ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২১ ২০:৩০ Asia/Dhaka

রমজান অভিযানের পর আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীর বিরুদ্ধে মুসলিম বিন আকিল ও মহররম নামে দু’টি সীমিত আকারের অভিযান চালোনো হয়।

এই দুই অভিযানে ইরান বিজয়ী হয় এবং তেহরান প্রমাণ করে এ যুদ্ধের ভারসাম্য এখন তার পক্ষে রয়েছে। একই সময় ইরাকের সাদ্দাম সরকার ইরানকে একটি চাপিয়ে দেয়া শান্তি প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য করার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে তেহরানের ওপর চাপ সৃষ্টির চেষ্টা জোরদার করে। কিন্তু ইরান এই যুদ্ধের আগ্রাসী শক্তিকে চিহ্নিতকরণ ও তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় না হওয়া পর্যন্ত সাদ্দাম সরকারের সমর্থনে ও পক্ষপাতদুষ্ট শান্তি পরিকল্পনাগুলো মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এ অবস্থায় ইরাকের স্বৈরশাসক যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ না করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে ইরানের বিভিন্ন শহরে হামলা চালাতে থাকে। কাপুরুষোচিত এসব হামলায় ইরানের বহু বেসামরিক নাগরিক হতাহত হয়।

১৯৮২ সালের শেষ মাসগুলোতে যুদ্ধক্ষেত্র ও রাজনৈতিক অঙ্গনে ইরান ও ইরাকের পক্ষ থেকে ব্যাপক তৎপরতা চালানো হয়। এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর একটি ছিল ইরাকে ‘ইসলামি বিপ্লবী সর্বোচ্চ সংসদ’ নামের একটি রাজনৈতিক দল গঠন। সাদ্দাম সরকারের দমন অভিযানে ইরাক থেকে ইরানে পলায়নকারী সাদ্দাম বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের উদ্যোগে এই দল গঠিত হয়। ১৯৮২ সালের ১৭ নভেম্বর ইরাকের মরহুম আয়াতুল্লাহিল উজমা সাইয়্যেদ মোহসেন হাকিমের সন্তান সাইয়্যেদ মোহাম্মাদ বাকের হাকিমকে এই সংগঠনের মুখপাত্র ঘোষণা করা হয়। ইরাক সরকারের বিরুদ্ধে সেদেশের ইসলামি আন্দোলন এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এই দল গঠনকে গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণ বলে মনে করা হয়।

সাদ্দামের জন্য এই ঘটনা মেনে নেয়া সহজ ছিল না।  ফলে ইরাক সরকার ১৯৮৩ সালের মে মাসে আয়াতুল্লাহ সাইয়্যেদ ইউসুফ হাকিমসহ আয়াতুল্লাহিল উজমা হাকিম পরিবারের কয়েকজন আলেমকে আটক করে। এরপর তাদের মধ্য থেকে ছয়জনকে মোহাম্মাদ হোসেইন হাকিমের চোখের সামনে প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সাদ্দাম সরকার মোহাম্মাদ হোসেইন হাকিমকে একথা বলে ইরানে পাঠিয়ে দেয় যে, তিনি যেন বাকের হাকিমকে এ বার্তা পৌঁছে দেন যে, তিনি ইরাকে ফিরে না গেলে তার সন্তানদের হত্যা করা হবে।

ইমাম খোমেনেী (রহ.) এই ভয়াবহ অপরাধযজ্ঞের প্রতিক্রিয়ায় এক বার্তায় বলেন: “ইরাকের বর্বর সাদ্দাম সরকারের হাতে মরহুম আয়াতুল্লাহ হাকিম পরিবারের ছয় সদস্যের শাহাদাতের পীড়াদায়ক খবর ন্যুনতম মানবিকতা বোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের অন্তরে রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে। ইরাকি জনগণের জেনে রাখা উচিত এটি শুধুমাত্র হাকিম পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয় নয় বরং যারা চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে শহীদ হয়েছেন তারা ইরাকের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে ইসলামি আন্দোলনের পথে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম বিরোধী এই কাফেরকে (অর্থাৎ সাদ্দামকে) দীর্ঘদিন ইরাকের ক্ষমতায় থাকতে দেয়া হলে দেশটি থেকে সে ইসলামের নামনিশানা মুছে ফেলবে।”

ইরানের মাটিতে বসে ইরাকের ইসলামি আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে ‘ইসলামি বিপ্লবী সর্বোচ্চ সংসদ’ নামক রাজনৈতিক দল গঠনের ফলে ইরানের জন্যও ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয়। ইরান ইরাকের সাদ্দাম বিরোধী বিপ্লবীদেরকে ইরাক বিরোধী যুদ্ধে কাজে লাগানোর সুযোগ পায়। যুদ্ধ যত সামনের দিকে গড়াতে থাকে ততই এ যুদ্ধ পরিচালনায় অতিরিক্ত মনযোগের প্রয়োজন দেখা দেয়। ইরাকের সামরিক শক্তি বেড়ে যাওয়ার কারণে ইরানকে আরো বেশি সফল অভিযান চালানোর জন্য নতুন করে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হয়। ইরানে যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জামের ঘাটতি থাকায় অতিরিক্ত জনবল দিয়ে ওই ঘাটতে মেটাতে হয়।

সফল মহররম অভিযান চালানোর অল্প কিছুদিনেরমধ্যেই ওয়াল-ফাজর অভিযানের প্রস্তুতি শুরু হয়। ইসলামি বিপ্লব বিজয়ের আলোকোজ্জ্বল দশ প্রভাত বা ‘দাহেইয়ে ফাজরের’ কাছাকাছি সময়ে এ অভিযান চালানো হয়েছিল বলে এর নাম দেয়া হয় ওয়াল-ফাজর। যুদ্ধের মোড় ঘুরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বিশাল আয়োজনে এই অভিযান চালানোর সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু অভিযানটি ব্যর্থ হলে এটিকে ‘প্রাথমিক’ ওয়াল-ফাজর অভিযান নামে চিহ্নিত করা হয়।

মহররম অভিযানে সাফল্য পাওয়ার পর মনে হচ্ছিল ইরাকের আল-আম্মারা শহরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ কঠিন কোনো কাজ হবে না। কাজেই ইরান পরবর্তী অভিযানের জন্য এই শহরটিকে টার্গেট করে। ইরানের সেনাবাহিনী ও ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী- আইআরজিসি দু’টি আলাদা আলাদা পরিকল্পনা পেশ করে।

দু’টি পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত হয়, সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় আইআরজিসি’র পরিকল্পনা অনুযায়ী অভিযান পরিচালিত হবে। প্রাথমিক ওয়াল-ফাজর অভিযানের লক্ষ্য ছিল প্রথমে ‘গাজিলা’ নামক সেতু দখল করা এবং এরপর সম্ভব হলে আল-আম্মারা শহরটির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা। অভিযানে আইআরজিসি’র ১৩টি ইউনিট ও সেনাবাহিনীর তিনটি ইউনিট অংশগ্রহণ করে।  ১৯৮৩ সালের ৭ ফেব্রয়ারি রাত সাড়ে ৯টায় তিন দিক দিয়ে অভিযানটি শুরু করা হয়। ইরানি যোদ্ধারা শত্রুসেনাদের পেতে রাখা মাইন অপসারণ ও তাদের সম্মুখসারির প্রতিরক্ষা ব্যুহ ভেদ করার কাজ শুরু করেন। কিন্তু ইরাকি সেনারা ইরানের অভিযানের বিষয়টি টের পেয়ে যায় এবং তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা হামলা চালায়। এই ফ্রন্টে একটি বিশাল খোলা প্রান্তর ছিল যেখানে ইরানি যোদ্ধাদের অগ্রাভিযান রোধ করার জন্য আগে থেকে মাইন, খন্দক ও কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রেখেছিল ইরাকি বাহিনী। ফলে ইরানি যোদ্ধাদের পক্ষে ওই প্রতিবন্ধকতা ভেদ করে সামনে অগ্রসহ হওয়া সম্ভব হয়নি।

এই অভিযানে ইরাকিদের কয়েকটি নিরাপত্তা চেকপোস্ট ইরানের হস্তগত এবং ১২০ ইরাকি সেনা ইরানি যোদ্ধাদের হাতে বন্দি হলেও অভিযানের মূল লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। প্রাথমিক ওয়াল-ফাজর অভিযানে ইরানের প্রায় ৩০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হলেও এতে প্রায় ৬০০ ইরানি যোদ্ধা শহীদ ও দুই হাজার ৫০০ জন আহত হন। নিখোঁজ অথবা ইরাকি সেনাদের হাতে বন্দি হন আরো দুই হাজার ৫০০ যোদ্ধা।  ইরানের ৪৫টি ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান ইরাকিরা দখল করে নেয়। এই অভিযানের পরিকল্পনাকারীরা ভেবেছিলেন, ইরানি যোদ্ধারা উন্মুক্ত প্রান্তর দিয়ে রাতের অন্ধকারে দ্রুত অগ্রসর হবেন এবং ইরাকি বাহিনীকে ঘায়েল করে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছে যাবেন। কিন্তু ইরান এর আগে এ ধরনের উন্মুক্ত প্রান্তর দিয়ে অভিযান চালিয়ে সফল হয়েছিল বলে এবার ইরাকি সেনারা তাদের উন্মুক্ত প্রান্তরে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিল।

সাধারণত যুদ্ধের ময়দানে শত্রুসেনাকে নতুন কোনো পরিকল্পনা দিয়ে একবারই ঘায়েল করা যায়। ওয়াল-ফাজর অভিযানে ইরানি যোদ্ধারা ইরাকিদের পক্ষ থেকে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। ইরানি কমান্ডাররা পরে হিসাব করে দেখেন তাদেরকে আটকে দেয়ার জন্য ইরাকি বাহিনী ১৬ ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে রেখেছিল। ইরাকিরা তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে এই কৌশল অবলম্বন করেছিল। ইরাকিরা এই অভিযানে আরেকটি কৌশল অবলম্বন করেছিল। সাধারণত তারা ফ্রন্টে তাদের সবচেয়ে প্রশিক্ষিত ও অভিজ্ঞ সেনাদেরকে মোতায়েন রাখলেও এবার তারা তাদের মূল শক্তিকে রেখেছিল পেছনের সারিতে; যাতে ফ্রন্টের বাধা অতিক্রম করতে করতেই ইরানি যোদ্ধারা ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ফলে এই ক্লান্ত যোদ্ধাদের ওপর মূল শক্তি দিয়ে হামলা চালিয়ে দখলীকৃত এলাকা পুনরুদ্ধার করা যায়। ওয়াল-ফাজর অভিযানে বাস্তবে হয়েছিলও তাই।#

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ১১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।