েছে তা সহিংসতা বৃদ্ধির অদৃশ্যমান ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে যা সাধারণ দৃষ্টিতে ধরা পড়ে না।
পাশ্চাত্যের পরিবার ব্যবস্থায় নৈতিক মূল্যবোধের স্থানে আইনকে বসানো হয়েছে। কিন্তু পরিবার ব্যক্তিগত সীমানার আওতাভুক্ত এবং সেখানে সব বিষয়ই গোপন রাখা সম্ভব। এ কারণে পারিবারিক সহিংসতার নানা দিক ও খুটিনাটি বিষয় প্রমাণ করা অত্যন্ত কঠিন। এর ফলে এ ধরণের আইন থাকা সত্ত্বেও পারিবারিক সহিংসতা কমছে না। কিছু দিন আগেও ইতালির সরকার সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে নয়া আইন অনুমোদন করেছে। এতে পারিবারিক সহিংসতার শাস্তি কঠোরতর করা হয়েছে। 'সহিংসতার মোকাবেলায় নারী অধিকার' নামক সংস্থার গবেষক মারচেলা পিরুনা বলেছেন, দুঃখজনকভাবে ইতালিতে নারী হত্যা এবং নারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা ক্রমেই বাড়ছে। ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত স্বামী বা জীবনসঙ্গীর মাধ্যমে হত্যার শিকার হয়েছে তিন হাজার একশ'র বেশি নারী। নয়া আইন এ ধরণের সহিংসতা কমাতে ভূমিকা রাখতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী। আইন প্রণেতারা এ ক্ষেত্রে যে বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি তাহলো পরিবার হচ্ছে প্রেম-ভালোবাসা ও দয়া-মায়ার লালনকেন্দ্র। কেবল আইন নিয়ে এই ক্ষেত্রের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।
পরিবার হচ্ছে স্বামী-স্ত্রী তথা অন্য সদস্যদের প্রশান্তি ও আনন্দের উৎসস্থল। এখানে পরস্পরের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন গুরুত্বপূর্ণ। নীতি-নৈতিকতা পরিবারিক সম্পর্ককে দৃঢ় ও শক্তিশালী করে। এখানে নিজেদের মধ্যকার প্রতিশ্রুতি পালন ও সম্মান প্রদর্শন, আইনের চেয়ে অনেক বেশি কার্যকরি পন্থা। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে ভালোবাসা, দয়া-মায়া এবং সম্মান-বিশ্বাস না থাকলে যেকোনো ঘটনাই ঘটতে পারে যা নিরাপত্তা বাহিনীর পক্ষে কোনোভাবেই জানা সম্ভব নয়। এ কারণে যতদিন পর্যন্ত নীতি-নৈতিকতার ভিত্তিতে পারিবারিক সংস্কৃতিকে গড়ে তোলা না হবে ততদিন পর্যন্ত এ সংক্রান্ত সমস্যার স্থিতিশীল সমাধান সম্ভব নয়। শুধু আইন প্রনয়ণ করে এ ধরণের সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নীতি-নৈতিকতা এবং মানবীয় গুণাবলী এ ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।#
পার্সটুডে/সোহেল আহম্মেদ/মো: আবুসাঈদ/ ০৯
বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।