মার্চ ৩১, ২০২১ ১৯:৩০ Asia/Dhaka

যুদ্ধের ময়দানে পেরে না উঠে ইরাকি বাহিনী যুদ্ধকে বেসামরিক এলাকায় ছড়িয়ে দেয়। তারা ইরানের শহরগুলোর আবাসিক ঘরবাড়ির পাশাপাশি পারস্য উপসাগরে ইরানি তেল ট্যাংকার ও তেল শোধনাগারগুলোর ওপর হামলা চালাতে থাকে।

ইরাকি শাসক সাদ্দাম ইরানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান খাত তেল সম্পদের ওপর হামলা চালানোর কৌশল বেছে নেয়।  এ অবস্থায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ এ যুদ্ধের বিষয়ে ৫৪০ নম্বর প্রস্তাব অনুমোদন করে। আগের প্রস্তাবগুলোর বিপরীতে এবারের প্রস্তাবে এই যুদ্ধ শুরুর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার কথা বলা হয়। একইসঙ্গে ইরাকের নাম উল্লেখ না করে ইরানের বেসামরিক অবস্থানগুলোতে সাদ্দাম বাহিনীর হামলার নিন্দা জানানো হয়।

কিন্তু এই প্রস্তাবেও ইরানের দু’টি প্রধান দাবি অর্থাৎ যুদ্ধের আগ্রাসী পক্ষকে চিহ্নিত করা এবং তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করার কথা উল্লেখ করা হয়নি।  এর মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে ইরাকের সাদ্দাম সরকারের মিত্র দেশগুলো এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলো সাদ্দামকে বাঁচিয়ে দেয়ার চেষ্টা চালায়। কারণ, তাদের পূর্বাভাস অনুযায়ী ইরানে সাদ্দামের আগ্রাসন পরবর্তী পরিস্থিতি তাদের মতো করে অগ্রসর হচ্ছিল না এবং ইরানের পরিবর্তে সাদ্দামের অবস্থাই ক্রমাগত খারাপের দিকে যাচ্ছিল।

ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ও সর্বোচ্চ প্রতিরক্ষা পরিষদের প্রধান আয়াতুল্লাহ খামেনেয়ী ১৯৮৩ সালের ৩ নভেম্বর শুক্রবারের জুমার নামাজের খুতবায় জাতিসংঘের ৫৪০ নম্বর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবে ইরাকের সাদ্দাম সরকারকে অবশ্যই ইরানে আগ্রাসন চালানোর জন্য দায়ী করতে হবে। এই প্রস্তাব পাস হওয়ার পর সাদ্দাম বুঝতে পারে, সে আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মিত্রদের সহযোগিতায় এই যুদ্ধ থেকে সম্মানজনকভাবে বিদায় নিতে পারবে না। তাই সে এই যুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করতে শুরু করে।  প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের বড় শক্তিগুলোর পাশাপাশি পারস্য উপসাগরীয় আরব দেশগুলো সাদ্দামের পক্ষে থাকার কারণে তার পক্ষে যেকোনো সময় যেকোনো সমরাস্ত্র সংগ্রহ করা সহজ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইরানের জন্য অনেক হাল্কা অস্ত্র সংগ্রহ করাও কঠিন হয়ে পড়ে।      

ইরাকি বাহিনী এসব অস্ত্র দিয়ে ইরানের আবাসিক এলাকাগুলোতে হামলা চালিয়ে যায় এবং এদেশের নারী, শিশু ও বৃদ্ধ নির্বিশেষে শত শত বেসামরিক ব্যক্তিকে হতাহত করে। এ ধরনের হামলা এতটা তীব্রতর হয় যে, ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার জবাব দিতে বাধ্য হয়। ইরান ইরাকের সামরিক অবস্থানের পাশাপাশি শিল্পাঞ্চল এবং পারস্য উপসাগরে ইরাকি তেল স্থাপনাগুলোতে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়।    

এদিকে ইমাম খোমেনী (রহ.) ইরাকের চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধের তৃতীয় বার্ষিকীতে দেয়া এক ভাষণে বলেন: “…আল্লাহ না করুন, এ যুদ্ধ যেন আরেক বছর স্থায়ী না হয় এবং আগামীবছর যেন আমরা এ যুদ্ধের চতুর্থ বার্ষিকী পালন করতে বাধ্য না হই। আমরা এমন কিছু নেকড়ের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছি যারা যেকোনো কিছুর বিনিময়ে সাদ্দামকে ক্ষমতায় রাখতে চায়।  কিন্তু যে ব্যক্তি তার নিজের দেশের পাশাপাশি ইরান ও ইসলামের প্রতি এত বড় বিশ্বাসঘাতকতা করেছে তাকে বেশিদিন ক্ষমতায় রাখা যায় না।”

ইমাম আরো বলেন, “আমাদের এখন কাজ হবে, ইরানের মাটিতে সাদ্দামের হামলার ফলে যেসব অপরাধ হচ্ছে সেসব বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। এর ফলে প্রথমত, আগ্রাসী ইরাক সরকারের ভয়াবহ অপরাধযজ্ঞ বিশ্ববাসী জানতে পারবে। দ্বিতীয়ত, যেসব শক্তি এই অপরাধী সরকারকে যুদ্ধাস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সহযোগিতা করছে তাদের স্বরূপও উন্মোচিত হবে।  আমরা এসব শক্তিকে সুস্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই, তোমরা যদি সাদ্দামকে এর চেয়ে বেশি সাহায্য করো তাহলে আমরা তোমাদের তেলের উৎস বন্ধ করে দেব।  আর তোমরা যদি সাদ্দামকে এমন কোনো সাহায্য করো যা দিয়ে সে আমাদের অর্থনীতির উৎসে আঘাত হানে তাহলে তোমরা আর কোনোদিন তেল চোখে দেখবে না।  আমি আশা করছি তেমনটি হবে না। সাদ্দামকে যেসব পরাশক্তি পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে তাদের মধ্যে ফ্রান্স অগ্রগামী থাকলেও আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে যে সরকার সে হচ্ছে আমেরিকা।”

ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক ইমাম খোমেনী (রহ.)-এর এই সুস্পষ্ট অবস্থান ঘোষণার পর যুদ্ধের দ্বিতীয় ও তৃতীয় বছরে ইরান যেসব সফল অভিযান চালিয়েছিল সেগুলোর পুনরাবৃত্তি করার মতো কিছু পরিকল্পনা উত্থাপনের প্রয়োজন দেখা দেয়। তবে খোররামশাহর পুনরুদ্ধার হওয়ার পর সাদ্দাম যেভাবে ইরানের বেসামরিক স্থাপনায় হামলা চালানো শুরু করে তাতে ইরানের পক্ষ থেকেও রণকৌশলে পরিবর্তন আনার প্রয়োজন দেখা দেয়।  কিন্তু রণকৌশল পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে ইরানের সামনে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল। সফল অভিযান চালানোর মতো ভূখণ্ডের সীমাবদ্ধতা থাকায় ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনী বা আইআরজিসি এমন সব সীমান্ত এলাকা বাছাই করার কাজে মনযোগী হয় যেখান থেকে অভিযান পরিচালনা করলে নিশ্চিত বিজয় আসবে।

অভিযানের জন্য এমন সব ভূখণ্ড বাছাই করতে হবে যেখানে ইরানি যোদ্ধারা অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে সর্বোচ্চ সুবিধা পায় এবং যুদ্ধ করার ব্যাপারে ইরাকি সেনাদের আগ্রহ কম থাকে। এ অবস্থায় জলমগ্ন ভূমিতে যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে ইরাকি সেনাদের দুর্বলতার কথা বিবেচনা করে পরবর্তী অভিযানের জন্য ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় ‘হোর’ এলাকা বেছে নেয়া হয়। এই এলাকার তিনটি গুণগত বৈশিষ্ট্যের কারণে আইআরজিসি এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রথম কারণ ছিল, জলমগ্ন এলাকায় যুদ্ধ করা এবং তাৎক্ষণিকভাবে নিজেদের সামলে নেয়ার ক্ষেত্রে ইরাকিদের দুর্বলতা।  ইরাকি সেনাদের শক্তিমত্তার জায়গাটি ছিল তাদের সাঁজোয়া বাহিনী। কিন্তু হোর ছিল এমন একটি এলাকা যেখানে এই বাহিনীর করার তেমন কিছুই ছিল না।  

দ্বিতীয় যে বৈশিষ্ট্যের কারণে এই অঞ্চল বেছে নেয়া হয় তা হচ্ছে, অঞ্চলটি ইরানি যোদ্ধাদের সুপরিচিত ছিল এবং এরকম এলাকায় অভিযান চালানোর যথেষ্ট অভিজ্ঞতা তারা অর্জন করেছিল।  তৃতীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ কারণটি ছিল, ইরাকি সেনারা কখনো স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি যে, প্রাকৃতিক প্রতিবন্ধকতায় ভরা এমন একটি জলমগ্ন ভূখণ্ডকে ইরানি যোদ্ধারা অভিযানের জন্য বেছে নেবে। কাজেই আগ্রাসী ইরাকি বাহিনীকে হতচকিত করে দেয়ার লক্ষ্যে ‘হোর’ অঞ্চলটি বেছে নেয়া হয়েছিল।  এটি ছিল তুলনামূলক নীচু এলাকা এবং নতুন ও পুরনো কিছু নদীর চলার পথের এই ভূখণ্ডের বেশিরভাগ ছিল পানিতে ঢাকা। কাজেই এখানে যুদ্ধ করার মতো শক্তি ইরাকি বাহিনীর ছিল না।

পার্সটুডে/মুজাহিদুল ইসলাম/ মো: আবু সাঈদ / ৩১

বিশ্বসংবাদসহ গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে আমাদের ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।